বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্যমতে, দেশে প্রথম সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরু করে ২০১৭ সালের ৩ আগস্ট। সরিষাবাড়ীতে নির্মিত ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ছিল মাত্র তিন মেগাওয়াট। পরের বছর ২০ সেপ্টেম্বর টেকনাফে উৎপাদন শুরু করে ২০ মেগাওয়াটের আরেকটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০১৯ সালের মে মাসে সাত মেগাওয়াট ও জুলাইয়ে আট মেগাওয়াটের আরও দুটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসে। পরের বছর নভেম্বরে ময়মনসিংহে উৎপাদন শুরু করে ৫০ মেগাওয়াটের একটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র।
২০২১ সালে তিনটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়। এর মধ্যে মানিকগঞ্জে ৩৫ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র ১২ মার্চ এবং সিরাজগঞ্জে ছয় মেগাওয়াটের অপর একটি কেন্দ্র উৎপাদন শুরু করে ৩০ মার্চ। আর বাগেরহাটের মোংলায় ১০০ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র উৎপাদন শুরু করে ২৯ ডিসেম্বর। ২০২২ সালের ২৮ আগস্ট ৩০ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র লালমনিরহাটে এবং ২০২৩ সালের ৮ জানুয়ারি ২০০ মেগাওয়াটের অপর একটি কেন্দ্র উৎপাদন শুরু করে। ৪৫৯ মেগাওয়াটের এ ১০ কেন্দ্রের মধ্যে আটটি বেসরকারি খাতে, যেগুলোর সক্ষমতা ৪৫৬ মেগাওয়াট। অপর দুটি কেন্দ্র সরকারি খাতের যেগুলোর সক্ষমতা ১৩ মেগাওয়াট।
এদিকে বর্তমানে নির্মাণাধীন সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ১১টি, যেগুলোর সক্ষমতা ৪৬০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে সরকারি তিনটি কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ১৫১ মেগাওয়াট এবং বেসরকারি আটটি কেন্দ্রের ৩০৯ মেগাওয়াট। এছাড়া নির্মাণকাজ শুরুর জন্য এলওআই/এনওএ ইস্যু করা হয়েছে ১৭টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের, যেগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ৪৭৪ মেগাওয়াট, যার সবগুলোই বেসরকারি খাতের। আর সরকারি খাতের তিনটি ও বেসরকারি খাতের একটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের দরপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এগুলোর সক্ষমতা ১২৮ মেগাওয়াট।
অন্যদিকে নির্মাণের পরিকল্পনাধীন সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে আরও ১৩টি, যার সবগুলো সরকারি খাতের। এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ৯২৭ মেগাওয়াট। দেশি-বিদেশি যৌথ বিনিয়োগে একটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, যার সক্ষমতা ১৬০ মেগাওয়াট এবং বেসরকারি মালিকানায় ১৮৬ মেগাওয়াটের আরও তিনটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে নির্মাণাধীন এবং পরিকল্পনাধীন সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৯টি। আর এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা তিন হাজার ৩৩৫ মেগাওয়াট।
সূত্রমতে, পরিকল্পনাধীন বা দরপত্র প্রক্রিয়াধীন সরকারি-বেসরকারি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের সবগুলোর জন্যই এরই মধ্যে জমি চিহ্নিত বা অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তবে রেন্টাল-কুইক রেন্টালের মতো সৌরবিদ্যুতেও লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। ফলে প্রকৃতপক্ষে এ খাতে কত ব্যয় হতে পারে তার নির্দিষ্ট ধারণা বিপিডিবির নেই। বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন সময় নানা প্রস্তাব নিয়ে আসে। তখন তাদের সঙ্গে দরকষাকষি করে নির্মাণব্যয় ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা হয়। তবে দেশীয় কোম্পানিগুলো নানা ধরনের তদবির করে সরকারি বা বিদেশি কোম্পানির চেয়ে রেট বাড়িয়ে নিচ্ছে। এছাড়া রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের মতোই এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে ডলারে।
এদিকে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বিবেচনায় বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি পড়ছে। সম্প্রতি চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ প্রকাশিত ‘ফলো দ্য রিনিউয়েবল এনার্জি ফাইন্যান্স: বাংলাদেশ পার্সপেকটিভ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের গড় ব্যয় পড়ছে ১৫ দশমিক ৫ ইউএস সেন্ট। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে এ হার ৫ দশমিক ৩ সেন্ট ও পাকিস্তানে ৩ দশমিক ২ সেন্ট। এছাড়া ভিয়েতনামে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদনের গড় ব্যয় ৮ দশমিক ৪ সেন্ট, জাপানে ৯ দশমিক ৩ সেন্ট ও থাইল্যান্ডে ১২ দশমিক ১ সেন্ট।
বিপিডিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেসরকারি খাতে নির্মিত বা নির্মাণাধীন বিভিন্ন কেন্দ্রে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় ধরা হয়েছে ইউনিটপ্রতি ১১ থেকে ১৭ সেন্ট। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাম ধরা হয়েছে সুনামগঞ্জে নির্মাণাধীন হাওর বাংলা সোলার পার্কে। এ কেন্দ্রটি থেকে সৌরবিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ সেন্ট। আর লালমনিরহাটের ইন্ট্রাকো সোলার পার্ক থেকে বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ সেন্ট এবং গাইবান্ধায় বেক্সিমকোর সোলার পার্ক থেকে বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ সেন্ট।
যদিও বিদেশি মালিকানাধীন বিভিন্ন সৌরবিদ্যুৎ থেকে বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় অনেক কম ধরা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় নির্মাণাধীন গ্রিড সোলার প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৪৮ সেন্ট। অর্থাৎ বিদেশি কোম্পানির চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দামে দেশীয় বিভিন্ন কোম্পানির সৌরবিদ্যুৎ কিনছে সরকার। এছাড়া ডলারের চুক্তির ফলে দেশীয় মুদ্রায় অবমূল্যায়নে এ খাতে ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে।
জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, সৌরবিদ্যুৎ খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ডলারে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করা হয়েছে। মূলত বিভিন্ন দাতা সংস্থার পরামর্শে এ বিষয়টি যুক্ত করা হয়। কারণ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ইপিসি কন্ট্রাক্ট করা হয় ডলারে। তাই ডলারে বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধ না করলে বিদেশি কোম্পানি এ খাতে এগিয়ে আসত না।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সৌরবিদ্যুতে প্রচুর বিনিয়োগ হচ্ছে। এজন্য বিদেশি কোম্পানিগুলো এ খাতে অনেক বেশি দক্ষ। তাই তাদের ব্যয় তুলনামূলক কম হয়। ফলে বিদ্যুতের দামও কম ধরা হয়েছে। তবে দেশীয় কোম্পানিগুলো এ ব্যবসায় নতুন আসছে। তাই তাদের ব্যয় বেশি পড়ছে। এজন্য বিদ্যুতের দাম বেশি ধরা হয়েছে। তবে পাইপলাইনে থাকা কেন্দ্রগুলোর ব্যয় আগের চেয়ে কমেছে।
যদিও বিপিডিবির বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান। তিনি বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সরকারের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে ট্যারিফ (বিদ্যুতের দাম) আদায় করছে। বেসরকারি খাতে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের প্রতি কিলোওয়াটের দাম ১৩ সেন্ট, যেখানে সরকারি প্রকল্পগুলোয় কিলোওয়াটপ্রতি ১০ সেন্ট খরচ হচ্ছে। মূলত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র এবং ট্যারিফের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) পাশ কাটিয়ে বিদ্যুৎ কেনায় উচ্চ দরে চুক্তি করা হচ্ছে। এতে অযৌক্তিক ট্যারিফের মাধ্যমে অনৈতিক ফায়দা লুটতে গিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা নষ্ট হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে তেল, গ্যাস বা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া বন্ধ রেখেছে সরকার। করোনার সময় চাহিদা কমে যাওয়ায় অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে ছিল। সে সময় থেকেই মূলত নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া বন্ধ রাখা হয়। তবে তাতে দমে যায়নি দেশের বেসরকারি খাতের করপোরেট কোম্পানিগুলো। তারা রেন্টাল-কুইক রেন্টালের মতোই ঝাঁপিয়ে পড়েছে সৌরবিদ্যুতের ব্যবসায়। তাই বেসরকারি খাতে একের পর এক লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের।