Site icon The Bangladesh Chronicle

যে কারণে ইরানে বিক্ষোভ এতটা ছড়িয়ে পড়েছে

পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সীমান্তে অবস্থিত ইরানের প্রান্তিকতম প্রদেশ সিস্তান ও বেলুচিস্তানে সবচেয়ে ভয়াবহ দমন-পীড়নের ঘটনা ঘটেছে। প্রদেশটির রাজধানী জাহেদানে শুক্রবারের জুমার নামাজের পর সংঘটিত বিক্ষোভ দমন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মারণাস্ত্র ব্যবহার করলে ৬৩ জন নিহত হয়। ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি একদিকে আমিনির মৃত্যুর তদন্তের কথা বলছেন, অন্যদিকে বিক্ষোভকারীদের কঠোরভাবে দমন করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছেন। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি চলমান বিক্ষোভের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে দায়ী করে যাচ্ছেন। কিন্তু তাতে বিক্ষোভ থামানো যাচ্ছে না।

ইরানে নারী অধিকার আন্দোলন অন্যতম পুরোনো একটি আন্দোলন। ১৯০৫-১১ সালের সাংবিধানিক বিপ্লবেরও আগে এর সূত্রপাত। বিপ্লব-পরবর্তী ইরানে নারী অধিকার সমর্থকেরা সবচেয়ে বেশি সক্রিয়তা দেখিয়ে আসছেন। অন্য কথায় চলমান আন্দোলন নারী অধিকার আন্দোলনের চেয়েও বেশি কিছু। ইরানের সমাজ বহুত্ববাদী, ঠিক এ আন্দোলনও বহুত্ববাদী আন্দোলন।

আজ ‘মাসা আমিনি’ এখন ইরানিদের স্বাধীনতা ও মুক্তির লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। এই প্রতিবাদ সরকারবিরোধী ধর্মঘটে রূপ নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী এবং এমনকি তেলশ্রমিকেরাও বয়কট কর্মসূচিতে যুক্ত হয়েছেন। ইরানের ক্রীড়া ও নানা মাধ্যমের শিল্পীরা এতে সমর্থন জানিয়েছেন। সাবেক রাজনৈতিক বন্দী ও শাসকদের হাতে নিপীড়িত ব্যক্তিরাও তাতে সমর্থন দিয়েছেন।

ইরানের চলমান আন্দোলন বিশ্ব সম্প্রদায়েরও বড় ধরনের নজর কেড়েছে। ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হ্যাশট্যাগ ফিল্টার করার পরও টুইটারে হ্যাশট্যাগ মাসাআমিনি অন্তত ১০ কোটি বার শেয়ার হয়েছে। প্রবাসী ও অভিবাসী ইরানিরা এই আন্দোলনের সমর্থনে নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করছেন। বিশ্বের প্রায় ১৫০টি শহরে তাঁরা প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ  করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভটি হয়েছে টরন্টোতে, প্রায় ৫০ হাজার মানুষ তাতে অংশ নিয়েছেন।

প্রবাসী ও অভিবাসী ইরানিরা এই আন্দোলনের সমর্থনে নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করছেন  ছবি : রয়টার্স

দেশে হোক আর বিদেশে হোক ইরানের অনেক নারী এখন মাসার মাঝে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছেন। লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, নিপীড়ন ও নিষ্ঠুরতার নির্মম বলি হয়েছেন মাসা। আমিসহ ইরানের অসংখ্য নারীকে ‘সামাজিক প্রথাপরিপন্থী’ আইন ভাঙার অপরাধে নীতি পুলিশের হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা চূড়ান্ত অপমানজনক। কর্তৃপক্ষের লাঞ্ছনার শিকার যাঁরা হয়েছেন, তাঁরা জানেন এটা কতটা মানসিক, আইনি ও শারীরিক ভীতির জন্ম দিতে পারে। হেফাজতে মাসার মৃত্যুর পর ইরানে ন্যায়ের যে দাবি উঠেছে, তাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে সমর্থন দিয়েছে, তাতে আমরা আপ্লুত। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, কেন আজ এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো, তার মূল প্রেক্ষাপটগুলোই অনেকে ধরতে পারছেন না।

প্রথমত, নারী অধিকারের বিষয়টি চলমান আন্দোলনের কেন্দ্রে থাকলেও লিঙ্গসমতার দাবি এখানে একমাত্র বিষয় নয়। ইরানের বর্তমান শাসকেরা এখন জনগণের তোপের মুখে পড়েছে। বিক্ষোভের স্লোগানেই তার প্রমাণ মিলছে। ‘স্বৈরশাসকের মৃত্যু হোক’ কিংবা ‘আমরা আমাদের ইরানকে ফিরিয়ে নিতে চাই’—এমন সব দাবি তুলছেন বিক্ষোভকারীরা। এর আগেও ইরানে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ও ২০১৯ সালের নভেম্বরে শাসকবিরোধী আন্দোলন হয়েছে। রক্তপাতের মধ্য দিয়ে সেগুলো দমন করা হয়েছিল। মাসার মৃত্যু স্ফুলিঙ্গ জ্বালালেও একজন কুর্দি বিক্ষোভকারী ‘নারী, জীবন ও স্বাধীনতার’ যে আওয়াজ তুলেছেন, সেটি চলমান আন্দোলনে জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে। বিক্ষোভকারীরা বুঝতে পেরেছেন, ইরানের প্রকৃত মুক্তি তখনই সম্ভব যদি সেখানে নারীর মুক্তি ঘটে। বর্তমান শাসনে সেটা সম্ভব নয়।

এই আন্দোলনে শিশু ও পুরুষেরা শামিল হয়েছেন। তাঁরা তো হিজাব পরেন না। তাহলে তাঁরা কেন এলেন? প্রকৃত সত্য হচ্ছে, নানা ধরনের আর্থসামাজিক উদ্বেগ, জলবায়ু সংকট, দুর্নীতি ও বাড়াবাড়ি ধরনের রাজনৈতিক নিপীড়নের কারণেই তাঁরা রাস্তায় নেমেছেন।

দ্বিতীয়ত, বাধ্যতামূলক পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধে ইরানি নারীদের আপত্তি ও প্রতিবাদ নতুন নয়। ইরানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী আর এই আন্দোলন প্রায় সমবয়সী। শাহ জামানার অবসানের দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ইরানের নারীদের অধিকারের দাবিতে বড় বিক্ষোভ হয়েছিল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ইরানে তৃণমূলের নারীরা ভেতরে-ভেতরে প্রতিরোধ গড়ে আসছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে সম্প্রতি তা প্রকাশ্যে চলে এসেছে। নারী অধিকারের কথা বলে অনেককেই গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে।

তৃতীয়ত, ইরানে নারী অধিকার আন্দোলন অন্যতম পুরোনো একটি আন্দোলন। ১৯০৫-১১ সালের সাংবিধানিক বিপ্লবেরও আগে এর সূত্রপাত। বিপ্লব-পরবর্তী ইরানে নারী অধিকার সমর্থকেরা সবচেয়ে বেশি সক্রিয়তা দেখিয়ে আসছেন। অন্য কথায় চলমান আন্দোলন নারী অধিকার আন্দোলনের চেয়েও বেশি কিছু। ইরানের সমাজ বহুত্ববাদী, ঠিক এ আন্দোলনও বহুত্ববাদী আন্দোলন।

পরিশেষে, চলমান আন্দোলনে অভূতপূর্ব এক ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে। এই ঐক্য ইরানের শাসকদের ‘বিভক্ত করো ও শাসন করো’ নীতির প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। ইরানের সমাজকে সিরিয়ার মতো করে মেরুকরণ করা সম্ভব নয়।

  • আজদা বারজান্দ এসওএএস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের পিএইচডি গবেষক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ
Exit mobile version