Site icon The Bangladesh Chronicle

সংকোচনের শঙ্কা সর্বত্র

বাংলাদেশের এক দশকের বেশি সময় ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের উপরে ছিল। একসময় তা ৭ শতাংশ পেরিয়ে ৮ শতাংশ ছুঁইছুঁই করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিসংখ্যান বলছে, কোভিডের পর বড় ঝাঁকুনি খেয়েছিল দেশের অর্থনীতি। ওই অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৯-২০ সালে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি দেখানো হয় ৩.৪৫ শতাংশ। এরপর অর্থনীতিকে চাপমুক্ত করতে ও স্বস্তি ফেরাতে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করে সরকার। সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছিলো। কিন্তু ব্যয় সংকোচন নীতি থেকে সরে আসায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে। পাশাপাশি বৈশ্বিক সংকট ও সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতার নেতিবাচক পড়ছে রাজস্ব খাতে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন থেকে চলমান ডলার সংকটে এলসি খোলার জটিলতায় পণ্য আমদানি খাত সংকুচিত হয়েছে। নানা অনিশ্চয়তায় রপ্তানি কার্যক্রমে প্রবৃদ্ধি শ্লথ গতি।

ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা বিরাজমান ছিল। ফলে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাজস্ব আদায় হয়নি। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর এই ৬ মাসে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আহরণ ২৫ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা কমেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধিও কমছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, রাজস্ব আদায়ের নেতিবাচক কারণ হলো দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি কম থাকা। নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলো হরতাল ও অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে। ফলে ব্যাহত হয় স্বাভাবিক আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রম। এসব কারণে রাজস্ব আয়ে গতি আসেনি। রাজস্ব আহরণ কম হওয়ায় নানামুখী চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। এ ছাড়া ডলার সংকট, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পণ্যের দাম এমনিতেই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।

গতকাল আগারগাঁওয়ের রাজস্ব ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, আসন্ন রোজায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে আমদানি শুল্ক কমানোর ব্যাপারে এনবিআর কাজ করছে। তিনি বলেন, রমজান সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমাতে আমদানি শুল্ক কমানোর প্রস্তাব আমরা পেয়েছি। সেটা নিয়ে কাজ করছি।

এর আগে এক মাস আগে রাজস্ব আদায় নিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেছিলেন পণ্যের কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ার কারণে চলতি অর্থবছরে স্থানীয় পর্যায়ে রাজস্ব আয় কমে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ভ্যাট ফাঁকি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, পণ্য ও খাতভেদে ক্ষেত্র বিশেষে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি কমেছে, যার প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আদায়ে। যদিও নভেম্বর পর্যন্ত ১৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। ভ্যাটের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে ফাঁকি বন্ধে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। যেমন ইএফডি মেশিন স্থাপনের পর গড়ে ৫০ হাজার টাকা করে ভ্যাট আদায় হচ্ছে প্রত্যেক দোকান থেকে, যা আগে ছিল ৪-৫ হাজার টাকা।

মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), সম্পূরক শুল্ক, আমদানি-রপ্তানি শুল্ক, আবগারি ও অন্যান্য খাত থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত কর আদায় করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিবের সভাপতিত্বে বৈঠক হয়। সেখানে দেখানো হয়, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে প্রথম ছয় (জুলাই-ডিসেম্বর) মাসে লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা। বিপরীতে আদায় হয় ১ লাখ ৬৩ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জনের হার ৮৬ দশমিক ৪১ শতাংশ। বৈঠকে বলা হয়, গত অর্থবছরের এক সময়ে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রার অর্জনের হার ছিল ৯১.৯৯ শতাংশ। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বদ্ধপরিকর এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নিকট দায়বদ্ধ। বৈঠকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সচেষ্ট থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।

বিশ্লেষকরা জানান, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সম্প্রসারণমূলক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হচ্ছে না। বর্তমানে বিনিয়োগ হচ্ছে না। বিগত কয়েক মাস রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ছিল। এক্ষেত্রে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রাজস্ব আদায়ের একটি খাত রপ্তানি শুল্ক। কিন্তু নির্বাচনী অনিশ্চয়তা বিগত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এই ৩ মাসে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি। বিশেষ করে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অক্টোবরে ১৪৮ কোটি ডলার, নভেম্বরে ৫০ কোটি ডলার ও ডিসেম্বরে ৩১ কোটি ডলার আয় কমেছে। লক্ষ্যমাত্রার অর্জন ছাড়াও গত ৩ মাসে কোনো প্রবৃদ্ধি হয়নি। এদিকে বৈশ্বিক ও ডলার সংকটের কারণেও আমদানি খাত সংকুচিত হয়ে পড়ছে। ডলার সংকটের কারণে অনেক ব্যবসায়ী এলসি খোলার ক্ষেত্রে জটিলতার মুখে পড়েন। বিলাসী পণ্য এখনো আমদানি বন্ধ আছে।

নির্বাচনের আগের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জুলাই থেকে নভেম্বর এই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী খাদ্যপণ্যে প্রায় ৩৯ শতাংশ, নিত্যপণ্যে ২০ শতাংশ, প্রাথমিক পণ্যে প্রায় ২২ শতাংশ, জ্বালানি পণ্যে ২২ শতাংশ ও তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামালে প্রায় ২০ শতাংশ ডলার এলসি কম খোলা হয়েছে। যে কারণে আমদানি ও রপ্তানি খাত থেকে রাজস্ব আহরণ কমছে গত ৬ মাসে ১৫ শতাংশ। পাশাপাশি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ভ্যাট আদায় কমেছে ১১ শতাংশ। এটি মূলত পাইকারি ও খুচরা বাজারে স্থবিরতার কারণে হয়েছে। যদিও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে নতুন সরকার।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজস্ব আহরণের ঘাটতি আমাদের একটি বড় সমস্যা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার দরকার। রাজস্ব আদায়ে ডিজিটাল টেকনোলজি ব্যবহারসহ নানামুখী সংস্কার আনতে হবে। তাহলে সার্বিক রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ধারাবাহিকতায় ফিরবে।

সূত্রমতে, রাজস্ব আয়ের একটি বড় অংশ আসে বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প (এডিপি) থেকে। রাজনৈতিক বিবেচনায় এ বছর এডিপি’র আকার গত অর্থবছরের সংশোধিত এডিপি’র তুলনায় ৩৫ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা বাড়িয়ে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার এডিপি ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু বছরের মাঝামাঝিতে এসে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশকিছু নির্দেশনা দেয়া হয় অর্থ বিভাগ থেকে। অর্থ ছাড়ে কড়াকড়ি আরোপ করে এখন ১৮ হাজার কোটি টাকার এডিপি কাটছাঁট করা হচ্ছে। ফলে এখান থেকেও বছর শেষে রাজস্ব আদায় কমবে।

অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, রাজস্ব আদায়ের সার্বিক এ পরিস্থিতি বিবেচনায় চলতি বাজেটে (২০২৩-২৪) অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৩৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা কাটছাঁট করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

এফডিআই কমেছে: ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে তিন মাসে বাংলাদেশে নিট সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ, যা দেশের রিজার্ভের ক্ষয়কে আরও ত্বরান্বিত করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ৬৭০ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই প্রান্তিকে ছিল ১.১ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া ২০২৩ সালের প্রথম ৯ মাসে দেশে নিট এফডিআই এসেছে ২.১১৫ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৩.৭৮ শতাংশ কম।

নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে: নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারে অস্থিরতা। সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। ভরা মৌসুমে চড়া চাল ও সবজির দাম। এ ছাড়া বেড়েছে ব্রয়লার মুরগি, ডিম, মাংস, আটা, ময়দা, ডাল, ছোলা, আদা ও রসুনসহ আরও বেশ কিছু পণ্যমূল্য। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের তালিকা বলছে, বেশির ভাগ পণ্যের দর বেড়েছে।

উৎপাদন কমেছে: বড় বিনিয়োগের মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়িয়েও অনেক উদ্যোক্তা পরিকল্পনা অনুযায়ী উৎপাদন ধরে রাখতে পারছেন না। কাঁচামাল আমদানিতে এখনো ডলার মিলছে না চাহিদা অনুযায়ী। পাশাপাশি জ্বালানি সংকট, কাঁচামালের দামে ঊর্ধ্বগতি এবং চাহিদা সবকিছুর বিবেচনায় উৎপাদন সক্ষমতার বড় অংশই অব্যবহৃত থাকছে। দেশের ভারী শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ইস্পাত, সিমেন্ট, প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন খাতে এরইমধ্যে কমে গেছে অন্তত ৩০ শতাংশ উৎপাদন। চতুর্মুখী এ চাপে শিল্প-কারখানা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বৃহৎ শিল্প গ্রুপগুলোকে। শিল্প উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

মানব জমিন

Exit mobile version