Site icon The Bangladesh Chronicle

রং-সাইডের লাট সায়েব এবং তাজ্জব হিসাব

রং-সাইডের লাট সায়েব এবং তাজ্জব হিসাব
===================
( দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত উপ সম্পাদকীয় কলাম )

স্বনামধন্য রম্য লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর অমর সৃষ্টি ‘পণ্ডিতমশাই’। ‘সেই পণ্ডিতমশাই যত না পড়াতেন, তার চেয়ে বকতেন ঢের বেশি এবং টেবিলের ওপর পা দু’খানা তুলে দিয়ে ঘুমুতেন সবচেয়ে বেশি। বেশ নাক ডাকিয়ে এবং হেডমাস্টারকে একদম পরোয়া না করে। কারণ হেডমাস্টার তার কাছে ছেলেবেলায় সংস্কৃত পড়েছিলেন এবং তিনি যে লেখাপড়ায় সর্বাঙ্গ নিন্দনীয় হস্তিমূর্খ ছিলেন, সে কথাটি পণ্ডিতমশাই বারবার অহরহ সর্বত্র উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করতেন।’

একদিন সেই স্কুল পরিদর্শন করার জন্য এক বিলাতি ইন্সপেক্টর আসেন। সামান্য ইন্সপেক্টর হলেও নেটিভদের চোখে লাট সাহেব কিংবা লাট সায়েব হিসেবে গণ্য হতেন। লাট সায়েবের দলবলের মাঝে তার কুকুরটিও ছিল। পরিদর্শনের তিন দিন পর পণ্ডিতমশাই ক্লাসের ছাত্রদের জিজ্ঞেস করেন, কুকুরটার কী বৈশিষ্ট্য ছিল বল্ তো?

ছাত্রদের মধ্য থেকে লেখক জবাব দেন, আজ্ঞে, একটি ঠ্যাং কম ছিল বলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল।’

পণ্ডিতমশাই জানতে পেরেছিলেন যে এই তিনপাওয়ালা কুকুরটির জন্য লাট সায়েব ব্যয় করেন মাসে পঁচাত্তর টাকা। পণ্ডিত সাহেবের নির্দেশে লেখক বের করলেন যে, কুকুরটির একটি পায়ের জন্য লাট সায়েবের মাসে খরচ হয় পঁচিশ টাকা।
তখন পণ্ডিতমশাই আক্ষেপ করে বললেন, ‘অপিচ আমি, ব্রাহ্মণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী একুনে আটজন। আমাদের সকলের জীবন ধারণের জন্য আমি মাসে পাই পঁচিশ টাকা। এখন বল তো দেখি, তবে বুঝি তোর পেটে কত বিদ্যে, এই ব্রাহ্মণ পরিবার লাট সায়েবের কুকুরের ক’টা ঠ্যাঙের সমান ?’
সেই পণ্ডিতমশাই এবং লেখক এই দেশ ও দুনিয়া থেকে অনেক আগেই বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু সেই করুণ হিসাব ও আক্ষেপটি এখনো এই সমাজ থেকে দূরীভূত হয়নি। ব্রিটিশরা বিদায় নিলেও লাট সায়েবরা এখনো বহাল তবিয়তে টিকে রয়েছে। লাট সায়েবদের সম্পদ ও ক্ষমতার উৎকট ও যন্ত্রণাদায়ক প্রদর্শনী মহামারী আকার ধারণ করেছে।

এই লাট সায়েবদের মধ্যে যেমন বড় বড় লাট সায়েব রয়েছেন, তেমনি মাঝারি ও ছোট ছোট লাট সায়েবও অসংখ্য পয়দা হয়েছে। এই লাট সায়েবদের চরণে শুধু পাবলিকের সম্পদই অর্পণ করতে হয় না- চাহিবামাত্র দেশের খাদিজারা প্রেমনিবেদন করতেও বাধ্য। তা না হলে চাপাতির কোপে খাদিজাদের ক্ষতবিক্ষত হতে হয়। জাতির দুর্যোগে এরাই কাণ্ডারি, যদিও নিজেরাই জাতির জন্য একেকজন মহাদুর্যোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। লাট সায়েবরা সাত খুন করলেও মাফ। দুই বছর জেলে থাকলেও চেহারা থাকে এদের গোলাপের পাপড়ির মতো। ইয়াবা সম্রাটও এরা, ইয়াবার বিরুদ্ধে সংগ্রামের সিপাহসালাও তারা। পাবলিক শুধু পণ্ডিত সাবের মতো লাট সায়েব চলে গেলে তিন দিন পর কুত্তার ঠ্যাঙ নিয়ে হিসাবে বসে, আফসোস করে, নিজের মাথার চুল ছিড়ে। এভাবে নিজের মাথা খালি হয়, লাট সায়েবদের কিছুই হয় না।
বড় বড় লাট সায়েবরা যখন রাস্তা দিয়ে বের হন, তখন জনগণকে কয়েক ঘণ্টা দুর্বিষহ জ্যামে আটকা পড়তে হয়।

যারা মাঝারি ও একটু ছোট গোছের লাট সায়েব, তারাও নিজেদের আরামের জন্য রং-সাইড দিয়ে গাড়ি চালান। তখন ট্রাফিক পুলিশরা মুশকিলে পড়ে যান, ইনি কত বড় লাট সায়েব, তা ঠাহর করতে কষ্ট হয়। এমনি এক ছোট লাট সায়েবকে ( উপজেলা সভাপতিকে ) এক পুলিশ থামিয়ে দিয়েছিল। তখন ওই লাট সায়েব রেগেমেগে পুলিশকে বলে, ‘রং-সাইডে যাবই। তুই কে?’

এরকম একটি দুটি নয়, লাট সায়েবদের ক্ষমতার দাপটে পুরো দেশটিই অনেক আগে রং-সাইডে চলে গেছে। এই মগের মুল্লুকে কারো কিছু বলার নেই, কারো কিছু কওয়ার নেই।
বড় বড় লাট সায়েবদের একেকজনের সম্পদ শূন্য থেকে কয়েক হাজার গুণ বাড়লেও তার হিসাব দিতে সমস্যা হয় না। মৎস্য চাষ অথবা দুধেল গাভী পালনের মাধ্যমেই এই সম্পদ ও সৌভাগ্য তারা আহরণ করেছেন বলে জানানো হয়। কারো হিসাবের ডান পাশ থেকে কয়েকটি শূন্য কেটে ঠিক করা হয়। এই কিছিমের হিসাব যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সাদরেই গৃহীত হচ্ছে। দুদক এই লাট সায়েবদের পেছনে লাগে না। দুদকের চোখে সবচেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ মাহমুদুর রহমান কিংবা তার স্ত্রী।

পদ্মা সেতু থেকে আমরা বিশ্বব্যাংককে ‘গোলামের পুত গোলাম’ ডেকে তাড়িয়ে দিয়েছি। শতকরা .৭৫ শোধের বদলে শতকরা ৫ ভাগ শোধের ঋণ নিয়ে এই সেতু তৈরি করছি। এখন সেখানে কী হচ্ছে, তা কোনোদিন আমরা মালুম করতে পারতাম না। কিন্তু এর চেয়েও লম্বা একটা সেতু ইন্ডিয়াতে হওয়ায় একটু তুলনা টানতে সুবিধা হয়েছে। পণ্ডিত সাব যে আক্ষেপে বিলাতি লাট সায়েবের কুকুরের প্রতি ঠ্যাঙ বাবদ খরচ বের করেছিলেন- সেই একই আক্ষেপে এ দেশের মানুষ পদ্মা সেতুর প্রতি ঠ্যাঙ বাবদ খরচ বের করা শুরু করে দিয়েছে।
ভারতের ‘ভুপেন হাজারিকা সেতু’টি লম্বায় অনেক বেশি অথচ খরচ পদ্মা সেতুর চেয়ে অনেক অনেক কম। সরকারের ইমেজের রক্ষক (ড্যামেজ কন্ট্রোলার ) হিসেবে কিছু সুধী কাজ করছেন। এদের মধ্যে একজন স্বনামধন্য অভিনেত্রীর স্বামী ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। পদ্মা সেতু নিয়ে এই ড্যামেজ কন্ট্রোলাররা যে হিসাব ও মন্তব্যটি তাদের ফেসবুক পেইজে পোস্ট করেছেন, তা এখানে তুলে ধরা হলো।

* ভূপেন হাজারিকা সেতুর পাইললোড মাত্র ৬০ টন। সেখানে পদ্মা সেতুর পাইললোড ৮ হাজার ২০০ টন। ভারতের ওই সেতুর একেকটি পিলার ১২০ টনের। আর পদ্মা সেতুর একটি পিলার ৫০ হাজার টনের। সে হিসাবে ভারতের সেতুর চেয়ে পদ্মা সেতু হতে চলেছে ১৩৩ গুণ বেশি শক্তিশালী।
* বিশ্বের আর কোনো সেতু তৈরিতে পদ্মার মতো নদীর এতো তলদেশে গিয়ে পাইল গাঁথতে হয়নি, বসাতে হয়নি এত বড় পিলার। আর পদ্মার মতো স্রোতস্বিনী এমন নদীর ওপর বিশ্বে সেতু হয়েছে মাত্র একটি। পদ্মা সেতু তার অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য বিশ্বের সব চেয়ে ব্যতিক্রমী সেতু হবে। কারণ খরস্রোতার দিক দিয়ে আমাজান নদীর পরই বিশ্বে বাংলাদেশের পদ্মা নদীর অবস্থান, যার ওপর দিয়ে সেতু করা হচ্ছে।’

প্রিয় পাঠক, এবার মাথাটি ঠাণ্ডা করে কিছুক্ষণ ভাবুন। সম্ভব হলে গুগলসে গিয়েও একটু ঢু মেরে দেখতে পারেন। ভূপেন হাজারিকা সেতুটি করা হয়েছে ব্রহ্মপুত্র ও লোহিত নদীর ওপর দিয়ে। ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা দুটোই খরস্রোতা নদী। অনেক জায়গায় ব্রহ্মপুত্রের নামটি গঙ্গা বা পদ্মার নামের আগে চলে আসে। আর্টিকেলটি লেখার আগে আমি নিজেও ইন্টারনেটে অনেক ঘেঁটেছি। ‘আমাজনের পরে একমাত্র স্রোতস্বিনী নদী পদ্মার ওপরেই এরকম ব্রিজ হয়েছে’ এই তথ্যটি কোথা থেকে পাওয়া, তা জানা নেই। সত্যিই এটি একটি আজব দেশ। এখানে কিছু দাবি করতে হলে, কোনো তথ্য উপস্থাপন করতে হলে সাপোর্টিং ডকুমেন্টের দরকার পড়ে না। এ দেশে বুদ্ধিজীবী হতে হলেও মাথায় খুব একটা বুদ্ধি থাকার দরকার নেই। এই আজব হিসাবটি যে বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের বুদ্ধি খরচ করে বের করেছেন এবং এখনো যারা এর ওপর পূর্ণ ঈমান রাখছেন, তারা এ দেশে সবচেয়ে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হিসেবে পরিচিত। সেভাবেই নিজেদেরকে তুলে ধরেন।
ভূপেন হাজারিকা সেতুর পাইললোড মাত্র ৬০ টন, এই তথ্যটি এই মহাপণ্ডিতেরা কোথায় পেলেন? যে সেতুর ওপর দিয়ে ৬০ টন ওজনের ট্যাংক চলাচল করবে, সেই সেতুর পাইললোড আবার ৬০ টন হয় কী করে?

যাদের সামান্য ইঞ্জিনিয়ারিং নলেজ আছে, তারাও জানেন Factor of Safety অথবা Margin of Safety অথবা Reserve Strength বলে একটি কথা প্রকৌশল বিদ্যায় চালু রয়েছে। কোনো মেশিনারিজ বা স্থাপনাকে তার ওয়ার্কিং লোডের চেয়েও কয়েক গুণ বেশি শক্ত বা মজবুত করে তৈরি করা হয়। বিভিন্ন বাহনের স্ট্যাটিক ও ডাইনামিক ফোর্স ছাড়াও আরো অনেক ধরনের বাহ্যিক ও জটিল ফোর্স একটা ব্রিজের ওপর কাজ করে। সেসব বিবেচনায় যেকোনো ব্রিজের এই রিজার্ভ শক্তিটা অনেক অনেক বেশি রাখা হয়। অথচ আমাদের এই বুদ্ধিজীবীদের দাবি মতো, ভূপেন হাজারিকা ব্রিজের কোনো রিজার্ভ স্ট্রেংথ বা মার্জিন অব সেইফটি নেই! এরা ভূপেন হাজারিকা সেতুর অনুমোদিত লোড ৬০ টনকে (পদ্মা সেতুর মাত্রাধিক খরচকে জাস্টিফাই করার নিমিত্তে ) পিলার লোড হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছেন !

বিভিন্ন সূত্র থেকে স্পষ্ট হয়ে পড়েছে যে ভূপেন হাজারিকা থেকে পদ্মা সেতুর নির্মাণ খরচ বিশ থেকে ত্রিশগুণ বেশি। ডাক্তার ইমরান এইচ সরকার যে হিসাবটি উদ্ধৃত করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে এটি ৩৬ গুণ বেশি। কাজেই গোঁজামিল দিয়ে এই হিসাবটি টানা মোহাম্মদ এ আরাফাতদের জন্য এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। আরাফাতের ময়দানটি ছিল সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক। আমাদের এ আরাফাতরা জাতিকে এ কোন্ ময়দানে দাঁড় করিয়ে দিলেন?

ভূপেন হাজারিকা সেতুটি বানানোর পেছনে ভারতের একটি বিশেষ স্ট্র্যাটেজিক বা সামরিক উদ্দেশ্য কাজ করেছে। অরুণাচল প্রদেশটি নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে শুরু থেকেই যুদ্ধাবস্থা বজায় রয়েছে। উভয়েই এই অঞ্চলটিকে নিজেদের বলে দাবি করে। কিছু দিন আগে চীন এই প্রদেশের বিভিন্ন স্থানকে নিজেদের মতো নামকরণ করেছে। ভারতও ওই অঞ্চলে নিজের স্ট্র্যাটেজিক শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে।

সেই উদ্দেশ্য থেকে আসাম এলাকা থেকে অতি দ্রুত ভারী সামরিক যান চীন সিমান্তের দিকে নেয়ার জন্যই এই সেতুটি তৈরি করা হয়েছে। এই সেতুর ওপর দিয়ে ইন্ডিয়ান আর্মির অর্জুন হিসেবে বিবেচিত ৬০ টন ওজনের ট্যাংকগুলি চলাচল করতে পারবে। শত্রুপক্ষের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকেও এই সেতুটিকে রক্ষা করতে বিশেষভাবে মজবুত করা দরকার হয়ে পড়ে।

এই ধরনের স্ট্র্যাটেজিক টার্গেট পদ্মা সেতুকে ঘিরে বাংলাদেশের নেই। দ্বিতল (সড়ক ও রেলপথ ) বিশিষ্ট সেতুই যদি এই মাত্রাধিক খরচের কারণ হয় তাহলে কি দরকার ছিল এরকম কমপ্লেক্স ডিজাইন করার? ভূপেন হাজারিকা সেতুর মতো দুটি করে ফেললেই হতো। এই প্রশ্নগুলো আসে নেহায়েত কমনসেন্স থেকেই।

বলা হচ্ছে, পদ্মা সেতু ভূমিকম্পরোধক করতে গিয়ে এই অতিরিক্ত খরচটি হয়েছে। ভূপেন হাজারিকা সেতুটির জায়গায় ১৯৫০ সালে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়েছিল যার ফলে এখান থেকে ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ বদলে যায়। ফলে ভূপেন হাজারিকা ব্রিজের আশপাশের এলাকাটিও পদ্মা সেতু এলাকার মতোই কিংবা তার চেয়েও বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ভূপেন হাজারিকা সেতুতেও ভূমিকম্পের প্রতিরোধক ডিজাইন করা হয়েছে। ১৮২টি খাম্বার প্রতিটিতে বিশেষ সিস্মিক বাফার দেয়া হয়েছে। এ কাজের জন্য বিদেশ থেকে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিসহ বিশেষ হাইড্রলিক রিগ আমদানি করা হয়েছে। তারপরও আমাদের বুদ্ধিজীবীরা বলে দিলেন, ভূপেন হাজারিকা সেতু পদ্মা সেতুর চেয়ে ১৩৩ গুণ কম মজবুত!

এখন ট্রিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন, এসব বুদ্ধিজীবীর যুক্তি অনুযায়ী পদ্মা সেতুকে কেন ভূপেন হাজারিকা সেতু থেকে ১৩৩ গুণ বেশি মজবুত করা হলো?
আমাদের বিজ্ঞজনদের অধিকাংশ এখনও পড়ে পড়ে ঘুমান। আর মাঝে মধ্যে জেগে লাট সায়েবদের বিভিন্ন কীর্তি বিরস বদনে ও বিরক্ত নয়নে অবলোকন করেন। স্বর্ণব্যবসায়ী এক লাট সাহেবের ছেলের দৈনিক হাত খরচই দুই লাখ টাকা, মাসে হয় ষাট লাখ! তাদের জন্য আবার হেরেম খানার পরিবেশ তৈরি করেন অন্য এক লাট সায়েব ও তার পুত্ররা। এই লাট সায়েবদের লাইফ স্টাইল দেখে অরিজিনাল লাট সায়েবদের বাচ্চারাও চমকে ওঠে।

রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লোপাট হলে এক লাট সায়েব বলেন, এই টাকা পি-নাট মাত্র। অথচ কয়েক হাজার টাকা বেতন বাড়ানোর দাবিতে শিক্ষকরা আন্দোলনে নামলে সেই একই সায়েবরা নোংরা ও বিষাক্ত মরিচপানি নিক্ষেপ করেছিলেন।
অনেক পাঠক এবং আমার কিছু বন্ধুবান্ধব পরামর্শ দেন যে, আমি যখন আওয়ামী লীগের লুটপাট নিয়ে কথা বলি তখন যেন দয়া করে বিএনপির লুটপাট নিয়েও কিছু কথা যোগ করি। বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সব ফেরেশতা বসে রয়েছে, এই ধরনের কথা আমি কখনোই বলিনি, বরং বলেছি যে তারাও একই জনগোষ্ঠী থেকে এসেছে। একই ধরনের সুযোগ পেলে এরাও একইরূপ বিহেইভ করতে পারে।

ব্যক্তির পরিবর্তনের চেয়ে বেশি দরকার সিস্টেমটি পরিবর্তন করা। এক সময় এই দেশে হয়ত আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি বলে কিছু থাকবে না। কিন্তু দেশটিকে টিকে থাকতে হবে। কোনো ব্যক্তির মেজাজ মর্জির ওপর ছেড়ে না দিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রতিরোধে কনস্ট্রাকশনাল প্রিভেনশন বা কাঠামোগত প্রতিরোধে আমি বিশ্বাস করি। এ জন্য প্রথম দরকার মুক্ত গণমাধ্যম। মতলববাজ মাধ্যম নয়।

সুযোগ মানুষকে চোর বানায়। আওয়ামী লীগ বামপন্থী কিছু রাজনীতিবিদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একদলীয় ভ্রান্ত রাজনৈতিক দর্শনে তাড়িত হয়ে এই সুযোগটি বারবার করে দেয়। ফলে প্রতিবার ক্ষমতায় বসার পর রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুটপাটের মহাযজ্ঞ শুরু হয়ে যায়। এই রোগটি অনেকে ধরতে পারেন না বলে আমাকে আওয়ামীবিদ্বেষী গণ্য করেন। এ যাবৎ আওয়ামী লীগের তুলনামূলক গণতান্ত্রিক ও ভালো সরকারটি ছিল ১৯৯৬-২০০১ এর সরকার। কারণ এই সরকারে বামদের প্রভাব কম ছিল।

বামেরা বিরোধী দলে থাকতে গণতান্ত্রিক। কিন্তু ক্ষমতায় বসার পর সেই গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠায়। এরা বিভিন্ন চেতনার দোহাই দিয়ে মানুষের কণ্ঠকে স্তব্দ করে দেয়। একসময় এই লুটপাটের বিরুদ্ধে যারা দাঁড়াবে এরা তখন তাদেরকে চেতনাবিরোধী ও জঙ্গি হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেবে।
বিএনপি, আওয়ামী লীগ কিংবা সুশীলপন্থী সবাইকে বুঝতে হবে যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধটি হলো একটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক সংগ্রামের যোগফল। এই চারটির কোনো একটি প্রচেষ্টা কোনো সমাজে অবহেলিত কিংবা অবদমিত হলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম অকার্যকর হয়ে পড়ে। আর্থিকভাবে চরম অসচ্ছল একটি জনগোষ্ঠীর কাছে নৈতিকশিক্ষা অর্থহীন বুলির মতো। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে সফল হতে হলে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো সবার আগে পূরণ করতে হবে। আর মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী শাসকশ্রেণীর পরিবর্তন জরুরি। এই সিস্টেম চালু হলে প্রতিটা দল ভালো ও সৎ মানুষগুলোকে নেতৃত্বে আনতে বাধ্য হবে। অন্য দিকে, গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হলে বাজিকরদের হাতে দেশের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে।

একই সাথে জনগণ সচেতন না হলে রাজনীতির জায়গায় অপরাজনীতি বা অতিরিক্ত রাজনীতি শুরু হয়। জনগণ গণশত্রু বা আসল কাউয়াকে চিনতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। উপরের তিনটি ঠিক থাকলে সেই সমাজে নৈতিক শিক্ষা ফাইন টিউনিংয়ের কাজটি করে থাকে।
সেই ২০০৭ সাল থেকেই একটি কথা বলে এসেছি। আজকের মহাশক্তিধর এবং নেত্রীর অত্যন্ত প্রিয় কেউ কেউ যখন বিশেষ জায়গায় বসে চা বিস্কিট খেতে খেতে অনেক কথা বলে ফেলেছিলেন, তখনো এই অধম মাইনাস টু’র বিরুদ্ধে সবচেয়ে নাজুক সময়ে এই কলামেই রুখে দাঁড়িয়েছিল। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আমার মতো অনেকের ক্ষোভ- তারা এই প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিরোধের মেকানিজমটি ধ্বংস করেছে।

এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায়, নির্বাচন সহায়ক একটি সরকার। রং-সাইডের লাট সায়েবদের রাইট-সাইডে আনতে এর কোনো বিকল্প নেই। জনগণের ভোটের অধিকার জনগণকে ফিরিয়ে দিতে হবে। বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধীদল এই দাবিটি তুলেছে। কিন্তু নির্বাচনসহায়ক সরকারের অবয়ব এখনো পরিষ্কার করেনি। আমি নিজেও নয়া দিগন্তে একটি প্রস্তাব রেখেছিলাম। আমাদের সেনাবাহিনীকে মূল ভূমিকায় রেখে এবং জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে, আমাদের সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই একটি নির্বাচন সহায়ক সরকার গঠিত হতে পারে। সেই মেকানিজম এখন শুধু বিএনপির নয়, ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগেরও কাজে লাগবে। তাতে জাতিও এক মহাযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে। নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করতেও জাতিসঙ্ঘের এই শান্তিরক্ষীবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। নতুন সরকার গঠনের পরবর্তী তিন মাস এই শান্তিরক্ষী বাহিনী তাদের অবস্থান বা কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে পারে। পর পর পাঁচবার এই পদ্ধতি প্রয়োগ করলে এবং গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উন্মুক্ত থাকলে আশা করা যায়, আমরা একটা স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে উত্তরণ করতে পারব।

দেশটি আসলেই উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করছে। বর্তমান সরকার ব্রেক কষে এর গতি রোধ করে রেখেছে। এই ব্রেকটি রিলিজ করলেই তা কাঙ্খিত গতিতে চলতে থাকবে। বিষয়টি বর্তমান শাসকমহল যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবে ততই তাদের মঙ্গল, ততই জাতির মঙ্গল। সরকারের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ যদি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রিলিজ হতে না পারে, তবে তা অস্বাভাবিক উপায়ে বিস্ফোরণের মাধ্যমেই রিলিজ হতে পারে। এটাই প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম। তখন আমাদের নিশ্চিত পরিণতি হবে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ার মতো। কিংবা তাদের চেয়েও খারাপ।

Exit mobile version