Site icon The Bangladesh Chronicle

শুধু কূটনীতি দিয়ে কি রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব

Over 15,000 Rohingyas have fled their burning villages each day. Image: Adam Dean | The New York Times

সাঈদ মাসুদ রেজা

প্রতিবেশী দেশে যুদ্ধ শুরু হলে তা একই সঙ্গে শঙ্কার ও সুযোগের। বিশেষত এমন প্রতিবেশী দেশ, যারা তাদের সমস্যার এক বিরাট অংশকে অন্য দেশের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে সমস্যার মীমাংসা করতে গেলে শুধুই কূটনীতি বা আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে কথা বললে বা প্রচেষ্টা চালালে তা মীমাংসা হয়ে যাবে, এমন মনে না করাই শ্রেয়।

বলছিলাম মিয়ানমারের কথা। দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। আইনত মিয়ানমার তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করেনি। এই অস্বীকারের রাজনীতিতে বাংলাদেশকেও জড়িয়ে ফেলা হয়েছে।

কোনো ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীকে নাগরিকত্ব দেওয়া বা না দেওয়া একটি দেশের একেবারেই অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন বা সে অর্থে আন্তর্জাতিক রাজনীতি তেমন কিছুই করতে পারে না। এই জায়গায় পাশের দেশ হিসেবে আমাদের তেমন কিছু করার সুযোগ নেই।

কিন্তু রোহিঙ্গারা নৃতাত্ত্বিকভাবে একটি ভিন্ন জনগোষ্ঠী, যারা আরাকানে হাজার বছর ধরে বাস করছে। মিয়ানমার যে এদের বাঙালি বলে চালাতে চাইছে, সেই যুক্তির পাল্টা হিসেবে আমরা কি কখনো কোনো বড় মানের গবেষণা করেছি?

যা আমাদের প্রতিযুক্তিগুলোকে খুব শক্ত ভিত্তি দিতে পারে। গবেষণালব্ধ যুক্তি যেকোনো তাৎক্ষণিক পাল্টা যুক্তির চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ও তথ্যসমৃদ্ধ হয়। এ বিষয়ে আমাদের মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় থেকে বাংলাদেশ ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’—এই পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে আসছে। এই নীতিতে অটল থেকেই বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতিতে কিছুটা পরিমার্জন করতে পারে। বস্তুত মিয়ানমারে বিবদমান কোনো পক্ষই আমাদের শত্রু নয়; যদিও এদের নিজেদের মধ্যে শত্রুতা এবং কারও কারও মধ্যে কৌশলগত বন্ধুত্বও আছে। মিয়ানমারের যে পক্ষ বা যারা রোহিঙ্গা প্রশ্নে আমাদের চিন্তাগুলোকে ধারণ করবে বা কাছাকাছি থাকবে, তাদের সঙ্গে আলাপ শুরু করার চিন্তা করা যেতে পারে।

মনে রাখা উচিত, যদিও এখন বিভিন্ন পক্ষ এখন জান্তা সরকারের সঙ্গে যুদ্ধরত, এই পক্ষগুলোর অনেকগুলোই একসময় মিয়ানমার সরকারের প্রকাশ্য অথবা প্রচ্ছন্ন স্বীকৃতি পেয়েছে।

রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ মিয়ানমারের তুলনায় বহু দিক থেকে এগিয়ে আছে। পারস্পরিক সম্পর্কের প্রশ্নেও আমরা মিয়ানমারের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল নই। যদিও একই কথা তাদের বেলায়ও খাটে। তাই মিয়ানমারের সঙ্গে আলাপে আমাদের হারানোর কিছু নেই। বরং বন্ধুত্ব বজায় রেখে কৌশলগত একটি অবস্থান নিলে তাতে ভবিষ্যতে সমাধানের নানা পথ খুলে যেতে পারে।

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে একটি বড় মানবিক কাজ করেছে। ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে। তাদের পেছনে বাংলাদেশকেও প্রতিবছর অনেক ব্যয় করতে হচ্ছে। বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার জনগণের কাছে রোহিঙ্গা ইস্যুটি এখন রাজনৈতিক আবেদন হারিয়েছে। দেশের মানুষ এই সমস্যার একটি টেকসই সমাধান চায়। এই সমস্যার আশু সমাধান হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু সমাধানের একটি কার্যকর শুরু সম্ভব।

এটি বোঝা জরুরি যে মিয়ানমারের বিবদমান পক্ষগুলোর ব্যাপারে আমরা নিরপেক্ষ থাকতে পারি, অথবা না–ও থাকতে পারি।

আমাদের অবস্থান যা–ই হোক না কেন, ওই দেশের যুদ্ধরত পক্ষগুলোর মধ্যে কে বা কারা রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নিয়ে আমাদের কাছাকাছি চিন্তা লালন করে আর কারা সেটা করে না—এটা এত দিনে আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। যারা আমাদের মতের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল, তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন নেমে আলাপ শুরু করার মধ্যে কোনো দোষ দেখি না, বরং এটা জরুরি। বিশেষত যখন সেখানে রাজনীতির গতির পরিবর্তন হচ্ছে।

এই পরিবর্তন ভবিষ্যতের যে মিয়ানমারকে তৈরি করছে, সেখানে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করা, বিশেষত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা একটি অপরিহার্য কাজ। মিয়ানমারের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান রেখেই বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হওয়া সম্ভব।

সে ক্ষেত্রে একটি পথ হচ্ছে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ না করে ওই দেশের রাজনৈতিক মতামতকে প্রভাবিত করার উপায় খোঁজা। আমাদের মনে রাখতে হবে যে রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের একটি পুরোনো রাজনৈতিক সমস্যা।

এই সমস্যার টেকসই সমাধান করতে হলে রোহিঙ্গাবিরোধী বা তাদের প্রত্যাবাসনবিরোধী যে রাজনীতি মিয়ানমারে কয়েক দশক ধরে সক্রিয় (বিপুল জনসমর্থনও রয়েছে), সেই রাজনীতির বাঁকগুলো আমাদের বোঝা দরকার। পাশাপাশি সেই রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারাও জরুরি।

সহজ কথায় যে সমস্যার গোড়া ও বৈধতা একটি দেশের রাজনীতির গভীরে প্রোথিত, সেই সমস্যার টেকসই সমাধান কেবল রাষ্ট্রপর্যায়ে আলাপ চালিয়ে হবে না। আমরা রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চাইলে এর সম্ভাব্য উপায়গুলো নিয়ে আমাদের ভাবনা ও কাজ চালিয়ে যেতে হবে।

● সাঈদ মাসুদ রেজা সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

prothom alo

Exit mobile version