কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, রিজার্ভ বাড়ার জন্য যেসব উৎস রয়েছে, তার প্রতিটা সূচকই নিম্নমুখী। রেমিট্যান্স কমছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রপ্তানি আয় আসছে না। আবার নতুন বিদেশি বিনিয়োগ নেই। তাই রিজার্ভ বাড়ছে না। এজন্য যে পরিমাণ ডলার আসছে, তার চেয়ে বেশি আমদানি দায় মেটাতে হচ্ছে। তাই রিজার্ভ চাপে পড়ছে।
দেশে দেড় বছর ধরে চলছে ডলার সংকট। নানা পদক্ষেপের পরও সংকট কাটেনি। চলতি অর্থবছরের শুরুটা ভালো হয়নি। যে ডলার সংকট নিয়ে অর্থনীতির খারাপ অবস্থা শুরু হলো, সেই ডলার সংকট কাটেনি; বরং ডলার সংকটের প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন খাতে।
দেশের অর্থনীতির বড় শক্তি প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। সেই প্রবাসী আয়ে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের প্রতি মাসে ধারাবাহিকভাবে প্রবাসী আয় কমেছে। গত জুলাইয়ে ১৯৭ কোটি ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। আগস্টে তা আরও কমে দাঁড়ায় ১৬০ কোটি ডলারে। সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে আসে ১৩৪ কোটি ডলার, যা গত ৪১ মাসের মধ্যে এক মাসে সবচেয়ে কম প্রবাসী আয়। এর আগে ২০২০ সালের এপ্রিলে ১০৯ কোটি ডলার এসেছিল।
এ ছাড়া রপ্তানি আয়ে খুব বেশি সুখবর নেই। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরÑপ্রতি মাসেই প্রবৃদ্ধি থাকলেও তা আশা জাগাতে পারছে না। কারণ শীর্ষ পাঁচটি রপ্তানি পণ্যের মধ্যে তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য চারটির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে সর্বশেষ গত মাসে। আবার মাসের হিসাবেও রপ্তানি আয়ের চিত্র ওঠানামা করছে। গত জুলাইয়ে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪৫৯ কোটি ডলার। পরে তা বেড়ে হয় ৪৭৮ কোটি ডলার। কিন্তু গত সেপ্টেম্বরে তা আবার ৪৩১ কোটি ডলার হয়।
জানা যায়, ডলার সংকট ও আমদানিতে নিয়ন্ত্রণের কারণে ব্যাংকে এখন ঋণপত্র (এলসি) খোলা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। গত সেপ্টেম্বরে ঋণপত্র খোলা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলারে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৮ শতাংশ কম। গত সেপ্টেম্বরে ৬ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণপত্র খোলা হয়েছিল। আর চলতি বছরের আগস্টে খোলা হয়েছে ৫ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে ঋণপত্র খোলা প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে গত অর্থবছর নিট বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে সাত শতাংশের বেশি।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের মতে, ডলারের দর ধরে রাখার কারণে রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আর্থিক সংকট নিরসনে ডলারের দাম স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা জরুরি। কিন্তু এবিবি ও বাফেদা দাম বেঁধে দেয়ার কারণে দামে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। তাই ডলারের দর পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা না গেলেও ধাপে ধাপে সেদিকে এগিয়ে যেতে হবে। তা না হলে সংকট আরও গভীর হবে।
একই রকম মন্তব্য করেন গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান ও গবেষণা পরিচালক সায়মা হক বিদিশা। তারা বলেন, চলমান মুদ্রার বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক নয়। তাই দ্রুত পুরোপুরি মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করতে হবে। তা না হলে অফিশিয়াল ও আনঅফিশিয়াল ডলার দরে বড় পার্থক্য থেকে যাবে। এক্ষেত্রে বৈধ পন্থার চেয়ে অবৈধ পন্থায় বেশি রেমিট্যান্স পাঠাবে। তখন প্রণোদনা বাড়িয়েও লাভ হবে না। ডলার সংকট থেকেই যাবে। আর শক্ত হাতে অর্থপাচারও দমন করতে হবে। তা না হলে রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে না।
এদিকে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়েছে। এ অস্থিরতা দীর্ঘ মেয়াদে রাজপথে গড়ালে বড় ক্ষতিতে পড়বে দেশের অর্থনীতি। অস্থিরতার কারণে বেকায়দায় পড়বে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প ও বিদেশি বিনিয়োগ, যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট আরও বাড়বে। এমনটাই আশঙ্কা করেছেন ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে আইবিএফবি প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, ধংসাত্মক রাজনৈতিক কার্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে। এ ছাড়া কোনো উপায় নেই। এরকম চলতে থাকলে কোনো বিদেশি ক্রেতারা আসবে না। যারা আমাদের ডলার দিচ্ছে, তারা না এলে ডলার সংকট আরও গভীর হবে।
সূত্রমতে, আঞ্চলিক দেশগুলোর লেনদেনের নিষ্পত্তির একটি মাধ্যম হলো আকু। তেহরানভিত্তিক এ সংস্থার সদস্য দেশ হলোÑভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল ও পাকিস্তান। সদস্য দেশগুলো প্রতি দুই মাস অন্তর অর্থ পরিশোধ করে। আকু পেমেন্ট করার পর সাধারণত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায়। কারণ প্রতি দুই মাসের দায় পরবর্তী মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিশোধ করে এসব দেশ। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আকুর বিল পরিশোধ করে ভারতকে।
এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন, মার্চে ১ দশমিক ০৫ বিলিয়ন, মে মাসে ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন, জুলাইয়ে ১ দশমিক ১০ বিলিয়ন এবং সেপ্টেম্বরে ১ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে।