Site icon The Bangladesh Chronicle

রফতানি তথ্যে অসংগতির দায় নিতে চায় না কেউ

দেশের রফতানি আয় নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে রয়েছে ভিন্ন তথ্য। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরের রফতানি নিয়ে যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তার পার্থক্য প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার বা ২১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ইপিবির প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে গত অর্থবছরে বিশ্ববাজারে ৫ হাজার ৫৫৫ কোটি বা সাড়ে ৫৫ বিলিয়নের বেশি ডলারের পণ্য রফতানি হয়। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, একই সময়ে রফতানি বাবদ ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ ৪ হাজার ৩৫৭ কোটি ২০ লাখ বা সাড়ে ৪৩ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। পণ্য রফতানি ও প্রাপ্ত অর্থের এ পার্থক্য প্রতি বছরই বাড়ছে কিন্তু পরিসংখ্যানগত তথ্যের এ অসংগতির দায় সংশ্লিষ্ট কেউ নিতে চায় না।

জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আইএমএফ থেকে কিস্তিতে বছরে খুব বেশি হলে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার আসবে। সেখানে আমাদের রফতানির তথ্যে ১২ বিলিয়ন ডলারের পার্থক্য। কারোর কোনো মাথাব্যথা নেই? বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমুন্নত রাখতে যখন নানামুখী প্রচেষ্টা রয়েছে, তখন রফতানি আয়ের পার্থক্যের পরিমাণটা একটা লো হ্যাংগিং ফ্রুট। এটার একটা সমাধান করতে পারলে রিজার্ভের বড় একটা সাশ্রয় হয় এবং সেটা করাও উচিত। এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক, ইপিবি—এ তিন সংস্থা মিলে একটা শক্তিশালী কমিটি করে বিস্তারিত কারণ অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।’

সরকারি সংস্থাগুলোর তথ্যে রফতানি আয়ের পার্থক্যের বিষয়ে ২০ ডিসেম্বর ইপিবিতে একটি বৈঠক হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনস অথরিটি (বেপজা), পরিসংখ্যান ব্যুরো, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা। পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএসহ ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সদস্যরাও ছিলেন। সেখানে পরিসংখ্যানগত পার্থক্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় বলে সূত্র জানিয়েছে। কিন্তু পরিসংখ্যানগত পার্থক্যের দায় রফতানিকারক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থাই নিতে চাইছে না। তাদের পক্ষ থেকে কেবল রফতানির পরিসংখ্যানগত অসংগতির সম্ভাব্য কারণগুলোই তুলে ধরা হয়।

আলোচনায় উঠে আসে বেপজা থেকে যেসব পণ্য দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন কারখানা কেনে তার সবই রফতানি হিসাবে তথ্যভাণ্ডারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু বিদেশ থেকে কোনো অর্থ আসে না এবং আসার কোনো সুযোগ নেই। কেননা সেগুলোর অর্থ পরিশোধ দেশের মধ্যেই হয়ে থাকে। আবার এক ইপিজেড থেকে অন্য ইপিজেডে কোনো কাঁচামাল গেলে সেগুলোও রফতানি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করে যখন আবার দেশের মধ্যে বিক্রি হয় তখনো রফতানি ধরেই হিসাব করা হয়। ইপিজেড থেকে ইপিজেডে এবং দেশের অভ্যন্তরে মোট রফতানির পরিমাণ আনুমানিক ৫ থেকে ৭ বিলিয়ন। এ কারণেই রফতানি আয়ে বড় একটা পরিসংখ্যানগত পার্থক্য হচ্ছে।

এদিকে বেপজা সূত্র জানিয়েছে, ইপিজেডগুলো থেকে মোট রফতানি যা হয় তার বড় অংশই সরাসরি বিদেশে পাঠানো হয়। এছাড়া দেশের ভেতর রফতানিমুখী কারখানায়ও ইপিজেড থেকে পণ্য যায়। আবার ইন্ট্রা-জোন ও ইন্টার-জোন পদ্ধতিতেও রফতানি হয়। বড় অংশই যেহেতু সরাসরি বিদেশে পাঠানো হয়, কাজেই অভন্তরীণ রফতানির হিসাবটা ৫-৭ বিলিয়ন ডলার বলার সুযোগ নেই।

বেপজার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইপিজেডগুলো থেকে মোট রফতানির অর্থমূল্য ছিল ৭৮৪ কোটি ৩১ লাখ ৪০ হাজার ডলারের। এর মধ্যে সরাসরি বিদেশে রফতানি হয়েছে ৬৪৬ কোটি ১২ লাখ ডলারের। রফতানিমুখী কারখানায় রফতানি হয়েছে ১০৭ কোটি ডলারের পণ্য। ইন্ট্রা-জোন রফতানির অর্থমূল্য ১৩ কোটি ৪৫ লাখ ডলারের। আর ইন্টার-জোন পণ্য রফতানির অর্থমূল্য ছিল ১৭ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের।

সভায় এও আলোচনা করা হয় যে ইপিবি সোনালি ব্যাংকের বিনিময় হার ধরে রফতানি মূল্য টাকায় হিসাব করে। এ বিনিময় হার বাংলাদেশ ব্যাংকের রফতানি রেটের চেয়ে কম, এক্ষেত্রেও পরিসংখ্যানগত পার্থক্য হচ্ছে। এছাড়া শর্ট শিপমেন্ট, ডিসকাউন্ট, বিদেশী ব্যাংকের চার্জ ও রফতানি পণ্য ফেরত আসার তথ্য ডাটাবেজে রয়ে যায়। এভাবেও পরিসংখ্যান অসংগতি সৃষ্টি হচ্ছে।

কোনো রফতানি চালান শুল্ক বিভাগে অন্তর্ভুক্ত হলে অর্থাৎ শিপিং বিল হলে ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত হয় কিন্তু এর অনেক চালান আদৌ জাহাজীকরণ হয় না। অথবা পরে নতুন শিপিং বিলের বিপরীতে রফতানি হয় অথবা ভিন্ন বন্দর বা আকাশপথে যায়। কিন্তু আগের শিপিং বিল ডাটাবেজে থেকেই যায়। এক্ষেত্রেও পরিসংখ্যানগত একটা অসংগতি রয়ে যায়।

কাটিং অ্যান্ড মেকিং (সিএম) ভিত্তিতে যেসব পণ্য রফতানি হয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে ক্রেতা বিনামূল্যে কাঁচামাল পাঠিয়ে দেয়। রফতানিকারক শুধু চুক্তি অনুযায়ী সিএম চার্জ পেয়ে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় কাঁচামাল যখন বন্দরে বিনামূল্যে ছাড় করা হয়, তখন শুল্ক বিভাগকে ফ্রি অন বোর্ড (এফওবি) মূল্য দেখাতে হয় এবং ওই মূল্যেই অ্যাসেসমেন্ট হয়। আর যখন চূড়ান্ত পণ্য রফতানি হয়, তখন ওই কাঁচামালের মূল্যের সঙ্গে সিএম চার্জ যোগ করে এফওবি মূল্য দেখাতে হয়। ফলে ডাটাবেজে এফওবি রফতানি মূল্য থাকলেও অর্থ পরিশোধ হয় সিএম বাবদ। এখানেও বড় একটি পরিসংখ্যানগত অসংগতি থেকে যাচ্ছে বলে আলোচনায় উঠে আসে।

ইপিবির ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মুনির হোসেন। জানতে চাইলে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘তথ্যের পার্থক্যের কারণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কারিগরি দল খুঁটিনাটি বিচার-বিশ্লেষণ করে পার্থক্যের কারণ চিহ্নিত করার পাশাপাশি তা নিরসনে করণীয় ঠিক করবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়। আমরা চাইছি কোনো পণ্য রফতানির পর অর্থ না এলে তা সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করে পদক্ষেপ নেয়া হোক। পার্থক্যের দায় সব রফতানিকারকের ওপর বর্তাবে সেটা আমরা চাই না।’

পরিসংখ্যানগত পার্থক্য নিরসনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রফতানিবিষয়ক অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি রয়েছে। এরই মধ্যে তারা এসব বিষয় আরো গভীরভাবে খতিয়ে দেখে যথাযথ ও যৌক্তিক সুনির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত করতে কাজ শুরু করেছে। এ বিষয়ে তাদের প্রতিবেদন ও সুপারিশ সংশ্লিষ্ট কমিটির কাছে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন ইপিবি-সংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান এএইচএম আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পরিসংখ্যানগত সমস্যার দায় কার তা এখন পর্যন্ত চিহ্নিত করা যায়নি। টেকনিক্যাল টিমের সুপারিশ পাওয়ার পর আরো বিস্তারিত বিশ্লেষণ করবে এ-সংক্রান্ত কমিটি।’

ইপিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে যৌক্তিক কিছু কারণ রয়েছে বলে দাবি করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাদের মতে, ইপিজেড থেকে যে রফতানি, তা দেশের ভেতরেই বা ইনল্যান্ড হয়। ফলে সেটা একাধিকবার বা ডাবল কাউন্টিং হয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডাবল কাউন্টিং করে না। আবার ফেরত আসা পণ্য পুনরায় বা রি-এক্সপোর্টও হয়। এক্ষেত্রে যে ভ্যালু ধরা থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা বাদ দেয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বণিক বার্তাকে বলেছিলেন, ‘গ্যাপগুলো আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। কমিটি যদি সুন্দরভাবে কাজ করে একটা ভালো রিপোর্ট দিতে পারে, তাহলে এর প্রকৃত কারণ শনাক্ত করা যাবে।’

বনিক বার্তা

Exit mobile version