বিশ্বের জ্বালানি তেলের ৩৬ শতাংশ উৎপাদিত হয় এ অঞ্চলে। আবার বিশ্বে যত তেল রপ্তানি হয়, তার ৪৬ শতাংশ হয় মধ্যপ্রাচ্য থেকে। প্রাকৃতিক গ্যাসের ২২ শতাংশ এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের ৩০ শতাংশ আসে এ অঞ্চল থেকে। এভাবে হিসাব করলে এসব পরিসংখ্যান কেবল বড়ই হবে বলে মনে করে দ্য ইকোনমিস্ট। তেল ও গ্যাসের বিপুল মজুতও আছে মধ্যপ্রাচ্যে; বিশ্বের মোট তেলের ৫২ শতাংশ ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ৪৩ শতাংশের মজুত এ অঞ্চলে।
একসময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে সবচেয়ে বেশি তেল রপ্তানি করত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। কিন্তু সেই দিন এখন আর নেই। অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে এশিয়ার উত্থান সেই হিসাব-নিকাশ বদলে দিয়েছে। ২০২২ সালে সৌদি আরব সবচেয়ে বেশি তেল রপ্তানি করেছে চীনের কাছে, মোট রপ্তানির ২৭ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে রপ্তানি ছিল ২৫ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক সমীকরণও বদলে যাচ্ছে। সৌদি আরব এখন সরাসরি মার্কিন প্রেসিডেন্টের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করছে। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে তার সম্পর্কোন্নয়ন হচ্ছে।
যে চীনা টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি কোম্পানিকে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র নিষিদ্ধ করেছে, সেই হুয়াওয়ে সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি উপসাগরীয় দেশে ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক বসিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ এখন তেল ও গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে অর্থনীতির বহুমুখীকরণের চেষ্টা করছে। সে কারণে অর্থনীতির নতুন নতুন খাত তৈরি হচ্ছে। যেমন পর্যটন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও প্রযুক্তি। সেই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য একধরনের ডিজিটাল রূপান্তর করছে। ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন ব্যবহারের দিক থেকে এখন বিশ্বের সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু অঞ্চল মধ্যপ্রাচ্য।
এ পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন শঙ্কার কারণ হয়ে উঠেছে হামাস–ইসরায়েল যুদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে এই যুদ্ধের কী প্রভাব পড়বে, তা এখনো পরিষ্কার বলা সম্ভব নয়। তবে ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর তেলের দাম ইতিমধ্যে এক দফা বেড়েছে। তবে সদ্য সমাপ্ত বিশ্বব্যাংক–আইএমএফের বার্ষিক বৈঠকে আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ পিয়েরে-অলিভিয়ের গৌরিঞ্চাস বলছেন, তেলের দাম ১০ শতাংশ বাড়লে প্রবৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ হ্রাস পায় এবং সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ।
এর চেয়ে বড় বিষয় হলো, স্থিতিশীলতা। মধ্যপ্রাচ্যে যে পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে, তার পেছনে আছে একধরনের স্থিতিশীলতা। এখন হামাস–ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে সেই স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হলে মধ্যপ্রাচ্য যে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছে, তার গতি আবার কমে যেতে পারে।
ভালো করছে মধ্যপ্রাচ্য
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অস্থিরতা আগের তুলনায় অনেকটাই কমেছে। এ অঞ্চলের তেল–গ্যাসকে ঘিরে ভূরাজনৈতিক নানা মেরুকরণও রয়েছে।
বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সৌদি আরবসহ ওপেকের হাত আছে। রিয়াদ তেলের দাম যেকোনো মূল্যে ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলারের ওপরে রাখতে চায়। তবে মহামারির কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বোধোদয় হয়েছে, তাই তারা এখন বিভিন্ন খাতে অর্থনীতির বিস্তার ঘটাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) মনে করছে, চলতি ২০২৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তেলবহির্ভূত অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হবে ৪ দশমিক ২ শতাংশ; যদিও তেল খাতের প্রবৃদ্ধি হবে মাত্র ১ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০২২ সালে এই হার ছিল ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। সেই সঙ্গে গত বছর মধ্যপ্রাচ্যে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছিল বৈশ্বিক মোট এফডিআইয়ের ৬ শতাংশ, আগের বছর যা ছিল ৩ শতাংশ।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পুঁজিবাজারও চাঙা। ২০২৩ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে বিশ্বে যত কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও ছেড়েছে, তার মধ্যে ১৪ শতাংশ কোম্পানি সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবিভিত্তিক। বৈশ্বিক বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসের তথ্যানুসারে, মধ্যপ্রাচ্যের কোম্পানিগুলোয় বিদেশি মালিকানার পরিমাণ ২০১৭ সালে ২ শতাংশ থেকে ২০২২ সালে ১০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
চলতি বছরের শুরুতে দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট সামিটে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেন, মানুষের মধ্যে এমন ধারণা আছে যে কেবল তেল ও গ্যাসের উচ্চ মূল্যের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি ভালো করছে, কিন্তু বিষয়টি তেমন নয়। বাস্তবে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি উন্মুক্ত হচ্ছে; ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিযোগিতামূলক হচ্ছে, সে জন্য কর্মসংস্থান হচ্ছে।
সৌদি আরব তার ভিশন ২০৩০ পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে উদ্যোক্তাদের বিকশিত করার চেষ্টা করছে। এর মধ্য দিয়ে তারা গতিশীল সমাজ, সমৃদ্ধ অর্থনীতি ও উচ্চাভিলাষী জাতি গড়তে চায়। সেই লক্ষ্য অর্জনে তারা পর্যটন, বিনোদন ও প্রযুক্তি খাতের বিকাশে সহায়তা করছে।
এদিকে মধ্যপ্রাচ্যের অভ্যন্তরীণ সংস্কার কর্মসূচিও গতি পাচ্ছে। বছরের প্রথম প্রান্তিকে সৌদি আরবের ৩১ শতাংশ নারী কাজে ছিলেন। সেই তুলনায় ২০১৭ সালের একই সময়ে এই হার ছিল ১৭ শতাংশ।
এই বাস্তবতায় মধ্যপ্রাচ্য কোথায় যেতে পারে, বিশ্লেষকেরা এখন তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছেন। পশ্চিমা কোম্পানিগুলো চীন থেকে উৎপাদনব্যবস্থা সরিয়ে আনতে চাইছে। তাই মধ্যপ্রাচ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণ জনগোষ্ঠী ও তাদের প্রযুক্তিবান্ধব মনোভাবের কারণে এমনও হতে পারে যে এ অঞ্চলের দেশগুলো উৎপাদনের নতুন ক্ষেত্র হয়ে উঠবে।
সব পরিবর্তনের উৎস মানুষের মন
বলা হয়ে থাকে, অর্থনীতি-রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে গেলে সবার আগে মানুষের মনোভাবে পরিবর্তন আনতে হয়।
বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, আরবের মানুষেরা এখন অর্থনীতিকেই ভাবনার মূলে স্থান দিয়েছেন। সেই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষেরা রাজনৈতিক ইসলামে বিশ্বাস হারাচ্ছেন। তিউনিসিয়ার নাগরিকেরা ইসলামি দলকে ক্ষমতা থেকে সরিয়েছে। সশস্ত্র ইসলামি গোষ্ঠীগুলো ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ার ক্ষমতা নেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। ইরানেও ইসলামি শাসনের বিরুদ্ধে মানুষ ব্যাপক বিক্ষোভ করেছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যে পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি করেছে; আর এ ক্ষেত্রে প্রাযুক্তিক ও ভূরাজনৈতিক শক্তিগুলো দিচ্ছে প্রণোদনা।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, আরব নিউজ
প্রথম আলো