Site icon The Bangladesh Chronicle

লুট হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ

লুট হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ – নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশে চার দিকে নাগিনীরা ফেলছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস। এখন যে যেখানে পারছে লুট করে নিচ্ছে জনগণের সম্পদ। শক্তিমানরা ওঁৎ পেতে আছে, কোথায় ফোকর পাওয়া যায়। ফোকর না থাকলে নিজেরাই ফোকর বের করে নিচ্ছে। লাখ লাখ টাকা থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যাচ্ছে। কোথায়ও কেউ কিছু আটকাচ্ছে না বা আটকাতে পারছে না।

আগের দিনে কেউ লাখ টাকার মালিক হলে সেটি আলোচনার বিষয় হতো। এখন লোকে কোটি টাকা তো ‘সামান্য’, হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়। বর্তমান বাংলাদেশে তারা সবাই হাজার কোটি টাকার মালিক দুর্নীতির মাধ্যমে, প্রতারণার মাধ্যমে, সাধারণ মানুষকে শোষণ করে অথবা ঠকিয়ে। আগের দিনে অবৈধ বা কালো টাকার ব্যাপারে সরকার কঠোর ছিল, এখন বড় নরম। দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা উপার্জন করে ১০ শতাংশ কর দিলেই সে টাকা বৈধ হয়ে যায়। সরকার সে টাকার উৎস খোঁজে না। এক মন্ত্রীকে ক’দিন আগে বলতে শুনলাম, ‘আগে অর্থনীতির আকার ছোট ছিল, দুর্নীতিও কম ছিল। এখন অর্থনীতির আকার বড় হয়েছে, দুর্নীতির সাইজও বড় হয়েছে।’ অর্থাৎ দুর্নীতিকে একটা যৌক্তিক ভিত্তি দেয়ার সরকারি প্রয়াস এটা। এ রকম আগে কখনো দেখা যায়নি।

সরকারের ঘনিষ্ঠজনরা ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে সে ঋণ আর পরিশোধ করতে চান না। ঋণ বারবার পুনঃতফসিল করে নেন। ফলে যে টাকা দেয়ার কথা, তা-ও দেন না। তার ওপর আবার জাদুমন্ত্র বলে নতুন ঋণ গ্রহণ করেন তারা। সরকারের তরফে যুক্তি আছে। নতুন ঋণ না দিলে তারা পুরনো ঋণ শোধ করবেন কী করে? ফলে ঋণের ফর্দ লম্বা হতে থাকে। একসময় ব্যাংকগুলো হাজার হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের চাপে পড়ে। ঋণখেলাপি বাড়ে। জেল দিয়ে তো আর টাকা আদায় হয় না। এ দিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ফোকলা হতে হতে দেউলিয়া হয়ে যায়।

লুটের আরেক ফন্দি, ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। সরকারের মন্ত্রী বা সরকারঘনিষ্ঠরা ব্যাংকের লাইসেন্স পান। কাগজ-কলমে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার কতকগুলো নিয়ম-নীতি আছে। কিন্তু সরকারঘনিষ্ঠরা সে নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না। পরিবারের ক’জন পরিচালক থাকতে পারবেন, তার একটা বিধান আছে। তা কঠোরভাবে প্রয়োগ না করে বরং লুটেরাদের অনুকূলে সংশোধন করা হয়। এ এক আজব বিচার। সাবেক এক মন্ত্রী দিয়েছিলেন ফার্মার্স ব্যাংক। বছর দুয়েকের মধ্যে লুটতরাজের ফলে সেটি দেউলিয়া হয়ে যায়। এখন নতুন নামে সরকারকে সেটি চালাতে হচ্ছে। বহু নতুন ব্যাংকে টাকা জমাকারীরা টাকা তুলতে গিয়ে বিপাকে পড়েন। টাকা নেই। পরে আসুন। এমনি অবস্থা। এর মধ্যেও সরকার তার ঘনিষ্ঠদের ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়েই যাচ্ছে। ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক সাক্ষীগোপালে পরিণত হয়েছে। ব্যাংকে জালিয়াতি ও দুর্নীতি রোধ করার বদলে, বাংলাদেশ ব্যাংক যেন তা চাপা দিতেই সচেষ্ট। তাদের নজরদারির ব্যবস্থাও ভঙ্গুর ও দুর্নীতিগ্রস্ত। সেখানে সর্ষের ভেতরে ভূত। ফলে লুটতরাজ চলছে। এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে দু-একটা লোক-দেখানো আটক ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা নেই। যে যত বড় লুটেরা, সে তত বড় প্রভাবশালী। তার টিকিটি স্পর্শ করার ক্ষমতা কারো নেই। এভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা তসরুপ হচ্ছে, হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।

মাঝে মাঝে লোক দেখাতে সরকার হুঙ্কার দেয়, পাচার হয়ে যাওয়া টাকা ফেরত আনা হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। তবে এর সবই ‘বাতকে বাত’। টাকা একবার দেশের বাইরে চলে গেলে সে টাকা ফেরত আনা প্রায় অসম্ভব। ফেরত আনার অনুল্লেখযোগ্য নজির আছে মাত্র। টাকা পাচার করে সরকারঘনিষ্ঠরা বিদেশে বাড়ি-গাড়ি ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। বউ-ছেলে-মেয়েরা সেখানে থাকে। কানাডায় বসতি গড়ে উঠেছে বাংলাদেশী টাকা পাচারকারীদের- তার নাম বেগম পাড়া। সাহেবরা বাংলাদেশে থেকে টাকা পাচার করেন, বেগম সাহেবরা তা ভোগ করেন। সরকার এর জন্য এ পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বা নিতে পারেনি।

সরকার উন্নয়ন উন্নয়ন জপতে জপতে আমাদের অস্থির করে ফেলেছে। কিন্তু উন্নয়নের অর্থ পরিবর্তিত হয়ে গেছে। ‘উন্নয়ন’ মানে যেন লুট, দুর্নীতি। এটি এখন সর্বব্যাপী সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। এটি বিস্তৃত নিম্ন থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত। কিন্তু কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই। ধরা যাক, খুব সামান্য কাজের কথা। স্কুলের ছাদ নির্মাণ, টয়লেট নির্মাণ, ছোটখাটো সড়ক নির্মাণ- এসব জায়গায়ও হচ্ছে ব্যাপক দুর্নীতি-জালিয়াতি। রডের বদলে দেয়া হচ্ছে বাঁশের ‘খাবাচি’ কিংবা কঞ্চি।

ঠিকাদার আওয়ামী লীগের কোনো পাতি নেতা। ফলে হয় সেভাবেই কাজ করতে দেয়া হচ্ছে, নইলে গলা ফুলিয়ে বলা হচ্ছে, ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা এ পর্যন্ত এ ব্যাপারে সরকারকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখিনি। এ জন্য কারো কোনো শাস্তি হয়েছে বলে শুনিনি। ফলে নির্মাণ কাজে রডের বদলে বাঁশের ব্যবহার অব্যাহত আছে। সরকার হয়তো একসময় বলবে, এতে কোনো ক্ষতি নেই। বাঁশ দেশীয় সম্পদ ও যথেষ্ট মজবুত। তাই রডের বদলে ভবন নির্মাণকাজে বাঁশ ব্যবহার করা যাবে। সড়ক ভেঙে যাবে। অসুবিধা কী? আবার সড়ক নির্মাণ করা হবে, ওই বাঁশ বা কঞ্চি দিয়ে। স্কুল ঘর ভেঙে পড়বে। অসুবিধা কী? মরলে তো মরবে গরিবের ছেলেমেয়েরা। তাতে ঠিকাদারের কী? এখন অপরাধীর শাস্তি হয় না। বরং তারা আরো বড় পদে আসীন হন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করতে গিয়ে ছাত্রলীগ থেকে যিনি বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, তিনি এখন যুবলীগে ঠাঁই পেয়েছেন। কেন তাদের সাজা হলো না? কেন তারা পুরস্কৃত হলেন? কখনো কখনো মনে হয়, এটাই বুঝি সরকারের নীতি। যে যত বড় চোর, তার আসন উঠবে তত উপরে।

প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার জাদু দেখিয়ে দিয়েছেন। যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে তিনি ছিলেন সেখান থেকে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা কানাডায় পাচার করে তিনি সেখানে পালিয়ে গেছেন। এক দিনে তিনি এ কাজ করেননি বা করতে পারেননি। আর একাও করেননি এ কাজ। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা তাকে এ কাজে সহায়তা করেছেন। তার বিরুদ্ধে তদন্ত ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। যারা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের কথা শোনা যায়নি। ডাক বিভাগের মহাপরিচালক শ্রী ভদ্র মেরে দিয়েছেন সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা। কখনো কখনো এসব লোককে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়, কিন্তু সাজা হয় না। ফলে দুর্নীতির বিশাল গ্রাস দেশটাকে গিলে খেতে উদ্যত।

আমাদের স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি কিংবদন্তি তুল্য। কোভিডের বহু আগে থেকেই এ খাতে মহাদুর্নীতি চলে আসছে। কোভিড আসার পর তা শত সহস্র গুণে বেড়েছে। মাস্ক কেনায় দুর্নীতি, গ্লাভস কেনায় দুর্নীতি, পিপিইতে দুর্নীতি, যন্ত্রপাতি কেনায় দুর্নীতি। ৫ টাকার মাস্ক ৩০০ টাকায়ও কেনা হয়েছে। যন্ত্রপাতি কেনায় দুর্নীতি। শুধু কার্টন সরবরাহ করা হয়েছে। ভেতরে কোটি কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রটিই নেই। কোভিড টেস্টে জালিয়াতি। চিকিৎসায় ডাকাতি- কী হচ্ছে না স্বাস্থ্য খাতে? আমরা দেখেছি প্রতারক সাহেদ ও ডা: সাবরিনার গ্রেফতার; আর কোথাও তেমন কোনো কুটোটিও নড়েনি। কিন্তু কঠোর শাস্তি না হলে দুর্নীতি তো থামবে না। আর দুর্নীতি দূর না করতে পারলে শত চেষ্টায়ও দেশ এগোবে না। আমরা যদি শুধু মুখে বলতে থাকি যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান ‘জিরো টলারেন্স’, তাতে কোনো কাজ হবে না। পৃথিবীর যেসব দেশ দ্রুত উন্নতি করেছে, তাদের সবাইকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হয়েছে; সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, চীন- যার কথাই বলি না কেন। সুতরাং দেশের উন্নয়নে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

Exit mobile version