Site icon The Bangladesh Chronicle

রাখাইন ঘিরে ভূরাজনৈতিক সংঘাতের ঝুঁকি আছে

এমদাদুল ইসলাম

মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ছে। সীমান্তের ওপার থেকে গুলি ও মর্টার শেল বাংলাদেশের ভূখণ্ডে এক ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির তৈরি করেছে। দেশটির সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সদস্য এবং সরকারি কর্মকর্তাসহ কয়েক শ নাগরিক বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। চলমান মিয়ানমার পরিস্থিতি, বাংলাদেশে এর প্রভাব, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া এবং চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের ভূমিকা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম। তিনি রোহিঙ্গা: নিঃসঙ্গ নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠী বইটির লেখক।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা

প্রথম আলো:গত বছরের অক্টোবরের শেষ দিকে মিয়ানমারের তিনটি সংগঠন ‘অপারেশন ১০২৭’ নামে অভিযান শুরু করলে সেখানকার জান্তাবিরোধী আন্দোলন একটা নতুন মাত্রা পায়। বিদ্রোহীরা কোন বিবেচনা থেকে নতুন করে সংগঠিত হয়ে এই অভিযান শুরু করল?

এমদাদুল ইসলাম: ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অং সান সু চিকে ক্ষমতাচ্যুত করে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে। প্রতিবাদে মিয়ানমারজুড়ে প্রবল জনরোষ ও সহিংস আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সু চির দল এনএলডির সমর্থকেরা এনইউজি (ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট) নামে একটি প্রবাসী সরকার গঠন করে।

এই প্রবাসী সরকার মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী সব দল ও মতকে একই ছায়ায় আনার জন্য গঠন করে এমএনডিএ (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স)।

দেখা গেল এনইউজি ও এমএনডিএ অনেকটা পশ্চিমা তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট এবং তারা পশ্চিমাদের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী বরাবরই চীনের সমর্থন পেয়ে এসেছে। এ অবস্থায় হয়তো চীন ভূকৌশলগত ও ভূরাজনৈতিক অবস্থান ধরে রাখার কৌশল হিসেবে তার ‘সেকেন্ড লাইন ফোর্স’ আকারে বিদ্যমান বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সক্রিয় করে সামরিক বাহিনীর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।

সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণের বিরূপ মনোভাবে এনইউজি যেন লাভবান না হয় এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো যেন সেই জায়গাটা দখল করে—এমন একটি কৌশল থেকে বিদ্রোহী দলগুলোর এই নতুন আক্রমণ অভিযানে ইন্ধন জুগিয়ে থাকতে পারে চীন।

প্রথম আলো:আলোচনায় আছে অপারেশন ১০২৭ শুরু করেছে চীন। চীন-মিয়ানমার সীমান্তে সন্ত্রাস, মাদক চোরাচালান, পণবন্দী—এ রকম নানা বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল চীন। মিয়ানমার প্রশ্নে কি চীন তার অবস্থান পাল্টেছে?

এমদাদুল ইসলাম: অপারেশন ১০২৭ চীন শুরু করুক বা না করুক তাতে কিছু যায় আসে না। তবে এর মাধ্যমে মিয়ানমার সেনাবাহিনী একটি বার্তা আবারও জোরালোভাবে পেয়েছে। তা হলো সামরিক বাহিনীর বাইরেও চীনের প্রভাববলয় প্রবল। মিয়ানমার প্রশ্নে চীন তার অবস্থান থেকে একটুও বদলায়নি। বরং এনইউজি তথা পশ্চিমাদের চীন ভালোভাবেই বার্তা দিয়েছে যে মিয়ানমারে তারাই নিয়ামক শক্তি।

প্রথম আলো:কৌশলগত দিক দিয়ে চীনের কাছে মিয়ানমারের গুরুত্ব অনেক বেশি। এই দেশটির মাধ্যমেই ভারত মহাসাগরে চীনের নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। খনিজ সম্পদসহ নানা খাতে তাদের স্বার্থ আছে। মিয়ানমারের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা কী হবে এখন?

এমদাদুল ইসলাম: বিখ্যাত সুইডিশ সাংবাদিক বার্টিল লিন্টনার তাঁর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, চীনের কাছে এখন মিয়ানমারের রাখাইনে অবস্থিত চকপিউ গভীর সমুদ্রবন্দর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এটি চীনের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ।

দীর্ঘদিন ধরেই দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্ট নানা প্রতিকূলতার কারণে মালাক্কা প্রণালি দিয়ে চীন জ্বালানি আমদানিতে অস্বস্তিতে রয়েছে। মনে রাখতে হবে, মালাক্কা চীনের চতুর্থ বৃহৎ জ্বালানি সরবরাহের পথ। চকপিউ গভীর সমুদ্রবন্দর চীনকে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ তৈরি করে দিয়েছে।

এর সঙ্গে রয়েছে চকপিউকে ঘিরে চীনের শিল্পাঞ্চল। মূল ভূখণ্ডের বাইরে এসে এ শিল্পাঞ্চল থেকে চীন সাশ্রয়ে তার রপ্তানি বাণিজ্য পরিচালনা করবে। রাখাইনের থা শোয়ে গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস চীনের দক্ষিণাঞ্চলের তিনটি প্রদেশে পাঠানো হচ্ছে। ইরাবতী নদীতে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জলবিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র গড়ে তুলছে চীন।

সুতরাং চীন কখনো চাইবে না মিয়ানমার চূড়ান্ত কোনো অস্থিতিশীলতার দিকে পা বাড়াক। বরং চীন মিয়ানমারে একটি নিয়ন্ত্রিত অস্থিতিশীলতার মাধ্যমে নিজের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে চেষ্টা করে যাবে।

প্রথম আলো:১৯৬২ সাল থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সামরিক বাহিনীই মিয়ানমারের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। এখনকার মতো বিদ্রোহ এই সেনাবাহিনী আগেও দেখেছে এবং তা দমন করেছে। এবারের সশস্ত্র লড়াইয়ের নতুন বিশেষত্ব কী দেখেন?

এমদাদুল ইসলাম: মিয়ানমার তার জন্মলগ্ন থেকেই বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর লড়াই সামলে এসেছে। শান স্টেটে শান ন্যাশনাল আর্মি, কারেন স্টেটে কারেন ইনডিপেনডেন্ট আর্মি, চিন স্টেটে চিন ন্যাশনাল আর্মি, মন স্টেটে মন আর্মি, কাচিন স্টেটে কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মি, ওয়া আর্মি, আরাকান স্টেটে আরাকান আর্মি দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই করে আসছে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী এসব সশস্ত্র গোষ্ঠীর লড়াই বরাবরই দমন করেছে। এটি তারা করেছে কখনো অস্ত্রবলে, কখনো আলোচনার টেবিলে। কিন্তু মিয়ানমার সামরিক বাহিনীতে কখনো নিজেদের মাঝে রক্তক্ষয়ী কোনো বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেনি। জেনারেল নে উইন থেকে জেনারেল শ মং, শ মং থেকে জেনারেল থা শোয়ে, থা শোয়ে থেকে জেনারেল মিন অং হ্লাইং—যেন রাজা-বাদশাহদের বংশপরম্পরা।

কিন্তু এবারের লড়াইয়ে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো, অন্য কোনো সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনী বা তাদের সেকেন্ড লাইন ফোর্সের কেউ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে আসেনি। এবার তারা পালাচ্ছে এবং আমাদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছে।

প্রথম আলো:২০২১ সালে মিন অং হ্লাইংয়ের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের পর দেখা যাচ্ছে, বিদ্রোহীদের কাছে জান্তা সরকার একের পর এক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ঐক্যে কোনো ভাঙন দেখতে পাচ্ছেন কি?

এমদাদুল ইসলাম: বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারানোর এ ঘটনা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর মাঝে বিদ্যমান ঐক্য ভাঙনের কারণ হবে না। মিয়ানমারের সেনা নেতৃত্ব বড়জোর মনে করতে পারে এটা জ্যেষ্ঠ জেনারেল মি অং হ্লাইংয়ের নেতৃত্বের দুর্বলতা। সে ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ জেনারেলকে সরে যেতে হবে। যেমনটা হয়েছিল ১৯৯২ সালে। তখন জেনারেল থা শোয়ের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে জেনারেল শ মং পর্দার অন্তরালে চলে যান।

এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বাইরে দেশটিতে জাতীয় পর্যায়ে কোনো বেসামরিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি বা গড়ে উঠতে দেওয়া হয়নি। বহু জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত মিয়ানমারকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে হলে সেখানে সামরিক বাহিনীর বিকল্প কোনো শক্তি নেই—সাধারণ মানুষের মনে এ বোধটিও বেশ ভালোভাবে প্রোথিত।

প্রথম আলো:মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের প্রভাব বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাগুলোতে পড়তে শুরু করেছে। আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দিকে এগোচ্ছে। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ?

এমদাদুল ইসলাম: আমাদের সীমান্তের ওই পারে রাখাইন অঞ্চলের সংঘাত মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এরপরও এ সংঘাত আমাদের জন্য শঙ্কার কারণ। এই সংঘাত বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকির সৃষ্টি করছে।

আমরা জানি যে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সরকারের অত্যাচার-নির্যাতন ও জাতিগত বিদ্বেষের শিকার হয়ে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে আটকে রয়েছে এবং এখন তা অনেকটাই অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে।

রাখাইনে আমাদের দুই প্রতিবেশী চীন ও ভারতের ভূকৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। রাখাইনকে ঘিরে দেশ দুটির যে কোনো পদক্ষেপে বাংলাদেশকে ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে হবে। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি জটিল সমীকরণ।

মিয়ানমার–সংক্রান্ত রিপোর্টে জাতিসংঘের একসময়ের মহাসচিব কফি আনান সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, রাখাইন অঞ্চলের বিদ্যমান সমস্যা অচিরেই সমাধান না করলে তা শুধু বাংলাদেশ-মিয়ানমার নয়; পুরো দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়াকে চরম সংকটের মুখোমুখি করবে। এ অঞ্চল ঘিরে তিনি মৌলবাদের উত্থান আশঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন।

প্রথম আলো:মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বড় সমস্যাটা রোহিঙ্গাদের নিয়ে। এখন মিয়ানমারের চলমান সংঘাত রোহিঙ্গা সমস্যার ওপর কী প্রভাব ফেলবে?

এমদাদুল ইসলাম: রাখাইনের থা শোয়ে গ্যাসক্ষেত্র থেকে চীন নির্বিঘ্নে গ্যাস নিয়ে যাবে—এটা হয়তো ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র না–ও চাইতে পারে। চকপিউ গভীর সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর হয়ে চীন অবাধে ভারত মহাসাগরে বিচরণ করুক, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো সেটা না–ও চাইতে পারে।

এই পারস্পরিক চাওয়া না চাওয়ার কারণেই ভবিষ্যতে মিয়ানমার বিশেষ করে রাখাইনকে ঘিরে দুই পরাশক্তিধর দেশের মধ্যে বিরোধ দেখা দিতে পারে। ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে সংঘাতের ঝুঁকি বাড়তে পারে। যদি তেমন কিছু হয়, তবে রোহিঙ্গা সংকট খুবই দ্রুততার সঙ্গে খারাপের দিকে যেতে পারে।

এ ধরনের সংঘাতময় দৃশ্যপটে ভারত যদি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নেয়, তাহলে এই অঞ্চলের জন্য আরও জটিল ও কঠিন এক আঞ্চলিক নিরাপত্তার সংকট তৈরি হবে। রাখাইনের পরিস্থিতি বাংলাদেশকে এ রকম জটিল অনেক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এখন অনিশ্চয়তার তিমিরে। রাখাইনের অস্থিতিশীলতা আরও প্রলম্বিত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাখাইনে স্থিতিশীলতা ফেরানো এখন বাংলাদেশেরও একটি অন্যতম কূটনৈতিক প্রচেষ্টা হতে হবে।

প্রথম আলো:বার্মা অ্যাক্টের মাধ্যমে মিয়ানমারের বর্তমান সামরিক সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ‘বেআইনি’ কর্তৃপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করে। বার্মা অ্যাক্ট মিয়ানমারের ওপর কী প্রভাব ফেলছে?

এমদাদুল ইসলাম: ‘বার্মা অ্যাক্ট’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে বেশ কিছু ক্ষমতা দিয়েছে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সরকার মিয়ানমারের জান্তাকে সহায়তা প্রদানকারী ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ব্যাহতকারীদের সম্পত্তি জব্দ করা; ভিসা না দেওয়া, জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবে। সামরিক জান্তার আর্থিক সক্ষমতাকে খর্ব করতে তেল–গ্যাস আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে।

বার্মা অ্যাক্টের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই ক্ষমতাবলে মিয়ানমার এবং এর কাছাকাছি অঞ্চলে গণতন্ত্রকামীদের সহায়তা দেওয়ার জন্য অর্থব্যয় করতে পারবে।

২০২১ সালে প্রণীত বার্মা অ্যাক্টের প্রয়োগ তেমনভাবে হয়েছে তা বলা যাবে না। এনইউজি এ থেকে খুব যে একটা লাভবান হয়েছে, তা নয়। বরং এনইউজি পশ্চিমা বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবধারার ধরে নিয়ে এর মোকাবিলায় চীন তার ছত্রচ্ছায়ায় বিদ্রোহী গোষ্ঠী যেমন ওয়া, তাং, কাচিন ও আরাকান আর্মিকে সক্রিয় করেছে। ভারতও হয়তো সামরিক জান্তাকে সহায়তার হাত বাড়ানো থেকে নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে রেখেছে। এর পুরো সুবিধা নিয়েছে চীন। মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী মানুষের জন্য এখন পর্যন্ত বার্মা অ্যাক্ট কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি।

প্রথম আলো:ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, সার্বিকভাবে মিয়ানমার সংকট কীভাবে কাটানো যায়, তা নিয়েও দুই দেশ ঐকমত্যে পৌঁছেছে। মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগ কতটুকু কার্যকর হতে পারে?

এমদাদুল ইসলাম: ভূরাজনীতি বিষয়ে যাঁরা ওয়াকিবহাল তাঁরা জানেন, আরাকান আর্মি চীনের প্রভাবপুষ্ট। তাই আরাকান আর্মির বর্তমান অগ্রগতি ভারতের জন্য সুখকর খবর বয়ে আনেনি। কারণ, বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের ভূকৌশলগত প্রকল্প ‘কালাদান মাল্টিমোডাল মাল্টি ট্রানজিট প্রজেক্ট’ ঝুঁকিতে। এ প্রকল্প উত্তর-পূর্ব ভারতকে কলকাতা-সিত্তে-প্লাটোয়ার মাধ্যমে ভারতীয় মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযোজিত করার কথা। আরাকান আর্মি ইতিমধ্যে এর মূল গন্তব্যস্থল প্লাটোয়া তাদের দখলে নিয়েছে। এ পরিস্থিতি বাংলাদেশকে ভূরাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক এক জটিল চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছ।

প্রথম আলো:মিয়ানমারের চলমান সংকটে বাংলাদেশের ঝুঁকির দিকগুলো কোথায়। আর এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান কী হতে পারে?

এমদাদুল ইসলাম: মিয়ানমারের চলমান সংকটে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকির জায়গাটি তৈরি হয়েছে রাখাইনে সশস্ত্র সংঘাত এবং এর থেকে সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দুই বৃহৎ প্রতিবেশীর মধ্যে ভূরাজনৈতিক স্বার্থের যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হবে, তাতে বাংলাদেশের নিজেদের স্বার্থের অবস্থান বজায় রাখাটাই মূল চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে ভবিষ্যতে যে কেউ বাংলাদেশকে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। এ প্রেক্ষাপটে কৌশল, দূরদর্শিতা ও কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সম্ভব হলে বাংলাদেশকে রাখাইন অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। সে উদ্যোগ হয়তো বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথও খুলে দিতে পারে।

প্রথম আলো:অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশ সরকারের উচিত মিয়ানমারের আরাকান আর্মিসহ বিবদমান যে গোষ্ঠীগুলো আছে, তাদের সঙ্গে একটা যোগাযোগ রক্ষা করা। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি রেখে এটা করা দরকার। মিয়ানমার সরকারের বাইরে একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ রক্ষার ধারণা কতটা যৌক্তিক?

এমদাদুল ইসলাম: মিয়ানমার বিবদমান গোষ্ঠী অনেক। এর মধ্যে অং সান সু চির সমর্থক এনইউজি, শানদের শান ন্যাশনাল আর্মি, কারেন লিবারেশন আর্মি, আরাকান আর্মি উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশের সন্নিহিত অঞ্চল আরাকান বা রাখাইনে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মি সংঘাতে লিপ্ত। অন্য বৃহৎ ভূরাজনৈতিক শক্তিগুলোর মতো বাংলাদেশে এখনো মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বা কোনো ভূরাজনীতিতে নিজেকে সম্পৃক্ত করেনি। বাংলাদেশের যোগাযোগ মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে। রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক, কূটনৈতিক যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ—সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে।

তবে মিয়ানমারের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ অপ্রত্যক্ষভাবে আরাকান আর্মির সঙ্গে একটি কাজ চালানোর মতো একটি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে আরাকান আর্মির সংশ্লিষ্টতা এবং ভারতের সঙ্গে বৈরী সম্পর্কের বিষয়গুলো মাথায় রেখে পদক্ষেপ নিতে হবে।

আরাকান আর্মির নর্দান অ্যালায়েন্স বা বর্তমান ফ্রেন্ডশিপ অ্যালায়েন্স সূত্রে, কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মি, ওয়া এবং তাং আর্মির সঙ্গে ভূকৌশলগত সম্পর্কের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। তবে সার্বিক বিবেচনায় মিয়ানমারের বর্তমান সামরিক জান্তার সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে শীতলতা প্রদর্শন এবং বিবদমান গ্রুপগুলোর সঙ্গে প্রকাশ্যে যোগাযোগের সময় এখনো আসেনি। আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে গোয়েন্দা মাধ্যমকে কাজে লাগানো যায়, কূটনৈতিকভাবে নয়।

প্রথম আলো

Exit mobile version