চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপানসহ উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে প্রায় ১ হাজার কোটি ডলারের ঋণচুক্তি করবে সরকার। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণে সরকার এ পরিকল্পনা করেছে। এক অর্থবছরে এত বিপুল পরিমাণ ঋণচুক্তি করার পরিকল্পনা এর আগে আর কখনো নেওয়া হয়নি।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছর ৯৯৩ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ ঋণের জন্য দাতাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। ডলারের বর্তমান বাজার দরে যার পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে গত আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ৭২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছে। অর্থাৎ পুরো অর্থবছরে যে পরিমাণ ঋণের পরিকল্পনা করা হয়েছে, তার ৭২ শতাংশের জন্য এরই মধ্যে ঋণচুক্তি হয়েছে।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এ মুহূর্তে বিদেশি সহায়তার অর্থ ছাড় করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, ডলার–সংকট কাটাতে ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে ডলারের সরবরাহ বাড়ানো দরকার। বিদেশি ঋণের প্রবাহ বাড়লে দেশে ডলার আসা বাড়বে।
এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ডলার ও রিজার্ভ পরিস্থিতি বিবেচনায় অর্থনীতিতে যে সংকট চলছে, তাতে বিদেশি সহায়তার অর্থছাড় বাড়াতেই হবে। এতে দেশে ডলার আসবে। কিন্তু বিদেশি সহায়তার ক্ষেত্রে প্রকল্প সাহায্যের চেয়ে বাজেট–সহায়তা পাওয়া গেলে বেশি ভালো হতো।
আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, ঢালাওভাবে নয়; বিচার–বিশ্লেষণ করে ঋণচুক্তি করা উচিত। কারণ, এসব ঋণ সুদসহ পরিশোধ করতে হবে। ইতিমধ্যে সরকারের সুদ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় চাপ তৈরি হচ্ছে।
এদিকে বিদেশি ঋণের প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন ও বিদেশি সহায়তার অর্থছাড় ত্বরান্বিত করতে গত ২৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কার কাছ থেকে কত ঋণ
ইআরডির পরিকল্পনা অনুসারে, ঋণচুক্তির সবচেয়ে বড় পাইপলাইন এডিবির কাছে। এই সংস্থার সঙ্গে সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে ২৯৯ কোটি ডলারের ঋণচুক্তির পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে গত জুলাই-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২৬২ কোটি ডলারের চুক্তি হয়েছে।
এডিপির পরেই রয়েছে জাপান। দেশটির সঙ্গে এই অর্থবছরে ২৪১ কোটি ডলারের ঋণচুক্তির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এর মধ্যে অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ২০২ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়ে গেছে।
এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের পাইপলাইনে আছে ১৪২ কোটি ডলার। গত আট মাসে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পরিকল্পনা অনুযায়ী ঋণ গ্রহণের চুক্তি হয়ে গেছে। আপাতত নতুন ঋণচুক্তির জন্য কোনো প্রকল্প তালিকায় নেই।
৫ লাখ কোটি টাকার পাইপলাইন
ঋণচুক্তি হয়ে গেছে, কিন্তু অর্থছাড় হয়নি—পাইপলাইনে থাকা এমন ঋণের পরিমাণও কম নয়। এ মুহূর্তে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে দেওয়ার জন্য ৪ হাজার ৬৫৫ কোটি ডলারের বিদেশি সহায়তার অর্থ পড়ে আছে। বর্তমান বাজার দরে টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৫ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার মতো।
স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্থা ও দেশের সঙ্গে অনুদান ও ঋণ মিলিয়ে ১৮ হাজার ৭৬৪ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছে। এর মধ্যে এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে বাংলাদেশ সাহায্য ব্যবহার করতে পেরেছে ১২ হাজার ৬৮৭ কোটি ডলার। এ ছাড়া ১ হাজার ৪২২ কোটি ডলার দুর্নীতিসহ বিভিন্ন কারণে বাতিল করেছে দাতা সংস্থা ও দেশগুলো। বাকি থাকা ৪ হাজার ৬৫৫ কোটি ডলার এখন পাইপলাইনে পড়ে আছে। যার ২ হাজার ১৮২ কোটি ডলার পড়ে আছে তিন দাতার কাছে। এ তিন দাতার মধ্যে জাপানের কাছে সর্বোচ্চ ৮৪৫ কোটি ডলার, বিশ্বব্যাংক ও এডিবির কাছে পড়ে আছে যথাক্রমে ৭৬৬ কোটি ও ৫৭১ কোটি ডলার।
ইআরডির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, প্রতিবছর কম–বেশি ১ হাজার কোটি ডলার ঋণ ছাড় করে উন্নয়ন সহযোগীরা। প্রতিবছরই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার বাড়ছে। সেই সঙ্গে বিদেশি সহায়তার চাহিদাও বাড়ছে। এসব কারণে ঋণচুক্তি করা হচ্ছে, যা পাইপলাইনে পড়ে থাকা অর্থের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
Prothom alo