Site icon The Bangladesh Chronicle

রাজনীতির পূর্ণিমায় অমানিশা যখন অনিবার্য

 

 

তথ্য প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে ডা: মুরাদ হাসান যে দিন পদত্যাগ করলেন সে দিন সারাবেলা আমার মন ভার হয়ে রইল। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল অবধি তাকে যেভাবে জানতাম এর সাথে তার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের কোনো মিল না থাকায় তাকে নিয়ে সৃষ্ট কেলেঙ্কারি আমাকে বেদনাহত করে তোলে। ডা: মুরাদের পতনদৃশ্যে মনে হচ্ছে- বাংলাদেশের সবাই তার বিরুদ্ধে চলে গেছে। কিন্তু এত কিছুর পরও হয়তো অনেকে তার জন্য কষ্ট পাচ্ছেন- কেউ কেউ বিব্রত হচ্ছেন অথবা আফসোস করছেন। মুরাদ যে মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, সেখানকার পূর্ণ মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ যেভাবে সহানুভ‚তির সাথে মুরাদের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অমনভাবে তিনি ইতঃপূর্বে কখনো বলেননি। তিনি মুরাদের অতীত কর্ম এবং মন্ত্রণালয়ের কাজে তার সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে বলেছেন- গত তিন মাস ধরে তিনি মুরাদের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন দেখতে পান।

ড. হাছান মাহমুদ তার সহকর্মীর কী পরিবর্তন দেখেছিলেন তা বিস্তারিত না বললেও যা অনুমান করতে পারি তা হলো- মুরাদ মানসিকভাবে অসুস্থ বা বেসমাল হয়ে পড়েন। মুরাদ মন্ত্রী হওয়ার পর একটি অনুষ্ঠানে তার সাথে আমার যে দিন প্রথম সাক্ষাৎ হলো সে দিন অনেকটা শিশুর মতো আমাকে জড়িয়ে ধরলেন ও নিজের সফলতার জন্য প্রথমে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানান এবং আল্লাহর দয়া ছাড়া যে মন্ত্রী হতে পারতেন না সে কথা বলতে গিয়ে বেশ কয়েকবার নিজের কপালে হাত রাখেন। আমি দল পরিবর্তন করায় খুব আফসোস করে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললেন, ‘আপনাকে অনুসরণ করতাম- আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি- সেই আপনি নেই। অথচ আপনি থাকলে…।’ আমি তার বিনয়-ভদ্রতা এবং কৃতজ্ঞতাবোধে আহ্লাদিত হলাম।

উল্লিখিত ঘটনার পর তার সাথে আমার আর কোনো দিন সরাসরি সাক্ষাৎ হয়নি তবে চ্যানেল আই ‘তৃতীয় মাত্রা’র একটি টকশোতে মাস ছয়েক আগে আমরা অংশগ্রহণ করি যেখানে মুরাদ তার বাসা থেকে সংযুক্ত হন এবং আমি টেলিভিশন স্টুডিও থেকে আলোচনা করি। মুরাদ এবং আমার সেই টকশোটিও রীতিমতো ভাইরাল হয়ে এখনো সামাজিক মাধ্যমে ঘুরছে। সেই অনুষ্ঠান শুরুর আগে এবং পরে মুরাদের সাথে আমার যে ব্যক্তিগত কথাবার্তা হয়েছিল তাও ছিল মন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম সাক্ষাতের মতোই বিনয়, ভদ্রতা ও সৌজন্যে ভরপুর। কাজেই সেই মুরাদের ভিন্নমাত্রার উগ্রতা কিংবা তার একান্ত ব্যক্তিগত গোপনীয় বিষয়ের মধ্যে সীমাহীন বিকৃত রুচি, অশ্লীলতা ও উগ্রতার কথা জানার পর বারবার মনে হচ্ছিল- মানবজীবনে কেন এমনটি ঘটে?

মুরাদের ঘটনার জন্য কি শুধু মুরাদই দায়ী, নাকি দেশের সামগ্রিক অবস্থা বিশেষ করে গণতন্ত্রহীনতা, ভোটারবিহীন নির্বাচন, জবাবদিহিহীন সরকারব্যবস্থা, বিচারহীনতা, দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির অবমাননা, সর্বত্র দুর্নীতি, অনিয়ম ও যথেচ্ছাচারের সীমাহীন তাণ্ডব, দুর্নীতিবাজ-চোর-ডাকাতদের উল্লাসনৃত্য, ভীতিহীন নিষ্ঠুরতা, অমানবিক এবং সহিংস প্রতিযোগিতা ইত্যাদি কারণগুলোর জন্যই সারা দেশে অসংখ্য প্রকাশ্য অথবা অপ্রকাশ্য ‘মুরাদকাণ্ড’ ঘটছে।

আমরা যদি মুরাদ কেলেঙ্কারির পেছনে তার রাজনৈতিক পদ-পদবি ও ক্ষমতাকে হেতু হিসেবে ধরি এবং দেশের পুরো রাজনৈতিক সিস্টেমকে দায়ী না করে কেবল ব্যক্তি মুরাদকে আক্রমণ করি তবে অনাগত দিন শত শত বিশ্রী এবং অসহ্য নতুন নতুন কেলেঙ্কারি আমাদের গ্রাস করবে। অন্য দিকে মুরাদের কর্মকাণ্ড যদি তার ব্যক্তিগত ক্ষমতা, অর্থ, পারিবারিক প্রভাবের কারণে হয়ে থাকে তাহলে বুঝতে হবে সমাজে পচন ধরেছে- বুদ্ধিজীবীরা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন এবং সামাজিক সাম্যের স্তম্ভগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। এই কারণে মুরাদের ঘটনার দায় আমাদের কেন নিতে হবে তা একটি ছোট উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবেন।

ঘটনাটি বছরখানেক আগের। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে দফতর পরিবর্তন করে যখন মুরাদকে তথ্য মন্ত্রণালয়ে আনা হলো তখন তথ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন মিডিয়া হাউজে তাকে নিয়ে যে আদিখ্যেতা শুরু হলো তার কিছু নমুনা একদিন শুনতে পেলাম পরিচিত একজন তারকা মানের সাংবাদিকের কাছে। তিনি খুব আক্ষেপ করে জানালেন তার কর্তৃপক্ষ মুরাদের মনোরঞ্জনের জন্য তাদের অফিসের মধ্যে কী ধরনের বালাখানার আয়োজন করেছে। তারকা সাংবাদিকের কথায় সংশ্লিষ্ট মিডিয়া হাউজের বালাখানার বালামুসিবত সে দিন বুঝতে না পারলেও আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, একজন ডা: মুরাদ হাসানের বদনামির পেছনে তথাকথিত বেনিয়া এবং দুর্নীতিবাজদের দোসরদের কতটুকু ভূমিকা রয়েছে।

মুরাদের ঘটনায় যখন মন ভার হয়েছিল তখন ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে অসাধারণ একটি ভিডিও তথা প্রামাণ্যচিত্রের সন্ধান পাই। এই মহাবিশ্বে ঘটে যাওয়া কিছু বিস্ময়কর ঘটনার ওপর প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মিত হয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরের অতলান্তে যে ভয়ঙ্কর আগ্নেয়গিরিগুলো রয়েছে সেগুলোর মধ্যে একটি আগ্নেয়গিরি বছর দশেক আগে হঠাৎ করে অগ্ন্যুৎপাত আরম্ভ করে। বছরের পর বছর ধরে সেই আগ্নেয়গিরির ফুটন্ত লাভা কিভাবে সমুদ্রগর্ভসহ নিকটবর্তী দ্বীপরাষ্ট্র টোগোকে বিপন্ন করে তোলে এবং মহাসমুদ্রের বক্ষে কিভাবে লাভা নির্মিত সুউচ্চ পাহাড়-পর্বত-টিলাসমেত একটি দ্বীপের সৃষ্টি করে, তা নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।

যদি উল্লিখিত ভিডিওটি দেখেন এবং একটিবারের জন্য আপনার রবের কথা চিন্তা করেন তাহলে তার শক্তিমত্তা, নির্মাণ কৌশল এবং ‘কুন-ফাইয়াকুন’-এর মর্মার্থ অনুধাবন করা আপনার জন্য সহজ হয়ে যাবে। আপনি যদি ভাবুক হন, বড় বড় প্রাসাদের দেয়ালের দিকে তাকিয়েই আপনি প্রাসাদের বোবা কান্না শুনতে পাবেন। আর গর্ব ও অহঙ্কারে যাদের মাটিতে পা পড়ে না তাদের দিকে তাকানো মাত্র আপনার মনে হবে যে, তাদের পেটভরা ময়লা-আবর্জনা। তাদের কান-নাক এবং মুখ গহ্বরের মধ্যেও আপনি আবর্জনা-পোকা-মাকড়ের মাখামাখি দেখতে পাবেন। আপনি যদি একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হন তাহলে রাজপথের সুনসান নীরবতা আপনাকে প্রশান্ত মহাসাগর তলের ভয়ঙ্কর আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত লাভার কথা স্মরণ করিয়ে দেবে এবং উত্তপ্ত রাজপথ দেখলে আপনার মনে সাহারা মরুভ‚মির তলদেশে প্রবহমান নদীর শীতল জলের কথা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসবে।

আলোচনার এই পর্যায়ে আমরা আজকের শিরোনাম নিয়ে কিছু কথা বলব। সমসাময়িক রাজনীতির যারা সুবিধাভোগী তাদের হম্বিতম্বিকে আমরা যদি ডা: মুরাদের সুসময়ের সাথে তুলনা করি- তাহলে দেখব যে, তার রাজনীতির আকাশে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ যখন মধ্যগগনে ছিল তখন জ্যোৎস্নার কারণে বর্ষাকাল হয়ে গিয়েছিল বসন্ত। কালবৈশাখীর প্রবল ঝড়গুলো চাঁদের আলোর মোহে মৃদুমন্দ বাতাসের রূপ ধারণ করে শিহরণ জাগানো অনুভ‚তি সৃষ্টি করেছিল। চাঁদের আলোর চার পাশে ভাসমান সাদা মেঘের ভেলার অদূরে রাক্ষুসে কালো মেঘ কিভাবে হঠাৎ ঘোর অমানিশার রূপ নিয়ে চাঁদকে গ্রাস করতে পারে তা কেবল মুরাদের মতো ভুক্তভোগীরাই বলতে পারেন।

আমরা আজকের শিরোনামের সারবস্তু হিসেবে যা আলোচনা করতে চাচ্ছি তা হলো- রাজনীতির সত্যিকার পূর্ণিমা যা দেশ-জাতিকে জ্যোৎস্নার অনাবিল প্রশান্তি দান করে সেগুলোর নিয়ামক কী? অন্য দিকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দৃশ্যত মনে হয় যে, রাজনীতিতে পূর্ণিমার আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে; কিন্তু প্রকৃতিতে পূর্ণিমার পর ধীরে ধীরে চাঁদ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যেভাবে অমাবস্যার দিকে ধাবিত হয় সেভাবে না হয়ে দেখা গেল- পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের মতো ভরা পূর্ণিমার চাঁদকে ঘোর অমানিশা হঠাৎ করেই গ্রাস করে ফেলল এবং পূর্ণিমার আলো ভোগকারীরা এমন ঘোরতর অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো, যা তাদের অনেকের কাছে মৃত্যুপুরী বা যমদূতের বাড়ির চেয়েও ভয়ঙ্কর বলে মনে হতে থাকল!

রাজনীতিতে যখন স্বচ্ছতা থাকে, ন্যায়পরায়ণতা থাকে এবং রাজনীতিবিদরা চিন্তাচেতনা এবং কর্মে সৎ ও অবিচল থাকতে পারেন তখন জনগণ রাজনৈতিক নেতাদের মাথার তাজ মনে করেন। জমিনের তাবৎ সৃষ্টিকুল তখন আল্লাহর হুকুমে সৎ, যোগ্য ও ধার্মিক নেতাকে সর্বাবস্থায় সাহায্য করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। প্রকৃতির অন্যান্য উপকরণ যথা- আলো-বাতাস-মেঘমালা থেকে শুরু করে বৃক্ষলতা-পাহাড়-পর্বত, জন্তু জানোয়ার, সব কিছুই উত্তম শাসকের সাহায্যকারী শক্তিরূপে কাজ করতে থাকে। ফলে অকালে বৃষ্টি হয় না- কোনো ভ‚মি বিরান হয়ে পড়ে না; প্রাকৃতিক দুর্যোগে জনজীবন বিপর্যস্ত হয় না; মানুষের মনে প্রাকৃতিক প্রশান্তি বিরাজ করে; কর্মে বরকত আসে; চিন্তায় উর্বরতা বাড়ে এবং সর্বত্র সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির উৎসবের আমেজ বিরাজ করে।

উল্লিখিত ঘটনার বিপরীতে রাজনীতিতে যখন দস্যিপনা ঢুকে পড়ে এবং ক্ষমতাধররা যখন জনগণের জানমাল-ইজ্জত সংরক্ষণের পরিবর্তে তা লুট করার জন্য প্রকাশ্য দিবালোকে অথবা রাতের আঁধারে অস্ত্রধারী ডাকাতের বেশে অথবা সাধু বাবার ছদ্মবেশে সর্বশক্তি নিয়ে হায়েনা বা শকুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন রাজনীতির পূর্ণিমা গ্রাস করার জন্য ঘোর অমানিশার আক্রমণ অনিবার্য হয়ে পড়ে রাজনীতিবিদরা যখন হরদম মিথ্যা বলে এবং মোনাফেকির আশ্রয় নিয়ে জনগণকে ধোঁকা দিতে থাকে তখন সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রকৃতি ও পরিবেশে এক ধরনের দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়। চোর যখন বড় বড় চেয়ারে বসে নীতিকথা শোনায়, যেনাকার-ব্যভিচারীরা যখন নারী অধিকারের প্রবক্তা হয়ে লজ্জা-শরম-হায়ার রক্ষকরূপে আবিভর্‚ত হয় এবং অশিক্ষিত মূর্খরা জ্ঞানীদের তাড়িয়ে শিক্ষা বিভাগের কর্তৃত্ব পায়, তখন সেই অঞ্চলের জমিন গোস্বায় চৌচির হতে থাকে।

মানুষের আশা-ভরসার রাজনৈতিক মাকামগুলোতে যদি অসৎ, অযোগ্য, অথর্ব ও অপদার্থরূপী শয়তানি আত্মার রাজনীতিবিদ কিলবিল করতে থাকে তখন প্রকৃতিতে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। রোগবালাই, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মানুষের মন খারাপ হওয়া, অবসাদগ্রস্ততা, ক্লান্তি এবং দুঃস্বপ্ন জাতীয় জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়। এ অবস্থায় পুরো প্রকৃতি ‘খামোশ’ হয়ে যায়। বাতাস প্রবাহিত হয়; কিন্তু মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা-স্বপ্নকে ধারণ করে দেশের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে বহন করার বাতাস থাকে না। মানুষের স্বাদ-গন্ধ-স্পর্শ গ্রহণ করার প্রাকৃতিক শক্তি কমে যায়। কোকিলের চেয়ে ‘কাউয়া’র ডাকের গর্জনে মানুষের কানে যন্ত্রণা শুরু হয় এবং ফুলের গন্ধের পরিবর্তে ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধে চার দিক অস্বস্তিকর ও অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়ে। এত্তসব বৈশিষ্ট্য যে সমাজ-কাল-রাষ্ট্রে দৃশ্যমান সেখানকার রাজনীতিতে যত বড় পূর্ণিমার চাঁদের কথাই বলা হোক না কেন সেই চাঁদের আড়ালে ভয়ঙ্কর রাক্ষসরূপে ঘোর অমানিশার অন্ধকার যে ওঁৎ পেতে রয়েছে, তা বোঝার জন্য খুব বেশি পাণ্ডিত্যের দরকার নেই।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

Exit mobile version