Site icon The Bangladesh Chronicle

যে কারণে কমছে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়

আহমেদ তোফায়েল

০৬ মে ২০২৩

https://www.ittefaq.com.bd/642508

রেমিট্যান্স আয়ের পর গত এপ্রিলে পণ্য রপ্তানি আয়ও কমেছে। এই মাসে রপ্তানি হয়েছে ৩৯৫ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পণ্য, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ঈদের মাস হওয়ার পরও গত এপ্রিলে রেমিট্যান্স আয় এসেছে ১৬৮ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। গত বছরের এপ্রিলে রেমিট্যান্স আয় এসেছিল ২০১ কোটি ডলার। ফলে গত বছরের এপ্রিলের তুলনায় এ বছর এপ্রিলে রেমিট্যান্স আয় কমেছে ১৬ দশমিক ২৬ শতাংশ। জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে।  

দৈনিক ইত্তেফাকের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

অথচ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য মতে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মী গেছেন ৩ লাখ ২৩ হাজার ১০ জন। আর ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রবাসে কর্মী গেছেন মোট ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ জন। কিন্তু সেই অনুপাতে দেশের প্রবাসী আয় বাড়েনি। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের দাম কম থাকায় প্রবাসীরা হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো বাড়িয়েছেন। এতে দিন দিন কমে যাচ্ছে দেশের বিদেশি মুদ্রার অন্যতম প্রধান উৎস রেমিট্যান্স।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত এপ্রিলের শুরুতে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের এমডিদের অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেইন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) নির্ধারিত রেটের চাইতে বেশি রেট দিয়ে রেমিট্যান্স আনার বিষয়ে সতর্ক করে। অবশ্য, এর আগে মার্চ মাসে ডলারের রেট বেশি দেওয়ার বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংক জেনেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি, তাই রেমিট্যান্সও বেড়েছিল।  ছয় মাস পর গত রবিবার রেমিট্যান্সের ডলারের রেট ১ টাকা বাড়িয়ে ১০৮ টাকা করেছে এবিবি ও বাফেদা। এখন থেকে প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠালে ডলারপ্রতি ২.৫ শতাংশ প্রণোদনাসহ ১১০ টাকা ৭০ পয়সা করে রেট পাবেন।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, গত কয়েক বছরে আমাদের দেশ থেকে প্রচুর প্রবাসী শ্রমিক বাইরে গেছে। সে হিসাবে আমাদের রেমিট্যান্স আরও বাড়ার কথা ছিল। এপ্রিলে রেমিট্যান্স কমার অন্যতম কারণ হলো, অধিকাংশ ব্যাংকই রেমিট্যান্সের ডলারের ক্ষেত্রে বাফেদা নির্ধারিত রেট থেকে বেশি দেয়নি। এছাড়া, আমাদের হুন্ডির চাহিদা কমাতে হবে। এটি না কমালে যত উদ্যোগই নেওয়া হোক না কেন, রেমিট্যান্স খুব বেশি বাড়বে না।

রপ্তানি আয় বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে জানা গেছে, একক পণ্য ও একক বাজার বা অঞ্চল নির্ভরতা দেশ থেকে পণ্য রপ্তানিতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৬ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। এরমধ্যে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে রপ্তানি আয়ের ৭৮ শতাংশই আসছে। দ্রুত নতুন বাজার সন্ধান করে রপ্তানি আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়াও চ্যালেঞ্জিং হবে। এসব কারণে রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে একক পণ্যের ও একক বাজারের ওপর নির্ভর করা এখন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রতিবেদনে রপ্তানি আয়ে ঝুঁকি কমাতে একক পণ্যের ওপর নির্ভরতার পরিবর্তে নতুন নতুন পণ্য সংযোজনে গুরুত্বারোপ করা হয়। একই সঙ্গে একক বাজার বা অঞ্চলে রপ্তানি সীমাবদ্ধ না রেখে নতুন বাজার সন্ধানে গুরুত্ব দেওয়া হয় ঐ গবেষণা প্রতিবেদনে।

এদিকে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীও বৈশ্বিক মন্দার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় রপ্তানির নতুন নতুন বাজার সন্ধান ও পণ্যের বহুমুখীকরণের ওপর জোর দিয়েছেন। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো থেকেও পণ্যের বহুমুখীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার সুফল মিলছে না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে উদ্যোক্তারা নতুন বাজার খোঁজা শুরু করেছেন। নতুন বাজারে পণ্য রপ্তানি বাড়ছে খুব ধীর গতিতে। মোট রপ্তানি আয়ের মাত্র ৪ শতাংশ হচ্ছে নতুন বাজারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রপ্তানি আয় কমছে। এগুলো হচ্ছে—রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমে গেছে। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানির বাজারগুলোতে প্রবল অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। এদিকে দেশের ভেতরে ডলার, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ও রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ না থাকা।

রপ্তানিকারকরা বলছেন, অনেক দিন ধরেই বলা হচ্ছে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ করতে। কিন্তু বিষয়টি এগোয়নি। কারণ দেশে  প্রযুক্তিনির্ভর বড় শিল্প গড়ে ওঠেনি। এ খাতে সরকারের নীতি সহায়তাও কম। যৌথ উদ্যোগে এসব কারখানা করার জন্য বিদেশি বিনিয়োগও আসছে না। পোশাক খাতের ওপর নির্ভরতা কমাতে প্রযুক্তিনির্ভর পণ্যের কারখানা করতে হবে। এ জন্য বিদেশি বিনিয়োগ দরকার। বিনিয়োগ আনতে হলে পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তা হলে এটি সম্ভব হবে। ছোট ও ক্ষুদ্র শিল্পের পণ্য রপ্তানি করে আয় বেশি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। কারণ এ খাতের উদ্যোক্তারা রপ্তানির বাজার ধরতে পারছে না। তাদেরকে রপ্তানি করতে তেমন কোনো সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে না।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী এপ্রিলে রপ্তানি হয়েছে ৩৯৫ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পণ্য। গত বছরের একই মাসে যার পরিমাণ ছিল ৪৭৩ কোটি ৮৬ লাখ ডলার। রপ্তানি আয় কমেছে ১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। ইপিবির প্রতিবেদনে দেখা যায়, এপ্রিলসহ চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) সার্বিকভাবে রপ্তানি বেড়েছে মাত্র ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। রপ্তানির পরিমাণ ৪ হাজার  ৫৬৭ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। অবশ্য গত ১০ মাসে তৈরি পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে ৯ শতাংশ। রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৮৫৮ কোটি ডলারের পোশাক। তবে বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, একক মাস এপ্রিলে পোশাকের রপ্তানি কমেছে ১৫ শতাংশ। গত মাসে ৩৩৩   কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। গত বছরের এপ্রিলে ছিল ৩৯৩ কোটি ডলার।

ইত্তেফাক/এমএএম

Exit mobile version