কুষ্টিয়ায় পাথর দিয়ে নির্মানাধীন শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তির নাক, মুখ ও হাতের বেশিরভাগ অংশ মাত্র ৮ মিনিটে ভেঙে ফেলার ঘটনাটি অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যাদের হেঁটে আসার প্যান শট ও ক্লোজড শট-এর ভিডিও আওয়ামী মূখপত্র গুলোতে প্রচার করা হয়েছে, তা নিয়ে জন্ম দিয়েছে অনেক সন্দেহ ও সংশয়ের। ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কুয়াশাছন্ন গভীর রাতে সাধারণ মানের স্থির সিসি ক্যামেরায় এমন পরিষ্কার প্যান শট ও ক্লোজড শটের ভিডিও একেবারেই অসম্ভব। কাছে থেকে কেউ ক্যামেরায় ভিডিও ধারণ করা ছাড়া এমন চিত্র কখনোই সম্ভব নয়।
তবে বাংলাদেশে নির্বতনমূলক বিভিন্ন কালাকানুনের ভয়ে এ বিষয়ে কেউ মুখ খুলতে নারাজ।
গত ৫ই ডিসেম্বর (শুক্রবার রাতের কোনো এক সময়) কুষ্টিয়া শহরের ব্যস্ততম পাঁচ রাস্তার মোড়ে শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তির ডান হাতের কিছু অংশ, পুরো মুখমণ্ডল ও বাঁ হাতের অংশবিশেষ ভেঙে ফেলা হয়। পরের দিন আওয়ামী মিডিয়া গুলোতে প্রচার করা হয়, নির্মান শ্রমিকরা সকালে এসে এই ভাঙ্গা দেখতে পেয়েছেন। এনিয়ে মেতে উঠে আওয়ামী প্রচার মাধ্যম গুলো। রাস্তায় নামেন আওয়ামী লীগের মূর্তি সংস্কৃতির সমর্থকরা।
পরের দিন একটি মাদ্রাসার দুই ছাত্র এবং শিক্ষককে গ্রেফতার করে পুলিশ। প্রচার করা হয় একটি ভিডিও। এতে দেখা যায় দুই ছাত্র খুব ধীরস্থিরে উপরে উঠছেন। তাদের গায়ে লম্বা পাঞ্জাবি এবং উপরে মুজিব কোট। আওয়ামী আদালতে উপস্থাপন করে তাদেরকে নেয়া হয় রিমান্ডে। সাজানো হয় আরেক নাটক। রিমান্ডের দ্বিতীয় দিনেই পুলিশ দাবী করেন, তারা স্বীকার করেছেন আল্লামা মামুনুল হক ও মওলানা ফয়জুল করিমের বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই মূর্তি ভেঙ্গেছেন।
এপরই মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামে তথাকথিত ভুইফোড় সংগঠনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদ্রোহ অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। এই সূত্রে আরো কয়েকটি মামলা হয় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের তিন নেতার বিরুদ্ধে।
শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি নির্মাণ-বিরোধী বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানোর কথিত অভিযোগ এনে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নেতা আল্লামা মুহাম্মদ মামুনুল হকের বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও মামলা করা হয়। বৃহস্পতিবারের মামলাটি করেন বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুল মালেক।
সোমবার মাওলানা মামুনুল হককে আসামি করে রাষ্ট্রদোহের মামলা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সভাপতি আবদুল মালেক ওরফে মশিউর মালেক। সোমবারের মামলার অপর আসামিরা হলেন- হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির জুনাইদ বাবুনগরী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির সৈয়দ ফয়জুল করিম।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, মূর্তির বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন দমাতেই সরকার স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় শেখ হাসিনার পিতার মূর্তি ভেঙ্গে এই নাটক তৈরী করেছে।
এনিয়ে এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন পটুয়াখালী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মওলা রনি।
এক ফেসবুক ভিডিওতে মূর্তি ভাঙ্গা নিয়ে নিজের সংশয় প্রকাশ করেন সাবেক এই সংসদ সদস্য।
ফেসবুক ভিডিওতে গোলাম মওলা রনি বলেন, ইট-পাথর দিয়ে যে শক্তিশালী ভাস্কর্য বানানো হয়েছে তা স্বল্প সময়ে ভাঙ্গা সম্ভব কি না এনিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ এতো অল্প সময়ে ইট-পাথর ভেঙ্গে রড বের করা সম্ভব না।
অপরাধ সংগঠনকালে দুর্বৃত্তদের মানসিক অবস্থা কেমন থাকা উচিত তার একটা ধারনাও দেন আওয়ামী লীগের সাবেক এই সংসদ সদস্য।
গোলাম মওলা রনি বলেন, যখন কেউ অপরাধ করে তখন তার মধ্যে চোর-চোর ভাব থাকে। এদিক-সেদিক তাকাবে। এবং তার হাত পা কাঁপতে থাকবে। কিন্তু, ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে তারা সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় বেশ কনফিডেন্ট ছিলেন। এতো কনফিডেন্ট থাকাটা প্রশ্নবিদ্ধ।
প্রচণ্ড শীতে অনেকটা স্বচ্ছ সিসি ফুটেজ নিয়ে যখন জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, তখন এর সাথে যুক্ত হয়েছে দুর্বৃত্তদের পরনের পোশাক বিতর্কও।
কুষ্টিয়ায় প্রচণ্ড শীতের বর্ণনা দিয়ে গোলাম মওলা রনি বলেন, মূর্তি এমন সময় ভাঙ্গা হয়েছে, যেদিন কুষ্টিয়াতে অনেক শীত। এই শীতে পাতলা পাঞ্জাবি আর কালো মুজিব কোট পরে মূর্তি ভাঙ্গতে গেছে দুর্বৃত্তরা!
গোলাম মওলা রনির বক্তব্যের রেশ ধরে কুষ্টিয়া সদরের একজন স্থানীয় অধিবাসী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যখন কেউ এমন মারাত্মক অপরাধ করতে যাবে তখন তার মধ্যে শীতার্ত ও ভয় কাজ করার কথা। কিন্তু ভিডিওতে দুর্বৃত্তদের বেশ আস্থাশীল মনে হয়েছে।
মূর্তির বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠা জনমত দমাতে এমন নাটক:
বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের দমন করতে ‘জঙ্গি’ তকমা সহ নানান ধরণের ট্যাগ ব্যবহার করে থাকে আওয়ামী ফ্যাসিবাদি সরকার। গত এক দশকে কখনও রক্তাক্ত উপায়ে, কখনওবা নিবর্তনমূলক নানা কালাকানুনের মাধ্যমে দমন করার অপচেষ্টা করা হয়েছে প্রতিপক্ষের কণ্ঠকে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে গুম ও ক্রসফায়ার। ফলে, সরকারের এসব ষড়যন্ত্র ও নাটকের বিষয়টি মানুষের কাছে পরিষ্কার। কিন্তু, এসব নিয়ে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চান না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুষ্টিয়া সদরের স্থানীয় একজন রাজনীতিবিদ বলেন, আইনের অপব্যবহারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকার ফুঁসে উঠা জনমত ঠেকাতে নিজেরাই মূর্তি ভেঙ্গে ইসলামপন্থীদেরকে দমনের মতো নোংরা খেলায় মেতে উঠেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের এমন কর্তৃত্ববাদী আচরণ রুখতে বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) বিবৃতিও দিয়েছে আন্তর্জাতিক ৭টি মানবাধিকার সংগঠন। তাদের বিবৃতিতে উঠে এসেছে আওয়ামী লীগ সরকার কীভাবে মানুষের বাকস্বাধীনতা হরণ করতে নিরাপত্তা বাহিনী ও বিভিন্ন কালাকানুনের ব্যবহার করছে।
গত এক দশকে সরকার ধারাবাহিকভাবে ডিজিটাল সুরক্ষা আইন-২০১৮, বিশেষ ক্ষমতা আইন -১৯৭৪ এবং অন্যান্য কঠোর আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করছে। এছাড়া নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমতের লোকদের গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ নানা নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের মত জঘন্য এসব কর্মকাণ্ডে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে।
সরকারের এই নোংরা খেলারই অংশ হিসেবে সবশেষ পাতলা জোব্বা ও কালো মুজিব কোট পড়িয়ে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে কুষ্টিয়ায় শক্ত মূর্তির বিভিন্ন অংশ মাত্র ৮ মিনিটের মধ্যে ভেঙে ইসলামপন্থীদের দমনের ক্ষেত্র তৈরী করা হয়েছে।
আর দমন-নিপীড়নে ব্যবহার করা হবে বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীকে।
নাটকে যেভাবে লাভবান হলো আ’লীগ:
মূর্তি নির্মাণের নামে ৯০% ভাগেরও বেশি মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে মূর্তির অবাধ প্রচার ও প্রসারে গত এক দশকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে ভারতীয় সংস্কৃতি প্রেমি আওয়ামী লীগ সরকার। একদিকে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি নির্মাণের মাধ্যমে বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রচলন, অন্যদিকে এসব নির্মাণ প্রকল্প থেকে জনগণের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। এসব মূর্তিপূজার প্রতিবাদে বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ইসলামী দল ও সংগঠন গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিবাদমুখর রয়েছে। বিশেষ করে হেফাজতে ইসলামের জোরালো ভূমিকায় মূর্তি-প্রেমী শেখ হাসিনার সরকার পড়েছে বেশ বেকাদায়।
ফলে প্রথমদিকে সরকারের নিচু স্তরের কয়েকজন মন্ত্রী-এমপিকে হেফাজতে ইসলামকে ঠেকাতে মাঠে নামায় শেখ হাসিনার সরকার। তারা আলেমদের ‘ঘাড় মটকে দেয়া’, ‘খেলা হবে’ টাইপের ভয়াবহ হুমকি দেয়। এরপর ছাত্রলীগের হিন্দু সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের প্ররোচনায় নামে এই ছাত্র সংগঠনটি। গত এক দশকে এই ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কখনও একা কখনওবা দলবেঁধে ধর্ষণ, ধর্ষণের পর ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, টর্চার সেলে নিয়ে মেধাবী ছাত্রদের নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা সহ অনেক অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ভাস্কর্য বিরোধী আন্দোলন শুরুর পর বিভিন্ন এলাকায় আলেমদেরকে হুমকি-ধামকি ও অপমানের নজিরও রয়েছে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। লেখক ভট্টাচার্যরা আলেমদেরকে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়ার হুমকি দেন। এরপর যুবলীগের কথিত ‘ক্লিন ইমেজের’ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস-ও নিজের আসল চেহারা উন্মোচন করে হুমকি-ধামকি দেন হেফাজতে নেতাদের। এখানেই শেষ নয়, যুবলীগ চেয়ারম্যানের ছোট ভাই শেখ ফজলে নূর তাপস, যিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, তিনিও আলেমদেরকে আফগানিস্তানে পাঠিয়ে দেয়ার মতো ফ্যাসিবাদী বক্তব্য দেন।
আর এসব নেতা-কর্মীদের বক্তব্যের পরই পাতলা জোব্বা-কালো মুজিব কোট পরিয়ে কুষ্টিয়ায় সাজানো হয় মূর্র্তি ভাঙার নোংরা খেলা। আর এ খেলায় পুতুলের মতো অংশ নেন স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও সরকারপন্থী গণমাধ্যমগুলো।
মূলত মূর্তি নির্মাণের বিরুদ্ধে জমে উঠা জনমতের কণ্ঠরোধ করতেই যে এ নাটক সাজানো হয়েছিলো তা এখন সেই রাতের বানানো ফুটেজের মতোই পরিস্কার!