সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে সারাদেশে আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। বৃষ্টি উপেক্ষা করে গতকাল বৃহস্পতিবার চতুর্থ দিনে শিক্ষার্থীরা মেধার মূল্যায়ন চেয়ে একযোগে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করেন। এ সময় ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বরিশাল, কুমিল্লা, খুলনাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজপথে দাবি আদায়ের শপথ নেন। আন্দোলনের কারণে রাজধানীতে তীব্র যানজট দেখা দেয়।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হন বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশী। মিছিল নিয়ে তারা মাস্টারদা সূর্য সেন হল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের গেট হয়ে ভিসি চত্বর, টিএসসির রাজু ভাস্কর্য ঘুরে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি শেষে আন্দোলনকারীরা রাজু ভাস্কর্যে গিয়ে নতুন করে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
শিক্ষার্থীদের পক্ষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম জানান, শুক্রবার সারাদেশে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন-অফলাইনে জনসংযোগ ও সমন্বয়, শনিবার বেলা ৩টায় দেশজুড়ে বিক্ষোভ এবং রোববার সব বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের মাধ্যমে ছাত্র ধর্মঘট পালন করা হবে। শনিবারের বিক্ষোভ থেকে রোববারের মাঠের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলেও জানান তিনি।
এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা রাজপথে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মাঠে থাকার শপথ নেন। চার দিন ধরে আন্দোলন চললেও সরকারের পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগ করেনি বলে সমকালকে জানিয়েছেন নাহিদ ইসলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া হচ্ছে। সারাদেশে ‘কোটা পুনর্বহাল করা চলবে না’ শীর্ষক ফেসবুক গ্রুপে সবাই যুক্ত রয়েছেন। গ্রুপ থেকেই যাবতীয় বিষয় আপডেট দেওয়া হচ্ছে। একই নামে টেলিগ্রাম গ্রুপও রয়েছে আন্দোলনকারীদের।
নাহিদ ছাড়াও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে যুক্ত আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী সারজিস আলম, ইংরেজি বিভাগের হাসনাত আব্দুল্লাহ, রাফিয়া রেহনুমা হৃদি, মোহাম্মদ মাহিন, আব্দুল হান্নান মাসউদ, রাশিদুল ইসলাম রিফাত প্রমুখ।
নাহিদ ইসলাম বলেন, ২০১৮ সালে নির্বাহী বিভাগ পরিপত্রের মাধ্যমে কোটা বাতিল করল। বিচার বিভাগ দিয়ে কোটা আবার পুনবর্হাল করা হলো। এটা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রহসন। এটা রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে সমন্বয়হীনতার উদাহরণ। নির্বাহী বিভাগ আদেশ দিচ্ছে তো বিচার বিভাগ বাতিল করছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্তঃদ্বন্দ্বে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক নেই। নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ করুক– এটাই আমরা চাই।
হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমরা একই প্রশ্নে ভর্তি পরীক্ষা দেব, একই প্রশ্নে হবে লিখিত এবং ভাইভার মুখোমুখিও হবো। কিন্তু তারা কোটা সুবিধার কারণে একাই শতভাগ সুবিধা পাবে। তাহলে আমরা ধরে নেব, জন্মই আমার আজন্ম পাপ?’
রাজধানীতে তীব্র যানজট
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে শুধু শাহবাগে নয়, গোটা রাজধানীতে গতকাল তীব্র যানজট হয়েছে। নগরবাসী দিনভর সীমাহীন ভোগান্তি পোহান। ১০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে অনেকের কেটে গেছে ঘণ্টা। আষাঢ়ের বৃষ্টি পরিস্থিতি আরও নাজুক করেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে যায়।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাংলামটর, কারওয়ানবাজার, পান্থপথ, সায়েন্স ল্যাব, তেজগাঁও, আগারগাঁও, মিরপুর রোড, মগবাজারসহ বেশির ভাগ সড়কে তীব্র যানজট দেখা গেছে। প্রধান সড়কের প্রভাবে অলিগলিতেও যানবাহনের চাপ বেড়ে যায়। এতে নগরবাসীর পাশাপাশি এইচএসসি পরীক্ষা শেষে ঘরে ফেরা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক-উত্তর) আবু রায়হান মুহাম্মদ সালেহ বলেন, সকালে রাস্তায় যানবাহনের তেমন চাপ ছিল না। শাহবাগ এলাকায় টানা কয়েক ঘণ্টা শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে যানজট বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে তা বিভিন্ন সড়কে ছড়িয়ে পড়ে।
আন্দোলনে যেতে ছাত্রলীগের বাধা, হলগেটে তালা
আন্দোলনে যেতে শিক্ষার্থীদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। একাধিক হলের গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয় তারা। সরেজমিন মাস্টারদা সূর্য সেন ও কবি জসীম উদ্দীন হলগেটে তালা দেখা যায়। এ সময় শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলেও শিক্ষার্থীদের গেস্টরুমে আটকে রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে হলে গিয়ে তালা খুলতে বাধ্য করেন। এর পরও বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে আন্দোলনে অংশ নিতে দেয়নি ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।
সূর্য সেন হলে দেখা যায়, ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের অনুসারী হল ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক রাকিব উল ইসলাম, তৌহিদুজ্জামান অভিসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীদের বাইরে না যেতে ধমকাচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা জানান, গেটে তালা দেওয়ার নেতৃত্বে ছিলেন হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি মনির হোসাইন, মাহফুজুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাকিব হোসেন, শাকিল হোসেন, তাওহীদ জামান অভি, সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল্লাহ খান শৈশব, সাহিত্য সম্পাদক আরিফুর রহমান যুবরাজ প্রমুখ।
একই সময়ে শিক্ষার্থীদের মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে নিয়ে যেতে দেখা গেছে। ছাত্রলীগের বিভিন্ন হল গ্রুপের শিক্ষার্থীদের মধুর ক্যান্টিনে কর্মীদের আনার নির্দেশ দিয়ে মেসেঞ্জারে বার্তা দিতে দেখা গেছে। জানতে চাইলে রাকিব উল ইসলাম বলেন, সহিংসতা করে দাবি আদায় করা ঠিক নয়।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, ‘আমাদের কেউ শিক্ষার্থীদের বাধা দেয়নি। এটি একটি আইনি প্রক্রিয়া। আইনগতভাবে এর সমাধান হবে।’
সারাদেশে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা জানান, কোটা বাতিলের দাবিতে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক-সংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে সড়কের উভয় লেনে যানজট হয়। পরে দুপুর ১টার দিকে অবরোধ তুলে নেন তারা।
একইভাবে পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার মোড় অবরোধ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) শিক্ষার্থীরা রাজধানীর আগারগাঁও মোড়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীরা ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) শিক্ষার্থীরা খুলনার জিরো পয়েন্ট, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শিক্ষার্থীরা কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) শিক্ষার্থীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন।
samakal