শাওন শেখ
সাল ২০০২। গায়ানায় মুখোমুখি ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ। মাঠে নামার আগে তখনকার ভয়ংকর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে সামলাতে ভারতের ড্রেসিংরুমে গোল বৈঠক। স্বাভাবিকভাবেই বৈঠকের অনেকটা জুড়েই ছিলেন ব্রায়ান লারা। কীভাবে ব্রায়ান লারাকে থামানো যাবে সে প্রশ্ন ওঠাও স্বাভাবিক!
অদ্ভুতভাবে, সেদিন মাঠের লারাকে ফেরাতে ভারত বেছে নেয় ব্যাট-বলের বাইরের এক পথ। যে পথের নাম-‘ডোন্ট টক টু হিম’। অর্থাৎ লারা ব্যাটিংয়ে নামলে কেউ তাঁর সঙ্গে কোনো কথা বলবে না। লারাকে আউট করতে যিনি এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাঁর দাবি ছিল, কথা বললে বা স্লেজিং করলে লারা বরং সেটা উপভোগ করেন, তাতে তাঁর ব্যাটিংয়ে মনযোগ বাড়ে। কেউ কথা না বললে বরং তিনি বিরক্ত হয়ে আউট হয়ে যেতে পারেন।
লারা সেই টেস্টে একটাই ইনিংস খেলেছিলেন, করেছিলেন ১১ বলে ০ রান। কেউ তাঁর সঙ্গে কথা না বলার কারণেই কী লারা শূন্য রানে ফিরেছেন, তা নিশ্চিত হয়ে বলার উপায় না থাকলেও ভারতের এই মনস্তাত্ত্বিক কৌশলের প্রশংসা করতেই হয়।
মাঠে ব্যাট-বলের খেলা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই গুরুত্বপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক কৌশলের খেলা, পরিকল্পনা। যে খেলা শুরু হয় মাঠে নামার আগেই। ভারত কিংবা পরাশক্তি দলগুলো এই কৌশল ও পরিকল্পনাতেই এগিয়ে থাকে। আর বাংলাদেশ প্রতিনিয়তই হেরে চলে এই কৌশলের খেলায়। হেরে যায় মাঠের বাইরে!
এবারের জিম্বাবুয়ে সফরেই দেখুন না! টি–টোয়েন্টি সিরিজ হারের পর, ওয়ানডেও ২-০ ব্যবধানে পিছিয়ে থাকায় সিরিজ হেরে গেছে বাংলাদেশ। মাঠের বাইরের খেলাতেও তো বাংলাদেশ এই সিরিজে পিছিয়ে ২-০ ব্যবধানে!
কীভাবে?
তরুণদের নিয়ে গড়া টি–টোয়েন্টি দল জিম্বাবুয়ের বিমানে চড়ার আগে পূর্ণ সমর্থন পেয়েছে বোর্ড ও টিম ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকে। টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ সুজন তো বলেই গেছেন, ‘জিম্বাবুয়েতে যদি আমরা ৩-০ ব্যবধানে হেরেও যাই, তবু আমি বিন্দুমাত্র আপসেট হবো না। কারণ, আমি এই চাপ ওদের দিতেই চাই না। আমি চাই ওরা ফ্রিডম নিয়ে খেলুক, ফ্রি হয়ে খেলুক।’
মাহমুদ বলেছেন, ক্রিকেটাররা কোনো রকমে দলে জায়গা নিশ্চিত করার জন্য খেলেছেন। কিন্তু টিম ডিরেক্টর হিসেবে, এই সংস্কৃতি থেকে খেলোয়াড়দের বের করার দায়িত্ব তো তাঁরও। তিনি কিংবা টিম ম্যানেজমেন্ট সেই চেষ্টা করছেন কতটা?
অথচ সিরিজ হারের পর এই খালেদ মাহমুদ সুজনই হাঁটলেন ‘জনপ্রিয় পথে’। হতাশ হবেন না বলে জিম্বাবুয়েতে যাওয়া টিম ডিরেক্টর সিরিজ হারার পর গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বললেন—এই হারে তিনি ভীষণ হতাশ, পুরো দোষ দিলেন ক্রিকেটারদের ওপর।
মাঠের খেলায় ক্রিকেটারদের ভুল থাকতেই পারে। জিম্বাবুয়েতেও ক্রিকেটাররা সেই ভুল করেছেনও। তবে সেটা নিয়ে ওদের সমালোচনা করার জায়গা সংবাদমাধ্যম নয়, ড্রেসিং রুম বা দলের ভেতরে। মাহমুদ বলেছেন, ক্রিকেটাররা কোনো রকমে দলে জায়গা নিশ্চিত করার জন্য খেলেছেন। কিন্তু টিম ডিরেক্টর হিসেবে, এই সংস্কৃতি থেকে খেলোয়াড়দের বের করার দায়িত্ব তো তাঁরও। তিনি কিংবা টিম ম্যানেজমেন্ট সেই চেষ্টা করছেন কতটা? সিরিজের আগে পূর্ণ সমর্থন আর সিরিজ হারের পরেই কাঁধের ওপর থেকে ভরসার হাত তুলে নেওয়া, এটা কী মাঠের বাইরের পরাজয় নয়?
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে ঘটেছিল আরও এক অদ্ভুত কাণ্ড। মাহমুদউল্লাহকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর বাজে পারফরম্যান্সের কারণে দল থেকেও বাদ দেওয়া হলো। নতুন যাঁকে অধিনায়ক করা হলো, সেই নুরুল হাসান হঠাৎ চোটে পড়ায় ওই মাহমুদউল্লাহকেই আবার দলে নেওয়া হলো। কিন্তু অধিনায়ক করে নয়।
যে মাহমুদউল্লাহকে ছাড়াই জিম্বাবুয়ের সফরের টি–টোয়েন্টিতে রণকৌশল সাজানো হলো, এমন কি ঘটে গেল, যে কারণে আবার সেই সিরিজের দলেই তিনি! আর দলে যদি থাকবেনই, তাহলে কেন অধিনায়ক হিসেবে নয়! কেন কখনো জাতীয় দলের নেতৃত্ব না দেওয়া মোসাদ্দেক হোসেনকে হঠাৎ করে এক ম্যাচের জন্য নেতৃত্ব দেওয়া হলো? অথচ বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান সিরিজ শুরুর আগে বারবার বলেছেন, ‘মাহমুদউল্লাহর নেতৃত্বে কোনো সমস্যা দেখছি না।’
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি টোয়েন্টি সিরিজে বিসিবি জয়-পরাজয়ের চিন্তা ভুলে পণ করেছিল তারুণ্যের শক্তি পরীক্ষার। হঠাৎ সেখানে কেন মাহমুদউল্লাহর সংযুক্তি? অর্থাৎ দুটি টি–টোয়েন্টির পরেই নিজেদের চিন্তা থেকে সরে গেছে বিসিবি। পরিকল্পনা করে সেই পরিকল্পনা থেকে সরে এসে বোর্ড নিজেই কী নিজেদের ভুল প্রমাণ করেনি?
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ দলের বড় অর্জন দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ওয়ানডে সিরিজ জয়। টেস্টে যদিও নাকানিচুবানি খেয়েছিল বাংলাদেশ, তারপরও সে সফরে সুখস্মৃতি কম নয়। সেই সফরের দিকে ফিরে তাকালেও মাঠের বাইরে কয়েকবার বাংলাদেশের হারের গল্প মনে পড়বে।
উদাহরণ হিসেবে দুটি ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসা যাক।