Site icon The Bangladesh Chronicle

লাউড স্পিকারে আজানের বিরোধিতার নেপথ্যে

লাউড স্পিকারে আজানের বিরোধিতার নেপথ্যে – প্রতীকী ছবি


রাম নবমী থেকে শুরু করে হনুমানজয়ন্তী চলাকালীন যেসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো পুরো জাতিকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছে। পুরো জাতির ওপর প্রভাব বিস্তারকারী এসব ঘটনা মারাত্মক ভয়ঙ্কর। বিদ্বেষের বুলডোজার শুধু কিছু ঘরবাড়ি ও দোকানপাট ধ্বংস করেনি, বরং ভারতের সাংবিধানিক বিধিবদ্ধতাকেও ধ্বংস করে দিয়েছে। যে মুহূর্তে জাহাঙ্গীরপুরিতে মিউনিসিপ্যালিটির কার্যক্রম ও বুলডোজারের অভিযানে সৃষ্ট ক্ষত তরতাজা হয়ে আছে, ঠিক সে সময় আরো একটি বিতর্ক ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ওই বিতর্কটি শুরু করা হয়েছে মসজিদের লাউড স্পিকার (মাইক) নিয়ে। এ ধরনের বিতর্ক মূলত নষ্ট রাজনীতির একটি অংশ। যেখানে লাউড স্পিকারের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন, সেখানে বেশির ভাগ মুসলিম গ্রুপ আদালতের নির্দেশনা মেনে চলছে।

পক্ষান্তরে বিজেপি ও এমএনএস (রাজঠাকরে) সাম্প্রদায়িকতার নোংরা পথে চলছে। তারা হুমকি দিয়ে বলেছে, যদি মসজিদগুলো থেকে লাউড স্পিকার না সরানো হয়, তাহলে তারা বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে মসজিদের সামনে হনুমান চালিশা পাঠ করবে। এমএনএস নেতা রাজঠাকরে মহা আরতির প্রাক্কালে এ হুমকি দিয়েছেন। যা বাবরি মসজিদ শহীদ হওয়ার পর মুম্বাই দাঙ্গার (১৯৯২-৯৩) প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। হনুমান চালিশাকে এখন নষ্ট রাজনীতির হাতিয়ার বানানো হয়েছে। একটি ভালো দিক এই যে, মহারাষ্ট্র প্রশাসন লাউড স্পিকারের মাধ্যমে আজান দেয়াকে কেন্দ্র করে যারা ইস্যু তৈরি করেছে, তাদের সাথে বিষয়টি নিষ্পত্তির চেষ্টা করেছে। সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে এ সমস্যার সমাধান করার উত্তম চেষ্টা করেছে। কিন্তু ওই সর্বদলীয় বৈঠক বয়কট করে বিজেপি তার অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে।

অন্যদিকে রাজঠাকরেও প্রাদেশিক রাজনীতিতে নিজের জায়গা তৈরির সুযোগ তালাশ করছেন। এ কারণেই তিনি এই ইস্যুকে জোরালো করেছেন। হনুমান চালিশার ইস্যুতে আইনশৃঙ্খলার সঙ্কট তৈরির কারণে বিজেপি নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। বিজেপি জেনে বুঝে মহারাষ্ট্রে আজানকে ইস্যু বানাচ্ছে এবং রাজঠাকরেকে সমর্থন করছে। গত কয়েক সপ্তাহে বিদ্বেষের যে নিকৃষ্টতর ঢেউ সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে এবং বিদ্বেষ যে ধ্বংসাত্মক স্তরে পৌঁছে গেছে, সবাই তা স্পষ্টরূপে দেখেছেন। দ্য কাশ্মির ফাইলসের মতো সিনেমা বিদ্বেষের বর্ধিষ্ণু স্তরগুলো বাড়িয়ে দিয়েছে। এটি এমন এক সিনেমা, খোদ রাষ্ট্র যার পৃষ্ঠপোষকতা করছে। কেননা, রাষ্ট্র এই সিনেমাটি করের আওতামুক্ত করে দিয়েছে।

অন্যদিকে, বিজেপি নেতারা দ্য কাশ্মির ফাইলস সিনেমা দেখার জন্য জনগণকে উৎসাহ জোগাচ্ছে। কয়েকটি স্থানে বিজেপি নেতারা সিনেমার টিকিট কিনে নিয়ে সেগুলো জনগণের মাঝে বিতরণও করেছে। ওই সব মানুষ এই সিনেমার সমালোচনা করছে, যাদের বিরুদ্ধে বিজেপি ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো মুক্তমনা হওয়ার লেবেল লাগিয়ে দিয়েছে। এখন মুক্তমনা শব্দ ওই সব হিন্দুকে তুচ্ছ করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে, যারা রাজনীতিকে ধর্মের সাথে যুক্ত করার ঘোর বিরোধী এবং ভারতের গঙ্গা-যমুনা সংস্কৃতি ও তার চিরাচরিত ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রাখতে আগ্রহী। এখানে দেখানো হয়েছে ইসলামী মৌলবাদের কারণে ভারতের সেক্যুলারিজম মারাত্মক হুমকিতে রয়েছে। বিতর্কিত কাশ্মির তার প্রমাণ।

বিস্ময়ের কথা হচ্ছে, রবি শঙ্করসহ আরএসএস নেতা মোহন ভগত, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ বলে দ্য কাশ্মির ফাইলস সিনেমার প্রশংসা করেছেন যে, এ সিনেমাটি সত্য দেখাচ্ছে। এই সিনেমার নির্মাতা অগ্নিহোত্রি স্বয়ং বলেন, এটি শুধু একটি সিনেমা তৈরিই নয়, বরং এটি তার একটি অ্যাজেন্ডা।
বাস্তবিকপক্ষে ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যায়, বিবেক অগ্নিহোত্রির সিনেমা সমাজকে নেতিবাচক দিকে ঠেলে দিয়েছে, এটি অবাক হওয়ার কিছুই নয়। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে সংঘটিত অপ্রীতিকর ঘটনাবলি থেকে তার অনুমান করা যেতে পারে। বামপন্থীদের মুক্তমনা নেতারা সিনেমার নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে বেশ চিন্তিত। তাদের বক্তব্য, এই সিনেমায় অর্ধসত্য দেখানো হয়েছে এবং ঘটনাগুলোকে একতরফা উপস্থাপন করা হয়েছে। ওই ঘটনাগুলোকে নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কাশ্মিরে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা ১৯৫০-এর দশকে শুরু হয়েছিল। কিন্তু এর সাথে মৌলবাদ বা মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার কোনো সম্পর্ক ছিল না। বরং কাশ্মিরের স্বায়ত্বশাসন নিষ্পেষিত করার কারণে আলাদা হওয়ার প্রতি ঝোঁক বাড়তে শুরু করেছে।

অথচ সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫/এ ধারাবলে কাশ্মিরের জনগণকে স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো, স্বাধীনতাকামীরা শুরুতে এটিকে কাশ্মির জাতীয়তাবাদ নাম দিয়েছিল। মোটকথা, দ্য কাশ্মির ফাইলস মুসলমানদের কাশ্মিরের পরিস্থিতির জন্য দায়ী করেছে। অথচ কাশ্মিরি পণ্ডিত ও বর্তমান পরিস্থিতির জন্য জগমোহন ও বিজেপির সহায়তাপ্রাপ্ত ভিপি সিং সরকার দায়ী। এই সিনেমায় কাশ্মিরি মুসলমানদের পেরেশানি, দুর্দশা, যন্ত্রণা ও বিপদ উপস্থাপন করা হয়নি। এ কথাও বলা হয়নি যে, ৫০ হাজারের অধিক মুসলমানকে কাশ্মির ছাড়তে হয়েছে। আজ বিজেপি ও তার সমমনা দলগুলো উপত্যকায় কাশ্মিরিদের হত্যা ও তাদের বের করে দেয়া নিয়ে চিৎকার করছে। তাদের এ কথা ভোলা উচিত নয় যে, কাশ্মির উপত্যকায় শুধু ৮৯ জন পণ্ডিত মারা যাননি, বরং সেখানে সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত মুসলমান ও অন্য ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যা এক হাজার ৬৩৫ জন।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক উর্দু টাইমস ১১ মে, ২০২২ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Exit mobile version