রূপপুরের ঋণ শোধে মার্কিন বাধা

সাহিদুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা

ফাইল ছবিফাইল ছবিসরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ঋণ পরিশোধ নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তা কাটছে না কিছুতেই। মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় ডলার-রুবলে শোধ করতে না পেরে চীনের মধ্যস্থতায় দেশটির মুদ্রা ইউয়ানে দায় শোধের সর্বশেষ উদ্যোগেও বাগড়া দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে করে আবারও আটকে গেল ঋণ শোধের প্রক্রিয়া।

রাশিয়ার কাছ থেকে নেওয়া এই ঋণ ডলারেই পরিশোধ করার কথা ছিল। কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করার পর পরিস্থিতি জটিল হতে শুরু করে। ইউক্রেনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ রাশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় ডলারে রূপপুরের ঋণ পরিশোধ নিয়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়। একপর্যায়ে রাশিয়া ডলারের পরিবর্তে তার নিজস্ব মুদ্রা রুবলে ঋণের কিস্তি শোধ শুরু করতে চাপ দেয়। কিন্তু বাংলাদেশ অপরীক্ষিত এই ব্যবস্থায় যেতে অস্বীকৃতি জানায়।আজকের পত্রিকা অনলাইনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

শেষ পর্যন্ত চীনের সহায়তায় দেশটির মুদ্রা ইউয়ানে ঋণের কিস্তি শোধ শুরু করতে ১৩ এপ্রিল একমত হয় বাংলাদেশ ও রাশিয়া। প্রায় একই সময়ে নিষেধাজ্ঞায় থাকা রাশিয়া ও দেশটির প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ‘তৃতীয় দেশের মাধ্যমে’ রূপপুরের ঋণের টাকার লেনদেনের এই ব্যবস্থায় সরাসরি বাগড়া দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ বিভাগ ১২ এপ্রিল রাশিয়ার জ্বালানি খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রোসাটমের কয়েকটি সহযোগী সংস্থাসহ মোট ১২০টি প্রতিষ্ঠানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস পরদিনই অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল এক কূটনৈতিক পত্রে (নোট ভারবাল) ‘নিষেধাজ্ঞা এড়াতে’ ‘তৃতীয় দেশের মাধ্যমে’ রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের টাকা লেনদেনে আপত্তি জানায়। নোট ভারবালটি গতকাল মঙ্গলবার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে পৌঁছেছে বলে সরকারের এক কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে জানান।

কূটনৈতিক পত্রে রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কিত লেনদেনের নিষ্পত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ‘সহযোগিতা করতে’ আগ্রহী বলেও দূতাবাস জানিয়েছে। তবে কীভাবে এই সহযোগিতা করার কথা ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র, তা পরিষ্কার করে বলা নেই ওই পত্রে। এতে দূতাবাসের একজন কূটনীতিকের নাম উল্লেখ করে প্রয়োজনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারকে নোট ভারবাল পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে এবং রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী চিন্তাভাবনা কী, জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের তথ্য কর্মকর্তা ব্রায়ান শিলার আজকের পত্রিকাকে গতকাল বিকেলে জানান, কূটনৈতিক চিঠিপত্রের লেনদেন একটি নিয়মিত বিষয়। আর এসব চিঠিতে কী লেখা থাকে, তা তারা (দূতাবাস) প্রকাশ করে না।

তবে রাশিয়ার রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া থেকে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে রুখতে যুক্তরাষ্ট্রসহ ৩০টির বেশি দেশ সক্রিয় আছে বলে ব্রায়ান শিলার উল্লেখ করেন।

রূপপুরের ঋণের টাকা তৃতীয় দেশের মাধ্যমে পরিশোধে যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তির পর সরকারের পদক্ষেপ কী হতে পারে জানতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জিয়াউল হাসানের সঙ্গে গতকাল বিকেলে টেলিফোনে যোগাযোগ করে আজকের পত্রিকা। তিনি দাবি করেন, নোট ভারবালটি তখনো তাঁর কাছে পৌঁছায়নি। এটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে থেকে থাকতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

চীনা মুদ্রায় রূপপুরের ঋণ পরিশোধে সিদ্ধান্তের পর মার্কিন আপত্তির ফলে বাংলাদেশের জন্য নতুন আরেকটি জটিলতা তৈরি হলো বলে মনে করেন বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (বিইআই) প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন কবির। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক এই রাষ্ট্রদূত আজকের পত্রিকাকে গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক লেনদেন কাঠামোতে চীনারা কোনোভাবে লাভবান হোক, এটা যুক্তরাষ্ট্র চায় না। অন্যদিকে, রাশিয়ার সঙ্গে রূপপুর সম্পর্কিত লেনদেনে মার্কিনিরা কোনো ছাড় এখনই দেবে, এটাও মনে হচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার নজির আছে। তবে তা সময় ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে।
মার্কিনিদের চাপে চীনকে এড়ানো এবং রাশিয়ার চাপে চীনা মুদ্রায় লেনদেনের বিষয়ে একমত হয়ে আবার পিছিয়ে আসা, দুটো ক্ষেত্রেই ‘ঝামেলা আছে’, এমন অভিমত ব্যক্ত করে হুমায়ুন কবির বলেন, বাংলাদেশ সরকারের উচিত একটু সতর্কতার সঙ্গে এগোনো। সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে আগে অনানুষ্ঠানিক আলাপ করে নেওয়া।

রাশিয়ার প্রতিষ্ঠান রোসাটমের সহযোগিতায় পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হচ্ছে। ২০১১ সালে ঢাকা ও মস্কোর মধ্যে সই করা এক চুক্তির আওতায় চলছে ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলারের এই প্রকল্প। এর ৯০ শতাংশ অর্থায়ন করছে রাশিয়া। অবশিষ্ট ১০ শতাংশ টাকা বাংলাদেশ সরকার নিজেই জোগান দিচ্ছে। আগামী ২০২৪ সাল থেকে ২৮ বছরের মধ্যে এই ঋণ শোধ করতে হবে। ঋণ পরিশোধে গ্রেস পিরিয়ড মিলবে ১০ বছর।

চলতি মাসের মাঝামাঝি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা উত্তম কুমার কর্মকার রয়টার্সকে জানান, চীনা মুদ্রা ইউয়ানে রূপপুরের ঋণের টাকা পরিশোধে সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে সামগ্রিক বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন বলে এখনো কোনো লেনদেন হয়নি।

চীনের তৈরি ক্রস-বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেমে (সিআইপিএস) ইউয়ান ব্যবহার করে এই ঋণ শোধ করা হবে বলে মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট ১৭ এপ্রিল এক প্রতিবেদনে জানায়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের ব্যবহার কমাতে চীন ২০১৫ সালে এই সিআইপিএস চালু করে।