Site icon The Bangladesh Chronicle

রশিঝোলা, লকডাউন, চোরের খনি


এবার বাংলাদেশে ঈদুল ফিতর, তথা সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় উৎসব, কাটল সুদূর ফিলিস্তিনে ইসরাইলের অবর্ণনীয় নারকীয় হামলা এবং এর বিপরীতে, গাজা থেকে সাধ্যমতো হলেও সীমিত জবাব আর অদূরবর্তী ভারতে কোভিড মহামারীর দ্বিতীয় তরঙ্গ ও ভাইরাসটির নয়া ধরনের নজিরবিহীন ও অবাধ মারণতাণ্ডবের মাঝে। বাংলাদেশে মহামারী দমনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কর্তৃপক্ষীয় সতর্কবাণী বরাবরের মতো ঈদের সময়েও চরমভাবে উপেক্ষিত হলো ঐতিহ্যগত সামাজিকতার টানে। সারা বছরের দুর্বৃত্তপনা (অপরাধের হরেক কিসিম) এবং সড়ক দুর্ঘটনার হিড়িক এই ঈদেও কমেনি। আপনজন হত্যা আর অজ্ঞান পার্টির উপদ্রব শুধু নয়, সারা বছরের বাদুড়ঝোলা যাতায়াতের পুনরাবৃত্তি দেখা গেছে পানির ওপর দিয়ে রশিঝোলা হয়ে ফেরি চড়ে ঈদে গ্রামে যাওয়ার দৃশ্যে।

এ দিকে মসজিদে ঈদের নামাজ সীমাবদ্ধ রাখা না রাখার প্রহসনের মাঝে মসজিদের ছাদ থেকে মুসল্লির পতনজনিত মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে গেছে। অপর দিকে লাখ লাখ মানুষের বাড়ি যাওয়া ঠেকাতে না পেরে এখন কর্তৃপক্ষ তাদের বলছেন, দেরি করে (ফেরিযোগে কিংবা অন্য উপায়ে) ঢাকায় ফিরতে। ঢাকাবাসী যখন ঈদের দিন প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস করছিলেন, তখন চট্টগ্রাম মহানগর প্রবল বর্ষণে জলাবদ্ধতার শিকার। এ পানির মাঝে ছাতা মাথায় টিভি সাংবাদিকের বার্তা প্রেরণ আর মহিলাদেরও পানি ভেঙে রাস্তায় যাতায়াত উল্লেখযোগ্য।

ঈদের ক’দিন আগে থেকেই হুঁশিয়ারি সরকারের, ‘মসজিদের বাইরে যেন ঈদের জামাত না হয়।’ এটা মহামারী রোধের সদুদ্দেশ্যেই করা হয়েছে। তবে একই উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের বহু উন্নত দেশ বিশেষজ্ঞদের মতো বলেছে, ধর্মীয় বা সামাজিক কোনো সমাবেশ করলে তা বদ্ধ ঘরে নয়, খোলা জায়গাতেই করা চাই। এমনকি আমেরিকার মতো উন্নত দেশে চুল ছাঁটার সেলুন অথবা মেয়েদের খোঁপা বাঁধার পার্লার- এসব দোকান আবদ্ধ কক্ষে না করে সম্ভব হলে খোলা গ্যারেজে বা পার্কিং প্লেসে করতে বলা হয়েছে। এমন বিউটি পার্লারের ছবি মিডিয়াতেও দেখা গেছে সম্প্রতি।

কর্তৃপক্ষের সাবধানবাণী মেনে শুক্রবার সকালে পাড়ার মসজিদে গেলাম ঈদের জামাতে শামিল হওয়ার জন্য। নামাজের জামাতের নির্ধারিত সময়ের কিছুক্ষণ আগে গিয়েও মসজিদের ১, ২ ও ৩ তলায় জায়গা পেলাম না। চতুর্থ তলাটাই এ মসজিদের শেষ। সে তলার শেষদিকে অর্থাৎ পেছনে ঠাঁই পেলাম কোনো মতে। উচিত ছিল, জনবসতি বেশি হলে মসজিদে একাধিক জামাত করা। তাহলে সবাই স্বস্তিতে নামাজ আদায় করতে পারতেন। এবার অনেকে বাড়িতে যেতে না পারায় ঢাকায় ঈদের জামাতে সমাগম বেশি হবে, এটা জানা ছিল সবার।

নামাজের পর দেখি, ‘ভেতরে ফিটফাট; বাইরে সদরঘাট।’ অর্থাৎ, মসজিদের ভেতরে অনেকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে গিয়ে দু’পাশে জায়গা ফাঁকা রাখলেও রাস্তায় মুসল্লির সে কী ভিড়। মাস্ক পরায় মজ্জাগত অনীহা ঈদের দিনেও বহাল ছিল জনগণের শতকরা ৯০ ভাগের। তদুপরি, কেউ কেউ সবার সাথে হাত মেলানোর জন্য অস্থির ছিলেন। কনুইর সাথে কনুই মেলানোর নিয়ম মানতে কেউ আগ্রহ দেখাননি। খোদ রাজধানীতেই যদি এ অবস্থা হয়, ঢাকার বাইরের কী হাল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বুঝতে হবে, টিভির ক্যামেরায় যা দেখা যায়, এর বাইরে বিরাট দেশ ও দুনিয়া পড়ে আছে।

মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী ঈদের আগের সাঁঝে টিভিতে ভাষণ দিয়েছেন। তিনি ঠিকই বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মতো দেশে লকডাউন পুরো দেয়া সম্ভব নয়। কারণ সরকারকে জীবনের সাথে জীবিকার কথাও ভাবতে হয়।’ কথা হলো, মহামারীকে ঠেকাতে হলে আগে মানুষের ইচ্ছামতো চলা (যেমন মাস্ক না দেয়া, স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনীহা, সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখা, ছুটি পেলে গ্রামের দিকে দলে দলে ছোটা, ঘরে থাকতে না চাওয়া) ঠেকাতে হবে। তা করা চাই যে কোনো মূল্যে।

ভারত ঠেকে শিখে এখন বলতে বাধ্য হচ্ছে- ‘যে কোনো মূল্যে দেশের প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে হবে।’ যেন আমরা সে পর্যায়ে পৌঁছে না যাই। গত বছরের মাঝামাঝি চীন থেকে একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসেছিল কোভিড মহামারীর হাল অবস্থা দেখার জন্য। কিন্তু এ দেশে লকডাউনের ‘ডাউন’ অবস্থা দেখে তারা বিস্মিত, বিক্ষুব্ধ ও বিব্রত হন। কারণ আমাদের দেশে লকডাউন শুরু থেকেই যেন ‘বগ্ডাউন’। এতে যতটা না কড়াকড়ি, তার চেয়ে বেশি ছাড়াছাড়ি। চায়নাম্যানরা এটা দেখে বিভ্রান্ত। তাই বলতে হয়, প্রয়োজনে ‘ডাণ্ডা লাগিয়ে ঠাণ্ডা করা’র বিকল্প নেই জীবনের স্বার্থে।

সরকার বলছে, ‘লকডাউনের সময়ে পুলিশকে বিচারিক ক্ষমতা দেয়া হবে যাতে সবাই মাস্ক পরে।’ এটা না বলে উপায় ছিল না। আসলে দরকার প্রশাসনের অ্যাকশন বা কঠোর পদক্ষেপ। তাহলেই মানুষ ‘কশান’ বা সতর্কতার গুরুত্ব বুঝবে। বুঝতে হবে, জীবন না থাকলে জীবিকাও থাকার প্রশ্নই ওঠে না।

মোবাইল কোর্টের কড়াকড়ি কোথায় যায় মাস্কের বেলায়? রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে ক্র্যাকডাউন, তা তো আগে দরকার ‘লকডাউন’ কার্যকর করার জন্য। অন্যথায়, মাস্ক যতই ফ্রি দেয়া হোক না কেন, তা পকেট থেকে মুখে উঠবে না। বড় জোর থুতনির তলায় পড়ে থাকবে কিংবা কানেই ঝুলবে। এ দেশে মানুষের শেষ নেই। তেমনি অবধি নেই মাস্ক না পরার জন্য অজুহাতের। কিন্তু করোনাকালে মাস্ক না পরে যে চলার উপায় নেই।

দেশের সরকারপ্রধান খুব খাটছেন মহামারী, সরকার, স্বদল, স্বদেশ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, প্রভৃতি নিয়ে। এমনটাই জনগণ জানে এবং তাদের জানানো হয়েছে। তবুও যেন কুলানো সম্ভব হয় না। কারণ সরকার-পরিবার-প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি হলো সম্মিলিত কর্ম বা Team work. গণতান্ত্রিক সরকারে সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সাধ্যমতো তৎপর থাকতে হয়। তা হলে নিয়মনীতি, আইনকানুন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা পায় এবং দুর্নীতি-অরাজকতা দূর হয়ে সুশাসনের পথ হয় সুগম। আমাদের দেশে অপচয়, আত্মসাৎ, অনিয়ম, অসততা, দুর্নীতি, দলবাজি প্রভৃতি না থাকলে অন্য বহু দেশের মতো আমরাও এই করোনাকালে সব দরিদ্র-দুস্থকে বেকার ভাতা দিতে পারতাম। কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম বলে জরুরি প্রণোদনার অর্থও প্রত্যাশিত গন্তব্যে পৌঁছে না। মনে পড়ে, দেশের মহান স্থপতি বলেছিলেন, ‘চাটার দল সব খেয়ে শেষ করে ফেলছে। সবাই পায় সোনার খনি; আমি পেয়েছি চোরের খনি।’ অনেকে বলে থাকেন, সে খনি এখন ফুলে ফেঁপে ‘মহাখনি’। তা হলে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার ‘সোনার মানুষ’ কিভাবে মিলবে?

বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এ বছরও বিবিধ ঈদ প্রোগ্রাম প্রচার করেছে। এর মধ্যে ছিল কুরআন-হাদিসের বাণী, দোয়া-দরুদ, আলোচনা, মাসায়েল ও প্রশ্নোত্তর, কালামে পাক থেকে তিলাওয়াত, হিফজ প্রতিযোগিতা, ইফতারি তৈরি ও বিপণন, প্রভৃতি। রোজার মাসের শেষদিকে নিজ নিজ চ্যানেলে ঈদের নাটকসহ বিনোদনের হপ্তাখানেকের অনুষ্ঠান প্রচার মুখ্য হয়ে ওঠে। একটি বিশিষ্ট চ্যানেলের ইফতারি-পূর্ব অনুষ্ঠানের সূচনা হতো একজন তরুণীর নৃত্যরত পায়ের নূপুর নিক্কনের ছবি দিয়ে। আমি নিজে একাধিকবার এর সমালোচনা করে লিখেছি। আরো কেউ কেউ লিখে থাকতে পারেন। হয়তো এসবের সম্মিলিত সুফলস্বরূপ এখন আর সে দৃশ্য দেখানো হয় না। তবে মাহে রমজানে ইফতারের কিছুক্ষণ আগে যে সফরনামা প্রচার করা হয়, তা সব সময়ে ইসলামসম্মত মনে না হওয়ার কারণ ছিল। কোনো কোনো দিন আঁটসাঁট পোশাকের যুবক-যুবতী পর্যটকের ছবি; কখনোবা নিছক মূর্তির ছবি ইত্যাদি দেখানো জরুরি ছিল না। এসব দৃশ্য ভালোভাবে সম্পাদনা করে সম্প্রচার করাই সমীচীন। না হয়, উপলক্ষের সাথে সম্প্রচারের ধরনের সঙ্গতিহীনতা দৃষ্টিকটু ও প্রশ্নবোধক হবে বৈ কি।

কোনো কোনো চ্যানেলের রোজার মাসে রান্নাবান্নার প্রোগ্রাম বিকেলে নিয়মিত প্রচার করা প্রশংসনীয়। নতুন নতুন রেসিপি এ অনুষ্ঠানে তুলে ধরা হয়েছে। অবশ্য বিশিষ্ট যেসব নারী ও পুরুষ এতে ছিলেন আমন্ত্রিত, তাদের কারো মাথায় ঘোমটা কিংবা (পুরুষের) টুপি দেখিনি। তা ছাড়া কোনো আলেম বা ইসলামী ব্যক্তিত্বকে কি মাহে রমজানে একটি দিনেও আমন্ত্রণ জানানো যেত না?

সাধারণত আমাদের দেশে সৌদি আরব, অর্থাৎ মক্কা-মদিনার পরদিন ঈদ পালিত হয়ে থাকে। এটাকেই নিয়ম বা স্বাভাবিক বলে সরকার ও সমাজ ধরে নিয়েছে। কেন এটা করা হলো কিংবা যুক্তি ও বিজ্ঞান কী বলে, এসব বিষয় অনেকটা Taboo হয়ে রয়েছে অজ্ঞাত কারণে। মিডিয়াও এ নিয়ে মুখ খুলে ‘বিপদে পড়তে’ চায় না। এক ধরনের status quo বজায় রাখতে সবাই সতর্ক। তবে ইদানীং অনেকেই কথা বলতে শুরু করেছেন। এটা অস্বাভাবিক নয়। তাই অবিলম্বে উম্মাহর ঐকমত্যের নিরিখে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন ঈদের উদযাপন প্রসঙ্গে। অন্যথায় মুসলমানদের মাঝে বিভাজন বাড়বে এবং প্রতিপক্ষ এ অনৈক্যের অন্যায় সুযোগ নিতে পারে। কারণ দিন দিন ভিন্ন মত বাড়ছে এবং বাংলাদেশেরও বহু জায়গায় এক দিন আগেই ঈদ উদযাপিত হয়ে যেতে দেখা যায়। এটা দুঃখজনক ও দৃষ্টিকটু। এবারো উত্তরে দিনাজপুর থেকে দক্ষিণে বরিশাল পর্যন্ত নানা স্থানে ঈদের জামাত ও উৎসব হয়েছে দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে এক দিন আগে। জ্ঞানী, গবেষক, ইসলামী ব্যক্তিত্বদের কারো কারো মাঝেও এ প্রবণতার প্রভাব পরিদৃষ্ট হয়েছে। তাই ‘ঢাক ঢাক গুড় গুড়’ নীতি নয় এ বিষয়ে ওআইসির সিদ্ধান্ত থাকলে, তা জানিয়ে দেয়া দরকার। আল কুরআন ও সুন্নাহমাফিক জীবনের সব ক্ষেত্রে চলার পথ সুগম হোক, এটাই আমাদের ঐকান্তিক প্রত্যাশা। একজন বিশেষজ্ঞ মিডিয়াকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের পশ্চিমের দেশগুলোকে খালি চোখে আর পূর্বের দেশগুলো দুরবিন দিয়ে ঈদের চাঁদ দেখতে হবে।’ প্রশ্ন হলো, যদি দুরবিন আর চোখের দৃষ্টি মিলে যায়, তাহলে আমরা কোন দিন ঈদ করব? সাধারণ মানুষ নিজেদের ‘বিশেষ অজ্ঞ’ মনে করে থাকে, ‘বিশেষজ্ঞ’ নয়।

Exit mobile version