ভূত জগতে কানাঅলা হলো অনেকটা মনুষ্য জগতের ট্রাফিক পুলিশের মত। জনবিরল জলাশয়ের পাশে কিংবা কোন উন্মুক্ত প্রান্তরে অবস্থান করে রাতের বেলায় পথিকদের দিগভ্রান্ত করা বা পথ ভুলিয়ে দেয়াই এদের মূল কাজ। কানাঅলা ধরলে সেই পথিকের পথ আর ফুরোয় না। বার বার একই জায়গায় চক্কর দিতে থাকে। এভাবে রাত ব্যাপি হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত, শ্রান্ত হয়ে পড়ে। তখন অন্যান্য ভূতেরা মিলে সেই শিকারের ঘাড়টি মটকে দেব।
এই ধরণের কানাঅলা ভূত সত্যি সত্যি আছে কি না জানি না। তবে দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও বিনোদন জগতে এই কানা অলা ভূতের অস্তিত্ব ভালোভাবেই টের পাওয়া যায়। এই কানা অলা ভূতদের অনেকেই আবার জাতির পূজনীয় ব্যক্তিত্ব। না না রংয়ের না না বর্ণের কানাঅলা ভূতদের সম্মিলিত প্রয়াসেই জাতি বর্তমান দুর্দশায় পৌছে গেছে।
এই কানাঅলারা ভালোমন্দ মাপার জনগণের সেন্সরগুলোকে সত্যিই সত্যিই বিকল করে দিয়েছে। এই জাতির যখন হাসার কথা,তখন কাঁদে। আবার যখন কাঁদার কথা,তখন হাসে। ৩০ ডিগ্রী তাপমাত্রা এবং ৯০ ডিগ্রী তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না ।
এক হাওয়া ভবনকে নিয়ে এই কানাঅলারা জাতিকে যতটুকু হাওয়ায় ভাসিয়েছে এখন হাজার হাজার জলভবন দেখেও জাতিকে জলবৎ ঠান্ডা বানিয়ে রেখেছে। দশ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতুর খরচ তিরিশ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে, শেষ করতে এই খরচ কত হাজার কোটিতে পৌঁছাবে তা একমাত্র আল্লাহ মালুম। এই মহা দুর্নীতিকে ঢাকতে বা লঘু করে দেখাতে কিছু বুদ্ধিজীবী এগিয়ে এসেছেন যাদের বিবেক ও বিবেচনাবোধের উপর মানুষের অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস জন্মেছিল। অত্যন্ত পরিচিত এই সব বুদ্ধিজীবীদের হঠাৎ করে অত্যন্ত অপরিচিত মনে হয়। তখন সবকিছু আরো গুলিয়ে যায়। মনে প্রশ্ন জাগে, কানা অলা কাকে ধরেছে, আমাকে না তাকে ?
সরকারের নির্দয় সমালোচক হিসাবে সুনাম কুড়িয়েছেন এবং সরকার বিরোধী সেন্টিমেন্ট ভালোভাবেই নিজের করায়ত্বে নিয়ে নিয়েছেন – এমন একজন বুদ্ধিজীবীর পদ্মা সেতুর সর্বশেষ স্প্যান বসানোতে উল্লাস দেখে সত্যি ভিমড়ি খেয়েছি !
আপনার কাজের ছেলে বাজারের সবচেয়ে বড় মাছটি কিনে এনেছে। তাতেই আপনি উল্লসিত। কিন্তু এক হাজার টাকার মাছ কেন তিন হাজার টাকা দিয়ে কিনল সেই অনুসন্ধানটি করছেন না। বরং বাহবা দিচ্ছেন ! এরকম চললে বাপের জমিদারি থাকলেও ফতুর হতে সময় লাগবে না। একই ভাবে তথাকথিত উন্নয়ণের এই ধারা অব্যাহত থাকলে আশা করা যায় ২০৪১ সালের আগেই আবার তলাবিহীন ঝুঁড়িতে ফিরে যেতে সক্ষম হবো।
এতদিন এক নাবিকের গল্পটি মেমরিতে স্টোর করা ছিল সবচেয়ে উল্লুক মানুষের গল্প হিসাবে। সে সময় নাবিকদের সেইল করার কোনো নির্দিষ্ট সময় সীমা ছিল না। যতদিন ইচ্ছা জাহাজে থাকতে পারত। সেই সময় এক ফিলিপনো নাবিক আঠার মাস পর বাড়ি থেকে একটা সুসংবাদ পায়। তার স্ত্রী একটি ছেলে সন্তান প্রসব করেছে। এই শুভ সংবাদটি আবার সহযোগী নাবিকদের সঙ্গে সেলিব্রেট করছে। না করেও উপায় নেই। স্ত্রীর দাবি,এটি তারই বায়োলজিকেল সন্তান। বেচারা জিজ্ঞেস করেছিল, আঠার মাস যাবত একটি বাচ্চা তার মায়ের পেটে থাকে নাকি?
স্ত্রীর উত্তর, পেট থেকে বের হতে না চাইলে টেনে বের করব নাকি ?
এর পরই স্ত্রীর দুই গুন্ডা ভাই বোনের হাত থেকে ফোন টেনে নেয়। হুমকি দেয়, এগুলি নিয়ে উচ্চবাচ্য করলে দেশে আসলে এমনভাবে কিনা বানাবে যে বোঝার উপায় থাকবে না কোনটি মাংস আর কোনটি হাড্ডি ছিল। যে মেয়ের এমন মাফিয়া ভাই রয়েছে তার পেটে সন্তান আঠার মাস কেন-চব্বিশ মাসও থাকতে পারে !
অবিশ্বস্ত স্ত্রী এবং মাস্তান শালা সম্বন্ধী নিয়ে এই হতভাগা নাবিকের চেয়েও বড় মুশকিলে পড়েছে এদেশের মানুষ ।
পদ্মা সেতু নিয়ে মাহফুজ আনাম,ড. আসিফ নজরুল প্রমুখের উল্লাস দেখে এই নাবিককে আর উল্লুক বলি কোন মুখে? কারণ ঐ নাবিক স্ত্রীকে ঠিকভাবে চলাফেরার জন্যে নিত্যদিন পরামর্শ দিয়েছে, নাগরদের সাথে মেলামেশা দেখলে আদর্শ স্বামী হিসাবে প্রতিবাদ করেছে, মৃদু ধমকও দিয়েছে। তজ্জন্যে স্ত্রীর সঙ্গে অনেকবার ঝগড়াও হয়েছে। কিন্তু যখন সত্যি সত্যি স্বামীর প্রচেষ্টা ছাড়াই ছেলে সন্তানের জন্ম দিয়ে ফেলেছে তখন আসিফ নজরুলের পলিসি মতই স্ত্রীর ‘দৃঢ়তা ও সাফল্যে‘ সেই উল্লুক নাবিক মুগ্ধ হয়ে সহযোগী নাবিকদের নিয়ে তা সেলিব্রেট করছে !
এই কানাঅলা ভূতেরা আমাদেরকে ক্লান্ত, শ্রান্ত, দিগভ্রান্ত করে চূড়ান্তভাবে ঘাড়টি মটকানোর জন্যে। কানাঅলাদের প্রভাবে আমরা আন্দোলিত হই, আনন্দিত হই, শিহরিত হই। টের পাই যখন ঘাড় মটকানোর সময় সমাগত হয়। সর্বশেষ ঘাড় মটকানোর হুমকি পেয়ে হেফাজতে ইসলামও এই কানা অলাদের আসল চেহারাটা আরেকটু মালুম করতে পেরেছে ।
জাতির ঘাড়ে এই কানাঅলারা ভর করেছে স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু থেকেই। দেখা গেছে, খেয়েছে একজন কিন্তু বিল উঠেছে অন্যের নামে। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক পাক বাহিনীর আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্যে হেলিকপ্টারযোগে রওনা দিলেন। পথিমধ্যে তার হেলিকপ্টারকে গুলি করা হলো। কানা অলা ভূত শিখিয়ে দিল কাদেরকে এই কাজের জন্যে সন্দেহ করতে হবে। আমরাও তাই করলাম। মাথায় টুপি এবং মুখে দাঁড়ি সমেত রাজাকারদের নিয়ে হাজার হাজার নাটক ও সিনেমা বানানো হয়েছে। এসব নিয়ে অনেক গোয়েন্দা কাহিনী রচিত হয়েছে।
কিন্তু এমএজি ওসমানীর হেলিকপ্টারটি কে বা কারা গুলি করল, সেই রহস্য উদঘাটনে ব্রেইনের এক বাইটও খরচ করি নাই। এরকম জলজ্যান্ত কাহিনী নিয়ে কেউ একটি সিনেমা বানানোর কথা কল্পনাও করে নাই। কারণ কানাঅলা এই পথ থেকে আমাদেরকে বিরত রেখেছে।
স্বাধীনতার পর পর সাংবাদিক এনায়েতুল্লাহ খাঁন শিরোনাম করেছিলেন, সাড়ে ছয় কোটি কোলাবরেটর! এই একটি বাক্যের মাধ্যমে এই গুণী সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধের অনেক কথা বলে গিয়েছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এদেশের অধিকাংশ মানুষ দেশের ভেতরে থেকেই পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছিলেন। তবে জনগণের ক্ষুদ্র যে একটি অংশ পাকবাহিনীকে সহায়তা করেছিল তাদেরকে কোলাবরেটর বা রাজাকার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। অপর একটা অংশ স্রেফ নিজেদের জীবন বাঁচাতে ওপারে পাড়ি দিয়ে শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর ( যাদের সংখ্যা এক কোটির মত ) সেই শরনার্থীরা দেশে ফিরে নিজেদেরকেই একমাত্র হাক্কানী বা সহীহ মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করতে থাকে! খালি কলসী যে কত জোরে বাজে তা জাতি প্রত্যক্ষ করল। বাকি সাড়ে ছয় কোটি জনগণ যারা ওপারে যেতে পারেন নাই তাদেরকে ভেজাল মুক্তিযোদ্ধা বা কোলাবরেটর হিসাবে সন্দেহ শুরু করা হলো। বিশেষ করে কবি -সাহিত্যিক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যারা অপরাপর বুদ্ধিজীবীদের মত ১৪ই ডিসেম্বর নিহত হতে পারেন নাই-তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। ১৪ই ডিসেম্বর পাকিস্তান সরকারের বেতনের টাকা দিয়ে কেনা ভাত পেটে নিয়ে যারা নিহত হলেন তারাও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি হিসাবে বরিত হলেন। একই কাজ, একই আনুগত্য, একই কৌশল অবলম্বন করলেও শুধু জীবিত থাকার কারণে শিল্পী আব্দুল আলীম,কবি ফররুখ আহমেদ সহ কয়েকজন মারাত্মকভাবে ফেঁসে গেলেন।
এসব ব্যাপারে সামান্য সত্য কথা বলতে গিয়ে বিএনপি নেতা গয়েশ্বর বাবু যেন মৌচাকে ঢিল ছুঁড়ে দিয়েছেন !
১৯৭১ সালের’১৪ই ডিসেম্বর যে সব বুদ্ধিজীবী নিহত হয়েছেন তাদের নিয়ে গবেষণার রাস্তা বুদ্ধিবৃত্তিক গুন্ডামির মাধ্যমে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের উপর হাজার হাজার নাটক সিনেমা হলেও এই সব বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গবেষণামূলক কাজ বলতে গেলে একেবারেই হয় নাই। চার পাঁচটি লাইনের মাধ্যমে তাদের সকল কর্মকান্ডকে সীমিত করে রাখা হয়েছে। এই চার পাঁচটি লাইনের বাইরে কেউ যেতে চাইলেই সেই গবেষকদের উপর রাজাকার শাবকের তকমা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে ।
এই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কেউ আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। প্রায় সবাই ছিলেন চীনপন্থী কম্যুনিষ্ট। অথচ তাঁদের রেখে যাওয়া পরিবার পরিজন কেমন করে গড়পরতা সবাই কট্টর আওয়ামীলীগার হয়ে পড়লেন-সেটাও বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন ! এটা কি শতাব্দীর সেরা ব্ল্যাক মেইলিং, নাকি অন্যকিছু ? কথামত কাজ না করলে এই মৃতদের শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসাবে সম্মান না দেখিয়ে অন্য কিছু বানিয়ে ভিন্ন কিছু দেখানো হত ।
স্বাধীনতার পর পর এদেশের সাহিত্য সংস্কৃতি ও বিনোদন জগতে বুদ্ধিবৃত্তিক পাহলোয়ান হিসাবে একটি গ্রুপের উদ্ভব হয়। সংখ্যায় কম হলেও এদের দাপটে গত পঞ্চাশ বছর সবাই তটস্থ থেকেছে। মুক্তচিন্তার নামে এরা সকল মুক্তচিন্তার টুটি চেপে ধরেছে,স্বাধীনতার চেতনার নামে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। চারপাশের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা উপেক্ষা করে স্বাধীনতার একটা আজব ও কল্পিত ধারণা জাতির উপর চাপিয়ে খোদ স্বাধীনতাকেই অরক্ষিত করে ফেলেছে।