Site icon The Bangladesh Chronicle

ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিক শেখ হাসিনা

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মতাদর্শ খুঁজে বের করার চেষ্টা করাও নিরর্থক। ৪০ বছর ধরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আছেন শেখ হাসিনা। এই দলটিকে বাংলাদেশের মধ্য-বামপন্থী রাজনৈতিক ধারার প্রতিভূ ভাবা হয়। কিন্তু টানা শাসনের ১৬ বছরে এসে হাসিনা ক্রমেই সবকিছুতে ষড়যন্ত্র খুঁজে পাওয়া বিকারগ্রস্ত প্রতিক্রিয়াশীলদের মতো আচরণ করছেন।

ইসলামপন্থীদের সঙ্গে হাসিনার অতীত খুনসুটি অজানা কিছু নয়। ২০০৬ সালে তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ধর্মভিত্তিক চারটি দলের সঙ্গে লিখিত চুক্তি করেছিলেন, এমনকি ফতোয়া বৈধ করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন — যদিও দলের ভেতরকার ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের বিরোধীতার মুখে তাকে সেই অবস্থান থেকে সরে আসতে হয়েছিল। আবার ২০১৩ সালে বিভিন্ন উগ্রপন্থী দাবিদাওয়া নিয়ে হেফাজতে ইসলাম দৃশ্যপটে আসার পর হাসিনার প্রশাসন কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনটির সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছায়। তারই ফলশ্রুতিতে তিনি “কওমি জননী” খেতাবেও ভূষিত হয়েছিলেন। কেউ কেউ একে রাজনৈতিক কলাকৌশলের অংশ বলে উড়িয়ে দিতে পারেন, কিন্তু হাসিনার সাম্প্রতিক কিছু কার্যকলাপ থেকে ইঙ্গিত মিলছে যে, তার কিছুটা মজ্জাগত পরিবর্তনও হয়েছে।

বাল্যবিবাহ নিয়ে তার অবস্থানের কথাই ধরা যাক। আওয়ামী লীগ সরকার আইন পাশ করে শর্তসাপেক্ষে ১৬ বছর বয়সী মেয়েশিশুদের আইনগতভাবে বিয়ে দেওয়ার সুযোগ করে দেয়। এভাবেই বিএনপি আমলের কষ্টার্জিত একটি সামাজিক সাফল্যকে ভেস্তে দিয়ে দেশকে উল্টোপথে ঠেলে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। শাসক দলের নেতারা কথায় কথায় বিএনপিকে মৌলবাদীদের দোসর আখ্যা দিতে কসুর করেন না। কিন্তু মেয়েশিশুদের বিয়ে দেওয়ার পক্ষে সংসদে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা জোরগলায় যেই বক্তব্য রেখেছিলেন, তা দেশের রক্ষণশীল মৌলবাদীদেরও লজ্জায় ফেলে দেবে।

ইদানীং হাসিনা বলাবলি করছেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি করতে দিলে, তাকে ক্ষমতায় রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের নাকি অসুবিধা হতো না। এই আলাপও নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতারও আগে ষাটের দশকে ভারতীয় ভাষ্যকাররা এই তত্ত্বের জন্ম দেন। সত্তর-আশির দশকে বাংলাদেশেও মাঝে মাঝেই এই তত্ত্ব চাউর হতো। কিন্তু কখনই এই বক্তব্যের পক্ষে নথিপত্র বা দালিলিক প্রমান হাজির করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে পড়ে হাসিনাই এখন এসব খেলো তত্ত্বকে মূলধারায় নিয়ে এসেছেন।

শুধু তাই নয়। কথিত পশ্চিমা চক্রান্তের মধ্যে তিনি ডানপন্থী গালগপ্পোও ঢুকিয়েছেন। সম্প্রতি এক রাজনৈতিক সভায় এক “শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি”কে উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মিয়ানমারের কিছু অংশ নিয়ে পূর্ব তিমুরের মতো নয়া খ্রিষ্টান রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা চলছে। আর এই চক্রান্তে সায় দিচ্ছেন না বলেই নাকি তার উপর যুক্তরাষ্ট্রের এত গোস্বা।

তার এসব উদ্ভট কথাবার্তাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়ার হয়তো কিছু নেই। তবে দেশের সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য এই বক্তব্য অত্যন্ত অপমানজনক। এই সম্প্রদায়ের অনেকেই আওয়ামী লীগের সমর্থক। অতীতে তাদের উপর সন্ত্রাসী হামলাও হয়েছে।

আর পূর্ব তিমুর যদি এত খারাপ রাষ্ট্রই হয়ে থাকে, তাহলে মুজিববর্ষ উদযাপনের সময় পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতার নায়ক ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি হোজে রামোস-হোর্তাকে আমন্ত্রণ জানালো কেন বাংলাদেশ সরকার? জাতিসংঘে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রপ্রধানদের সাক্ষাৎ না জুটলে এই হোজে রামোস-হোর্তার সঙ্গে বৈঠক করেই তো হাসিনার মুখ রক্ষা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লোভনীয় পদে নিজের মেয়ের প্রার্থীতায় সমর্থন দিতে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তার কাছে কেন পাঠিয়েছিলেন হাসিনা?

মূলত, পূর্ব তিমুর আর দক্ষিণ সুদানের উদাহরণ টেনে পার্বত্য চট্টগ্রামে কথিত খ্রিষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব জনপ্রিয় করেছিলেন বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দাদের ঘনিষ্ঠ কিছু ভাষ্যকার। এদের একজন সম্প্রতি লিখেছেন, তিনি দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে এই ষড়যন্ত্র নিয়ে কথা বলে এসেছেন; হাসিনার বক্তব্যে তার দীর্ঘ প্রচারণা যেন এক ধরণের স্বীকৃতি পেল।

এই তত্ত্বের মধ্যে ইহুদী-বিদ্বেষী উপাদানও রয়েছে। ভারতের মণিপুর ও মিজোরামের ক্ষুদ্র দুটি জাতিসত্ত্বার মানুষকে কেউ কেউ প্রাচীন ইহুদীদের হারিয়ে যাওয়া ১২টি গোত্রের অন্যতম বলে মনে করেন। মিজোরামের এই আদিবাসীরাও নাকি এই কল্পিত খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের বাসিন্দা হবেন। স্পষ্টতই হাসিনা এই বিষয়টি জানতেন। তাই এর মধ্যে তিনি আবার ফিলিস্তিনকেও টেনে এনেছেন।

বাংলাদেশে মধ্য-ডানপন্থী রাজনীতির প্রতিনিধি হলো বিএনপি, যাদের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে একজন জেনারেল ছিলেন। এমন আরেকটি দল হলো জাতীয় পার্টি, যাদের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও ছিলেন একজন সামরিক শাসক। জামায়াতে ইসলামীর মতো ইসলামপন্থী দলগুলোর লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রীয় নীতিতে প্রভাব বিস্তার করা। কিন্তু মধ্য-ডানপন্থী দলগুলোর বয়ান ছিল ভারত-বিরোধীতা কেন্দ্রিক। আর এই ভারত-বিরোধীতার অন্যতম অনুষঙ্গ হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম, যেখানে নব্বইয়ের দশকের পর থেকে তুলনামূলক শান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করা সত্ত্বেও সেনাবাহিনী তাদের অবস্থান ছেড়ে যায়নি। এই অব্যাহত সামরিক দখলদারিত্ব জায়েজ করতেই পাহাড়ে খ্রিষ্টান রাষ্ট্র সৃষ্টির তত্ত্ব মাঠে ছাড়া হয়। জনমনে মিথ্যা ত্রাস জিইয়ে রাখতে এভাবেই ভুয়া শত্রু তৈরি করা হয়। কিন্তু বিএনপির মতো দলও কখনও এসব কথিত চক্রান্তকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। গুটিকয়েক চরম ডানপন্থীদের মাঝেই এই তত্ত্ব এতদিন জনপ্রিয় ছিল। হেফাজতে ইসলামের কুখ্যাত ১৩ দফা দাবির একটি দাবির লক্ষ্য ছিল “পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে পশ্চিমা খ্রীস্টান [বিশ্বের] সুগভীর ষড়যন্ত্র” নস্যাৎ করা। এত লোক থাকতে শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার মাধ্যমেই এসব ছাইপাঁশ মূলধারায় প্রবেশ করলো।

তবে হাসিনা এই কথিত চক্রান্ত নিয়ে যা বলেছেন, সেটা যেমন আগ্রহোদ্দীপক, তেমনি যা বলেননি, সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের আদি সংস্করণের ভাষ্য হলো, মিজোরাম সহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় খ্রিষ্টান অধ্যুষিত রাজ্যগুলোও এই নয়া খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের অংশ হবে। কিন্তু হাসিনা নিজের বক্তব্যে ভারত নিয়ে টুঁ শব্দটিও করেননি। কারণ, সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে গিয়ে তিনি অনুগ্রাহক ভারত সরকারকে চটানোর ঝুঁকি নিতে চাননি।

আজ কল্পনা করাও কঠিন যে, শেখ হাসিনার সরকারই ১৯৯৭ সালে আদিবাসী জুম্ম বিদ্রোহীদের সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। যার ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে অপেক্ষাকৃত শান্তি নেমে আসে, আর সেনা উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তাও কমে যায়। বাংলাদেশে সামরিক প্রভাবের মোকাবিলা করতে গিয়ে হাসিনা তার রাজনৈতিক পুঁজির বড় একটি অংশ একসময় ব্যয় করেছেন। আমরা আজ সেই রাজনীতিকের এক দুঃখজনক অবনমন প্রত্যক্ষ করছি।

হাসিনাকে নিয়ে একটি মুখরোচক আলোচনা হলো, তার অনেক বিতর্কিত পদক্ষেপের নেপথ্যে নাকি রয়েছে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার না পাওয়ার হতাশা। তিনি ১৯৯৭ সালে সামরিক গোষ্ঠী আর তৎকালীন ডানপন্থী শিবিরের বিরাগভাজন হয়ে শান্তি চুক্তি করেছিলেন। বিশ বছর পর সাড়ে সাত লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশে প্রবেশ করার অনুমতিও দিয়েছিলেন। বিনিময়ে শেখ হাসিনা হয়তো নোবেল শান্তি পুরষ্কার প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু “শ্বেতাঙ্গ” পশ্চিমা সমাজ ও সরকারগুলোর কাছ থেকে আকাঙ্ক্ষিত স্বীকৃতি না পেয়ে তিনি এখন ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছেন — এমনটা বললে অত্যুক্তি হবে না।●

netra news

Exit mobile version