Site icon The Bangladesh Chronicle

যুক্তরাষ্ট্রের দোলাচল

সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথাটি এরকম (পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী) ‘গ্রেট ব্রিটেনের স্থায়ী কোনো শত্রু-মিত্র নেই, তবে স্থায়ী স্বার্থ রয়েছে’। যেকোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতির এটি মূল কথা। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সম্পর্ক নির্ণয়ের মাপকাঠি জাতীয় স্বার্থ, অন্য কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র একক বৈশ্বিক ক্ষমতাধর কারণে তার জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে তেমন কোথাও বাধাগ্রস্ত হয় না। বিশেষ করে ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর খালি মাঠে গোল দিয়ে যাচ্ছে ওয়াশিংটন। দ্বৈত বৈশ্বিক ব্যবস্থার পরিবর্তে একক বৈশ্বিক অবস্থায় দাঁড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিউ ওয়ার্ল্ড ওর্ডারের মতো বৈশ্বিক নির্দেশ বা নীতিমালা গ্রহণে সক্ষম হয়েছে।

ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময়কালে যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ব্যবস্থার বিপরীতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলত। তবে নিজেদের স্বার্থে কোনো কোনো দেশে সামরিক স্বৈরাচারকেও সমর্থন দিয়েছে। পরিবর্তিত অবস্থায় নতুন বৈশ্বিক ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, পুঁজিতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে আরো জোরালো অবস্থান নেয়, যাতে গোটা বিশ্বে সোভিয়েত ব্যবস্থার অবশেষটুকু মুছে যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বললেন ভিন্ন কথা ‘আমেরিকা আমেরিকানদের জন্য’ । পৃথিবীর অন্যত্র কী ঘটছে তাতে মার্কিন দায় সামান্য। ট্রাম্প জাতিসঙ্ঘের শিক্ষা উন্নয়ন ও সেবাকার্যক্রম থেকে গুটিয়ে নেয়ার পদক্ষেপ নেন। ন্যাটো এবং পৃথিবীর অন্যান্য সামরিক স্থাপনার ক্ষেত্রেও তার সঙ্কোচন নীতি অব্যাহত থাকে। তার ধারণায় পৃথিবীতে গণতন্ত্র গোল্লায় গেলেও তার কিছু আসে যায় না। মানবাধিকার নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। এ অবস্থায় বৈশ্বিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অনেকটা ক্ষুণ্ন হয়। জো বাইডেন ক্ষমতাসীন হলে মার্কিন ইমেজ পুনরুদ্ধারে তৎপর হন। প্রথম দিকে তিনি গণতন্ত্রের বিকাশ ও উন্নয়নে বৈশ্বিক সম্মেলন আহ্বান করেন। পরবর্তীকালে যেসব দেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের শোচনীয় অবস্থা সেসব দেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া হয়।

এক-এগারোর ঘটনাবলির পর থেকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রায়নে বড় ধরনের ব্যত্যয় ঘটে। বিশেষ করে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকার ক্রমে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিরোধী কার্যক্রম গ্রহণ করে। এর সর্বশেষ পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রথমত র্যাবের মতো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নমনীয় বিধি-নিষেধ দেয়। নির্বাচনের কয়েক মাস আগে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আর এসব করা হয় মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের নামে। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ঘোষিত নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসতে থাকে তত একটি শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের তাগিদ জোরালো হতে থাকে। শেষ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র সংলাপের আহ্বান জানায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার তা থোড়াই কেয়ার করে। যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে ভারত ও চীন রাশিয়াকে ঢাল বানিয়ে ক্ষমতাসীনরা আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের সব শক্তি একই ভাষায় জোরালো চাপ সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগ সরকার কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে আবারো আরেকটি বোগাস বা ডামি নির্বাচনের মহড়া দেয়।

নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে নাগরিক সাধারণ আশা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র এমন কিছু করবে যাতে সরকার নির্বাচন করতে না পারে। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিরোধী দলগুলো বিশেষত ২৮ অক্টোবর ২০২৩ বিএনপির মহাসমাবেশটি ভণ্ডুলের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সরকার একক নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে বহিঃক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অক্ষমতা হতাশার সৃষ্টি করে। তবে নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট একটি বিবৃতি দেয়। এতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণ এবং গণতন্ত্র, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য তাদের আকাক্সক্ষাকে সমর্থন করে। যুক্তরাষ্ট্র দেখেছে যে, ৭ জানুয়ারি ২০২৪ এর সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জিতেছে আওয়ামী লীগ। রাজনৈতিক বিরোধী দলের হাজার হাজার সদস্যের গ্রেফতার ও নির্বাচনের দিন নানা অনিয়মের প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। অন্য পর্যবেক্ষকদের সাথে যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে অভিন্ন মতামত পোষণ করে যে, এই নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু ছিল না এবং আমরা দুঃখিত যে সব দল এতে অংশগ্রহণ করেনি। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের দিন এবং এর আগের মাসগুলোতে সংঘটিত সহিংসতার নিন্দা জানায়। আমরা বাংলাদেশ সরকারকে সহিংসতার প্রতিবেদন বিশ্বাসযোগ্যভাবে তদন্ত এবং অপরাধীদের জবাবদিহি করতে উৎসাহিত করি। আমরা সব রাজনৈতিক দলকে সহিংসতা পরিহার করার আহ্বান জানাই। যুক্তরাষ্ট্র সামনের দিনগুলোতে, একটি মুক্ত, উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিকের জন্য অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে এগিয়ে নিতে, বাংলাদেশে মানবাধিকার ও সুশীল সমাজের সমর্থনে, জনগণের সাথে জনগণের এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরো গভীর করতে বাংলাদেশের সাথে অংশীদারিত্বে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে।

স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিবৃতি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি পাঠানো জো বাইডেনের চিঠি পর্যন্ত বিবৃতির ভাষা ও কূটনৈতিক তৎপরতা যদি লক্ষ করা যায়; তাহলে একটি সাধারণ সমীকরণ এবং সেই সাথে অর্থনীতির ক্রমহ্রাসমান উপযোগ বিধির মতো তাৎপর্যপূর্ণ অবস্থা অবলোকন করা যায়। কূটনৈতিক তৎপরতা সম্পর্কে যারা অভিজ্ঞ তারা স্বীকার করবেন যে, বিষয়টি প্রকাশ্যের চেয়ে অপ্রকাশ্য বেশি। শাসক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘তলে তলে সব ঠিক হয়ে গেছে’। যদিও ভাষাটি ছিল অকূটনীতিসুলভ, এখন জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছে যে, সেটি কী ছিল বাস্তবতা!
কলামের শুরুতে আমরা পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের কথা বলেছি। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে জাতীয় স্বার্থের প্রতিধ্বনি থাকবে, এটি স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি বা গণতন্ত্রের প্রতি একরকম ‘বিগলিত’ কেন হয়ে গেল- তার নানা রকম ব্যাখ্যা আছে। নির্বাচনের পর মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিবৃতির শেষ অংশ তাৎপর্যপূর্ণ। আবার লক্ষ করুন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি জো বাইডেনের চিঠির দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক লক্ষ্যকে সমর্থন করতে এবং একটি মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য যৌথ ভিশনে বাংলাদেশের সাথে অংশীদারিত্ব করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

উভয় অংশে যা কমন তা হলো ইন্দো-প্যাসিফিক তথা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা। দীর্ঘকাল ধরে অতলান্তিক মহাসাগর থেকে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি ভারত তথা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়েছে। সামরিক বিশারদরা এর পেছনে ক্রমে চীনা প্রভাবকে অকার্যকরকরণের পরিকল্পনার কথা বলছেন। গত কয়েক দশকে চীনের অর্থ-বিত্ত ও শৌর্যবীর্য যত বেড়েছে তত বৃদ্ধি পেয়েছে মার্কিন তৎপরতা। গোটা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সংবেদনশীল অঞ্চল। এ অঞ্চলে রয়েছে মার্কিন মিত্রদের একরাশ সমাহার। এই প্রভাববলয় কোরিয়া, জাপান থেকে ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া অবধি প্রসারিত। এ অঞ্চলে দুটো বিরোধীয় বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত তাইওয়ান এবং দ্বিতীয়ত পিত সাগরের সীমা পরিসীমা। আর এ দিকে অর্থাৎ ভারত মহাসাগরের দিকে ক্রমবর্ধমান চীনা চাপ মার্কিনপ্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলেছে। শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে চীনের শক্ত অবস্থান ও আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে চীনা বিস্তৃতি খুব স্বাভাবিকভাবে হুমকির কারণ। যুক্তরাষ্ট্র চীনা প্রভুত্ব প্রতিহত করতে ভারতের শক্ত সমর্থন চায়। একসময় পাকিস্তান অভিন্ন থাকায় ভারতের প্রয়োজন অত তীব্র ছিল না।
১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর মার্কিন কৌশলে পাকিস্তান ক্রমে গৌণ হয়ে যায়। আর ভারত ক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের সমসাথী হয়ে ওঠে। এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত চমৎকার অংশীদারিত্বের সম্পর্কের কথা বলছে। কিন্তু আবার সেই জাতীয় স্বার্থের কথা। ভারত আমেরিকানদের এ অঞ্চলে একচ্ছত্র আধিপত্য মেনে নিতে ইচ্ছুক নয়, কারণ ভারত বৃহৎ শক্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখে। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তাকে ব্ল্যাঙ্ক চেক দেবে না। চীনা আধিপত্য প্রতিহত করতে যতটা সামরিক সহায়তা দরকার ততটা ভারত চাইবে এর বেশি কিছু নয়। কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলে থাকেন, এক-এগারো ছিল ভারত-মার্কিন যৌথ প্রযোজনা। সে সময়ের মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ভারতকে প্রকাশ্যে এ অঞ্চলের মাতবর বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। অভিযোগ এই যে, ভারত সেভাবে মার্কিন স্বার্থ দেখাশোনা করেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার একটি স্থায়ী ইস্যু। বাংলাদেশে যখন ক্রমে গণতন্ত্রবিরোধী কর্তৃত্ববাদের বিকাশ ঘটে এবং নির্বাচনের মতো গণতন্ত্রের স্থায়ী প্রক্রিয়া নির্বাসিত হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র নীতিগতভাবে বাংলাদেশের ব্যাপারে সজাগ হতে থাকে। আগেই বলা হয়েছে, বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে গণতান্ত্রিক সরকার বলে স্বীকৃতি দিতে দ্বিধান্বিত ছিল। সে কারণে আওয়ামী লীগ সরকার তদবির করেও গণতন্ত্রের সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে সম্পর্কের নেতিবাচক সূচনা সেই থেকে। আওয়ামী লীগ সরকার গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের পরিবর্তে নেতিবাচক পদক্ষেপ নেয়। যুক্তরাষ্ট্র বারবার স্পষ্ট করেছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নয়; বরং তাদের প্রকৃত ইচ্ছা হচ্ছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নয়; বরং প্রকৃতই বাস্তব গুণগত পরিবর্তন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা পর্যন্ত অকূটনৈতিক ভাষায় কথা বলেছেন। একসময় প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ ড্যান মজিনাকে কাজের মেয়ে মর্জিনা বলেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পিটার হাসকে হাঁসের সাথে তুলনা করে হাসি-তামাশা করা হয়। তখন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উষ্মা প্রকাশ সব ভদ্রতা সৌজন্য অতিক্রম করে। এখন ওবায়দুল কাদের বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সরকারের সাথে সম্পর্ক অব্যাহত রাখবে। দুই দেশের স্বার্থ আছে এখানে। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আগেও বলেছে। তবে তারা বলেনি নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ হয়েছে। যে মন্তব্য করলে খারাপ কিছুর আশঙ্কা থাকে। এখানে খারাপ কিছু বলতে ওবায়দুল কাদের হয়তো নির্বাচন-পরবর্তী সম্ভাব্য মার্কিন অবরোধ সম্পর্কে বলেছেন। কূটনৈতিক মহলের ধারণা ছিল, অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পর অবরোধ জাতীয় কিছু আরোপিত হতে পারে। এর আগে বোগাস নির্বাচনের কম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন বিধিনিষেধ ঘোষিত হয়। একইভাবে আফ্রিকার কয়েকটি দেশের বিরুদ্ধে নির্বাচনকালীন অসচ্ছতার জন্য অনুরূপ ব্যবস্থা নেয়া হয়।

নির্বাচনের পরপর যুক্তরাষ্ট্র ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্র ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া ও অন্যরা নির্বাচন সম্পর্কে মার্কিন প্রতিক্রিয়ার প্রতিধ্বনি করে। জাপান যেহেতু বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অংশীদার সে জন্য হয়তো পাশ্চাত্যকে উপেক্ষা করে নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানায়। প্রকাশিত নির্বাচনী ফলের পক্ষকাল পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন সবার আগে শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানায়। দুদিন পর বলে, অভিনন্দন আনুষ্ঠানিক কিন্তু নির্বাচনের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। অভিনন্দনের পালায় ক্রমে ক্রমে নাম লেখায় যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি মার্কিনমুখী দেশ।

৭ জানুয়ারি ২০২৩ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত সময়কালে বারবার যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায় থেকে নির্বাচন সম্পর্কে প্রথম দিনের কথার প্রতিধ্বনি করা হয়। আমরা যখন মনোযোগসহকারে বাইডেনের চিঠি পাঠ করছি তখন পুরোনো কথার প্রতিধ্বনি আসছে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের পক্ষ থেকে। গত ৪ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর সাথে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। তার পরও বাংলাদেশের সাথে বিভিন্ন ইস্যুতে কাজ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র; বিশেষ করে জলবায়ু বিষয়ে কাজ চলমান থাকবে। নির্বাচন বিষয়ের পর মার্কিন-বাংলাদেশ সম্পর্ক ব্যাহত হওয়ার আরেকটি কারণ নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকারের হয়রানিমূলক কার্যক্রম। মার্কিন মুলুকে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপক। হিলারি পরিবার ও বারাক ওবামার সাথে তার রয়েছে চমৎকার সম্পর্ক। গত এক মাসে বিশ্বের বিখ্যাত ব্যক্তিরা দু’বার প্রফেসর ইউনূসের সাথে সরকারের নেতিবাচক কার্যক্রমের নিন্দা জানায়। তখন প্রধানমন্ত্রী বলছিলেন, ইউনূস বিবৃতি ভিক্ষা করছেন। সরকার আরো বলছে, আইন ও বিচারপ্রক্রিয়া নিজস্ব গতিতে স্বাধীনভাবে চলছে । কিন্তু বিবৃতির ভাষা দেখে মনে হয় না যে তারা তা বিশ্বাস করছেন। মার্কিন সরকারের পক্ষে ওইসব গুণীজনের মতামত উপেক্ষা করা সহজ নয়।

মার্কিন-বাংলাদেশ সম্পর্ক গত কয়েক মাসে তলানিতে ঠেকেছিল। নির্বাচন-পরবর্তীকালে সম্পর্ক উন্নয়নের আভাস-ইঙ্গিত গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। শেখ হাসিনা সরকার মুখে যতই যুক্তরাষ্ট্রকে দুষ্টু বলুক, আসলে তলে তলে তুষ্ট করার চেষ্টা করে আসছে- সেটিই স্বাভাবিক। সেই তুষ্ট করার একমাত্র মাধ্যম যে ভারত সরকার তা আওয়ামী নেতারা খোলামেলা বলছেন। রাজনীতিক-কূটনীতিক সবার ধারণা বাংলাদেশে নির্বাচনকে নির্বাসনে দেয়ার এত সাহস তাদের ছিল না। ২০১৪ সালে যেমন তারা বস্তা বস্তা ভারতীয় কৌশলে জয়লাভ করেছে এবারো তারা ভারতের কূটকৌশলে জয়লাভ করেছে। এতে ভারতের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা হয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু বিপন্ন হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা। ভারতের স্বার্থে আমাদের জামদানি তাদের হয়ে যায়। আমাদের সীমান্তরক্ষীরা তাদের গুলিতে প্রাণ হারায়। আমাদের বন্দর তাদের হয়ে যায়। কূটনীতিকরা বলছেন, ভারতের চাপে মার্কিন-বাংলাদেশ সম্পর্ক দোলাচলে রয়েছে। বৃহৎ ভারতের স্বার্থ উপেক্ষা করা হয়তো মার্কিনিদের সম্ভব নয়। আবার বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তাদের অবস্থান পরিবর্তনও সহজসাধ্য নয়। সব মিলিয়ে টানাপড়েন আর দোলাচলে মার্কিন-বাংলাদেশ সম্পর্কে ভবিষ্যৎ নির্ণীত হবে। আশা-নিরাশার দোলায় ঘুরপাক খাবে আরো কিছুকাল বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

nayadiganta

Exit mobile version