Site icon The Bangladesh Chronicle

যেভাবে পালিয়ে যান নরসিংদী কারাগারের ৮২৬ বন্দী

ইয়াকুব মিয়া (৪৫), আপন মিয়া (৩০), বোরহান উদ্দিন (৩৫) ও মো. জাকির হোসেন—কেউ সাজাপ্রাপ্ত আসামি, কেউবা বিচারাধীন মামলায় কারাগারে ছিলেন। সবাই নরসিংদী জেলা কারাগারের বন্দী।

গত শুক্রবার বিকেলে কারাগারে হামলার পর পালিয়ে যাওয়া ৮২৬ বন্দীর মধ্যে তাঁরাও ছিলেন। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে তাঁরা কারাগারের সামনে আত্মসমর্পণ করতে আসেন। কিন্তু তাঁদের আদালতে বা থানায় যাওয়ার পরামর্শ দেয় কারা কর্তৃপক্ষ।

চার বন্দীর মধ্যে মাদক মামলার আসামি আপন মিয়া ২ মাস, বোরহান উদ্দিন ১৫ দিন ও মো. জাকির হোসেন ৬ মাস ধরে কারাগারে ছিলেন। তাঁরা জামিনের অপেক্ষায় আছেন। স্বজনদের পরামর্শে তাঁরা ফিরে এসেছেন।

হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ইয়াকুব মিয়া জানান, হত্যা মামলায় ২০১৫ সালে তাঁর ফাঁসির রায় হয়েছিল। পরে উচ্চ আদালত তাঁর সাজা কমিয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন। ৮ বছরের সাজা খাটা শেষ হয়েছে। ঘটনার দিন পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। এখন আত্মসমর্পণ করতে চান।

তাঁদের মতো নরসিংদী কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া ৮২৬ বন্দীর মধ্যে ১৩১ জন আত্মসমর্পণ করেছেন। এর মধ্যে ৫ জন থানায় ও ১২৬ জন আদালতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। এ ছাড়া পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছেন চারজন। মঙ্গলবার বিকেলে নরসিংদীর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান এসব তথ্য জানান।

পুলিশ সুপার বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় পুলিশের অভিযানে কারাগার থেকে লুট হওয়া ১৮টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন ৩১ জন। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত ৩৩টি অস্ত্র উদ্ধার ও ৯৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি অস্ত্র উদ্ধার ও জড়িত আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে একাধিক কারারক্ষী ও এলাকাবাসী জানান, শুক্রবার বিকেল সোয়া চারটার দিকে হামলাকারীরা মুহুর্মুহু ইটপাটকেল ছুড়তে ছুড়তে কারাগারের দুই দিকের ফটক ভেঙে ভেতরে ঢোকেন। এ সময় পেট্রলবোমা মারা হয়। কারাগারের ভেতরে নানা জায়গায় আগুন ধরে যায়। হামলাকারীরা কারারক্ষীদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া চাবি দিয়ে বন্দীদের অনেকগুলো কক্ষের তালা খুলে দেন। কিছু কক্ষের তালা ভেঙে ফেলা হয়। চারপাশ ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। এ সময় হামলাকারীরা আসামি ছিনিয়ে নেন। এরপর একে একে ৮২৬ বন্দী পালিয়ে যান। এ সময় অস্ত্রাগার ও কারারক্ষীদের থেকে ৮৫টি অস্ত্র ও ৮ হাজার ১৫০টি গুলি লুট করা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, কারাগারে যাঁরা হামলা করেন, তাঁদের হাতে লাঠিসোঁটা, দেশি অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। তাঁদের হামলা প্রতিহত করার চেষ্টা করেন কারারক্ষীরা। তবে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কারারক্ষীরা নিরাপদ অবস্থানে চলে যান।

কারাগার যেন ধ্বংসস্তূপ

কারাগারে বন্দীদের থাকার জায়গা, রান্নাঘর, কনডেমড সেল ও অফিস এখন আর আলাদা করে চেনার উপায় নেই। সবখানে পোড়া চিহ্ন, লন্ডভন্ড অবস্থা। দেখে মনে হয়, যুদ্ধক্ষেত্রের কোনো ধ্বংসস্তূপ। গত শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কারাগারে ঢুকে এমন চিত্র চোখে পড়ে।

কারাগারে গিয়ে দেখা যায়, কারাগারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সাদাপোশাকে আছেন। কারাগারের অফিস, রান্নাঘর, বন্দীদের থাকার জায়গা, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের থাকার কনডেমড সেলসহ পুরো এলাকায় আগুনে পোড়ার দাগ। আশপাশের উৎসাহী লোকজন কারাগারের ভেতরে ঢুকে ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। কেউ কেউ কারাগারের বাগানের ফুল-ফল ছিঁড়ে বাড়ি নিয়ে গেছেন।

বন্দীদের কারাগার থেকে চলে যাওয়ার সময়কার কথা উল্লেখ করে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, বের হয়ে যাওয়ার সময় বন্দীদের অনেকে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। এক বন্দী তাঁকে বলেছেন, তাঁর ২৪ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। তিনি ১০ বছর সাজা খেটেছেন। তিনি এখন সুযোগ পেয়ে বের হয়ে যাচ্ছেন।

হামলাকারীরা দেশের শত্রু: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

মঙ্গলবার বেলা দুইটার দিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া কারাগার পরিদর্শনে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এ সময় তাঁর সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মশিউর রহমান, জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম, আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এফ এম আনিসুল হক, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি নুরুল ইসলাম, জেলা প্রশাসক বদিউল আলম, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

কারাগার ঘুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘৯ জন জঙ্গিসহ ৮২৬ জন বন্দীকে কারাগার থেকে মুক্ত করে নিয়ে যায়। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। অস্ত্রাগার থেকে ৮৫টি অস্ত্র ও হাজার হাজার গুলি লুট করা হয়। যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা দেশের শত্রু। তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। তারা দেশকে বিপর্যস্ত অবস্থায় নিয়ে যেতে চায়। দেশ এগিয়ে যাক, তা চায় না। তাদের গ্রেপ্তারে পুলিশের চিরুনি অভিযান চলছে।’

দুটি তদন্ত কমিটি

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কেন এ ঘটনা ঘটল, কারও গাফিলতি আছে কি না, কেউ এখানে সহযোগিতা করেছে কি না—এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানতে ইতিমধ্যে দুটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তিন সদস্যের কমিটি করেছেন আইজি প্রিজন। আর ছয় সদস্যের কমিটি করেছে সুরক্ষা সেবা বিভাগ। যদি কারও গাফিলতি থাকে, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।’

মন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা বাধ্য হয়ে কারফিউ জারি করেছি। আপনাদের হয়তো একটু কষ্ট হচ্ছে। আপনারা দু-এক দিন ধৈর্য ধারণ করুন। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা শত্রুদের শনাক্তের পর গ্রেপ্তার করে শান্তির পরিবেশ তৈরি হলেই আবার সবকিছু স্বাভাবিক করে দেব।’

কারাগারে হামলা ও কারাবন্দীদের পালানোর ঘটনায় নরসিংদী কারাগারের জেলসুপার আবুল কালাম আজাদ ও জেলার কামরুল ইসলামকে মঙ্গলবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। নরসিংদীর জেলা প্রশাসক বদিউল আলম বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেন।

কারাগারে হামলার ঘটনায় গত রোববার দুপুরে জেলার কামরুল ইসলাম বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে নরসিংদী মডেল থানায় মামলা করেন। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, হামলায় অংশ নিয়েছেন ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার ব্যক্তি। তবে ভেতরে ঢুকে তাণ্ডব চালিয়েছেন অন্তত এক হাজার লোক।

জেলা প্রশাসক বদিউল আলম বলেন, ‘পালিয়ে যাওয়া বন্দীদের আত্মসমর্পণের জন্য এলাকায় এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে। তারা দু-একজন করে আসছেন। আমাদের ধারণা, বেশির ভাগ বন্দীই স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করবেন।’

 

Exit mobile version