রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার পর থেকে পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে৷ গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের উখিয়ার লাম্বাশিয়া আশ্রয়কেন্দ্রের ডি-ব্লকে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) নামের সংগঠনের কার্যালয়ে বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন তিনি৷ তিনি ছিলেন ওই সংগঠনের চেয়ারম্যান৷ তিনি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন৷ তাকে হত্যার পর ফিরে যাওয়ার বিরোধী গ্রুপগুলো শক্তি সঞ্চয় করেছে৷
এই হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়েছে কক্সবাজার আদালতে৷ কিন্তু ২৯ আসামির ১৪ জন এখনো পলাতক৷ মুহিবুল্লাহর পরিবারের সদস্যরা কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে ক্যানাডায় আশ্রয় নিয়েছেন৷
এই হত্যাকাণ্ডের আসামিদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা বলে পুলিশ জানিয়েছে৷ মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর ক্যাম্পে নানা সন্ত্রাসী গ্রুপ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বলে স্থানীয় সূত্র জানায়৷ সেখানে এখন কমপক্ষে আটটি সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় আছে৷ আর অপরাধ ঠেকাতে সক্রিয় আছেন মাঝিরা৷
অপরাধের পরিসংখ্যান
কক্সবাজার জেলা পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২০ আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২ ধরনের অপরাধে মোট দুই হাজার ৪৩৮টি মামলা হয়েছে৷ এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা পাঁচ হাজার ২২৬ জন৷ এই পাঁচ বছরে অস্ত্র উদ্ধার মামলা ১৮৫টি, মাদক উদ্ধার মামলা এক হাজার ৬৩৬টি, ধর্ষণ মামলা ৮৮টি, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় বা আদায়ের চেষ্টার মামলা হয়েছে ৩৯টি৷ পাঁচ বছরে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ১১০টি৷ হত্যা মামলা হয়েছে ১০০টি৷ জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে ছয়টি৷
হত্যা ছাড়া আরো যেসব অপরাধে মামলা হয়েছে তার মধ্যে আছে অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ, বিশেষ ক্ষমতা আইন, ডাকাতি বা ডাকাতির প্রস্তুতি, মানব পাচারসহ ১২ ধরনের অপরাধ৷ এর মধ্যে গত আগস্ট পর্যন্ত মাত্র এক বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২ ধরনের অপরাধে মামলা হয়েছে এক হাজার ১৪০টি৷ এই সময়ে অস্ত্র উদ্ধার ৯৮টি, মাদক উদ্ধার ৮৭৪টি, ধর্ষণ ২৩টি ও হত্যা মামলা হয়েছে ৩০টি৷
চার মাসে ১৫ খুন
গত চার মাসেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৫ টি খুনের ঘটনা ঘটেছে৷ আর অধিকাংশ খুনের শিকার হয়েছেন ক্যাম্পভিত্তিক ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতা (মাঝি) ও স্বেচ্ছায় পাহারারত স্বেচ্ছাসেবক৷
আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)-এর তথ্য মতে, ২২ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ এরশাদ নামের একজন স্বেচ্ছাসেবক খুন হন৷ ২১ সেপ্টেম্বর খুন হন মোহাম্মদ জাফর নামের এক নেতা৷ ১৮ সেপ্টেম্বর খুন হন আরেক স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ ইলিয়াস৷ ৯ আগস্ট দুই রোহিঙ্গা নেতা, ৮ আগস্ট টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক স্বেচ্ছাসেবক খুন হন৷ ১ আগস্ট একই ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক নেতা মারা যান৷ গত ২২ জুন কথিত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ নেতা মোহাম্মদ শাহ এবং ১৫ জুন একই গ্রুপের সদস্য মো. সেলিম (৩০) গুলিতে নিহত হন৷ ৩ মে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানা উল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬)৷ পুলিশ জানায়, ক্যাম্পে রোহিঙ্গারাই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করছে৷ এই স্বেচ্ছাসেবকরাই এখন সন্ত্রাসীদের টার্গেটে পরিণত হচ্ছেন৷ তবে উখিয়া-টেকনাফের ৩২ টি ক্যাম্পে আমর্ড পুলিশ ব্যাটেলিয়নের তিনটি ইউনিট নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে৷
কেন এই পরিস্থিতি?
কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালি ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, ‘‘ক্যাম্পগুলোতে এখন প্রধান চারটিসহ ৮-১০টি সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় আছে৷ তাদের মধ্যে ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ ও মাদক বিশেষ করে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ে ব্যাপক দ্বন্দ্ব রয়েছে৷ আবার রোহিঙ্গারা যে ত্রাণ পায়, তা কারা কিনে বাইরে বিক্রি করবে তা নিয়েও দ্বন্দ্ব প্রকট৷ রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার পর এই গ্রুপগুলো আগের চেয়ে বেশি সক্রিয় হয়েছে৷ তারা সবাই প্রত্যাবসনবিরোধী৷ কেউ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার কথা বললেই তাদের হত্যার টার্গেট করে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘এই গ্রুপগুলো ক্যাম্পের মধ্যেই অস্ত্র তৈরি করে, আবার বাইরে থেকেও আনে৷ তাদের সাথে মিয়ানমারে মাদক এবং অস্ত্র চোরাচালান গ্রুপের যোগাযোগ আছে৷ আর আছে কিছু স্থানীয় লোক৷’’
ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘‘বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকেই মাঝি নামে স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপ তৈরি করেছে৷ তারা পাহারা দেয়৷ এখন তারা ওই সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর টার্গেটে পরিণত হয়েছে৷ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা তাদের বাংলাদেশের দালাল বলে হত্যা করছে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এই পরিস্থিতিতে কক্সবাজারের স্থানীয়রা এখন ভয় আর আতঙ্কে আছেন৷ তাদের সন্ত্রাসী তৎপরতা ক্যাম্পের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে৷ আমি মনে করি, ক্যাম্পের দায়িত্ব থেকে দেশি বিদেশি এনজিওগুলোকে সরিয়ে দিয়ে পুরোটাই বাংলাদেশ সরকারের হাতে নেয়া উচিত৷ সেটা করা হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে৷’’
কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মুখপাত্র ইউনূস আরমান বলেন, ‘‘বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন বাহিনী ক্যাম্পের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেও মিয়ানমার সরকারের সমর্থক কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ক্যাম্পে সক্রিয় আছে৷ আরো কয়েকটি গ্রুপ আছে৷ তারাই ক্যাম্পে হত্যাসহ নানা অপরাধে যুক্ত৷ তাদের নিজেদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব আছে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘মাঝিরা ক্যাম্পে মূলত নাইট গার্ডের কাজ করেন৷ রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকেই ক্যাম্পের নিরাপত্তার জন্য তারা দায়িত্ব পালন করছেন৷ সাম্প্রতিক সময়ে তারা হত্যার শিকার হচ্ছেন৷ সন্ত্রাসীরা হয়ত মাঝিদের তাদের অপকর্মের পথে বাধা মনে করছে৷ তাদের যখন টার্গেট করে হত্যা করা হয় তখন আসলে পুলিশের কিছু করার থাকে না৷’’
‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে’
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন এপিবিএন-এর সদস্যরা৷ ১৪ এপিবিএন-এর কমান্ডার সৈয়দ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘‘কিছু দিন আগে ক্যাম্পের পরিস্থিতি কিছুটা খারাপ হয়েছিল৷ তবে এখন আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আছে৷’’
তিনি জানান, ‘‘ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের ৬-৭টি সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় আছে৷ তারা মূলত মাদক ও অপহরণ বাণিজ্যে জড়িত৷ আর সেটা করতে গিয়ে তারা ক্যাম্পে আধিপত্য স্থাপনের লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ছে৷ আমরা চেষ্টা করছি তাদের আইনের আওতায় আনতে৷’’
মাঝিদের হত্যার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘‘মাঝিদের টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে সেটা ওভাবে বলা যাবে না৷ তবে কোনো মাঝি যদি গোপনে কোনো গ্রুপের সঙ্গে জড়িত থাকে, তারা টার্গেটে পরিণত হচ্ছে৷’’