Site icon The Bangladesh Chronicle

যাহা ৫২ তাহাই ৫৩ – এই পারসেপসানকে বিএনপির মিথ্যা প্রমাণ করতে হবে

আনিসুর রহমান

(২৩ ঘন্টা আগে) ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, বুধবার, ১০:০৯ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৫:৩০ অপরাহ্ন

রাজনীতির মাঠের একাধিক মহল পতিত আওয়ামী লীগ এবং প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ বলে চিত্রিত করে থাকেন। তারা এই দুই দলের মধ্যে উনিশ আর বিশের চেয়ে বেশি তফাৎ দেখতে পান না বা দেখাতে চান না। কেউ কেউ আসলেই তা মনে করেন। তারা কতটা সঠিক তা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন নাই।

অন্য একটি মহল অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে এটা প্রচার করে থাকেন। তাদের বয়ানে সারবত্তা যতোটা আছে তার চেয়ে বেশি আছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। অবৈধ হাসিনা রেজিমের পতনের পর তাদের এই প্রচারণাটা আরও বেড়েছে । এই প্রচারণায় গুপ্ত আওয়ামীপন্থীরা বেশি সক্রিয় হলেও এর থেকে প্রথম ফায়দাটা উঠিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির ডাকসু নির্বাচনে এই প্রচারণাটাকে অন্যতম হাতিয়ার করে বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলকে ধরাশায়ী করে বিজয়ী হয়েছে। ছাত্রশিবিরের এই বিজয় কেবল এই কারণে হয়েছে, এমন উপসংহার টানলে শিবিরের প্রতিই শুধু অবিচার করা হয় না, সাধারণ ছাত্রদের বিচারবুদ্ধিকেও (Judgement capacity) হেয় করা হয়। যেসব বিষয় ডাকসু নির্বাচনে প্রভাব রেখেছে তার প্রায় প্রত্যেকটিতেই শিবির ছাত্রদলকে পরাভূত করেছে। ছাত্রদলের উচিৎ ছিল এটা মেনে নিয়ে শিবিরকে অভিনন্দন জানানো । এতে তারা লাভবান হতো। আশার কথা, বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা সালাহউদ্দিন শিবির নেতৃত্বাধীন বিজয়ী জোটকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

বিএনপি মানুক বা না মানুক, যাহা বাহান্ন তাহাই তিপ্পান্ন – এই দুই দল সম্পর্কে এমন একটি পারসেপশান বা ধারণা যে অল্প করে হলেও মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নাই। এই পারসেপশানে আওয়ামী লীগের চেয়ে ঢের বেশি ক্ষতি হচ্ছে বিএনপির। কারণ পতিত আওয়ামী লীগের আপাতত অর্জনের কিছু নাই।

বলা হচ্ছে, বিএনপিতেও প্রচুর দুর্নীতিবাজ, মাস্তান, চাঁদাবাজ ইত্যাদি ছিল এবং এখন নতুন করে তাদের দুষ্কর্ম দেখা যাচ্ছে। অভিযোগগুলো তো একেবারে অমূলক নয়। হ্যাঁ, বিএনপি আমলে অনেক এবং বড় বড় দুর্নীতি হয়েছে। কিন্তু তাই বলে ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পকে ৩০ হাজার কোটি টাকায় পরিণত করে ১৫ হাজার কোটি টাকাই মেরে দেয়ার নজির সৃষ্টি এবং প্রবণতা তৈরি করা হয়নি। কর্ণফুলী টানেলের মতো অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প এবং ওপারে শত শত কোটি টাকার বিরান বসতবাড়ি নির্মাণ করা হয়নি।

বিএনপি আমলেও ওভার ইনভয়সিং – আন্ডার ইনভয়সিং করে বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে ১৫ বছরে ২৮ লক্ষ ৫৪ হাজার ৮ শ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা (২৩৪ বিলিয়ন ডলার) দেশ থেকে পাচার করা হয়নি ( হিসাবটা দ্য ফিনান্সিয়াল টাইমস থেকে নেয়া )। বিএনপি আমলে ব্যাংকিং খাতে কিছু অনিয়ম হয়েছে। কিন্তু ব্যাংক মালিক নামধারী আওয়ামী তস্করদের মতো ব্যাংকগুলোকে ফোকলা করে আমানতকারীদের এমন সর্বনাশ করেনি। দেশের সবচেয়ে ভালো ব্যাংক হিসেবে গড়ে ওঠা ইসলামী ব্যাংকগুলোকে রুগ্ন ব্যাংকে পরিণত করে এগুলোর অস্থিত্বকেই বিপন্ন করে এস আলমদের মতো সেসময় আমানতকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা  বিদেশে সরিয়ে নেয়া হয়নি। বিএনপির কিছু মন্ত্রীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের এক সাবেক মন্ত্রীর ইংল্যান্ডে তিন শতাধিক বাড়িঘর- এস্টেট থাকবার যে কাহিনী জানা গেছে তার কি কোনো জবাব আছে? বিএনপির আমলেও অবশ্যই দুর্নীতি হয়েছে যাকে কেউই সমর্থন করবেন না। কিন্তু আওয়ামী লীগের সময়ে যা হয়েছে তাকে সাধারণ দুর্নীতি বলা যায় না – সেটা হলো  রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারী দলীয়  মাফিয়াতন্ত্রের অবাধ লুটপাট । পার্থক্যটা ডিগ্রীর নয়, মৌলিক তথা গুণগত।

বিএনপি আওয়ামী লীগের মতো এমন অবাধ লুটপাট করেনি, এই কথা বলে তাদের সম্পর্কে জনগণের আশংকাকে বাতিল করে দেয়া যাচ্ছে না। কারণ, বেশ কিছু জায়গায় পূর্বেকার আওয়ামী চাঁদাবাজ,মাস্তানদের শূন্যস্থানটা বিএনপি-র লোকেরা পূরণ করছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর ছাপা হচ্ছে। এসব অভিযোগকে বিএনপির উচিৎ হবে খুব গুরত্বসহকারে নেয়া এবং খতিয়ে দেখা। আশার কথা, বিএনপি নেতৃবৃন্দ অবশ্য পত্রিকায় এ জাতীয় খবর প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। কিন্তু নতুন করে চাঁদাবাজি, দখলদারি থামানো যাচ্ছে না। ফলে তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক পারসেপশান কমছে না। দুর্নীতিবাজ–দুর্বৃত্ত দলীয় কর্মীদের বিরুদ্ধে এমন কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে নতুন করে কেউ এ ধরনের অপকর্ম করতে সাহস না পায়।
ইদানিং প্রচারণা চালানো হচ্ছে, ক্ষমতায় যাবার জন্য বিএনপি নয়াদিল্লীর সাথে সন্ধী করে ফেলেছে। তারেক রহমান ইতোমধ্যে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতের সাথে আপস করে ফেলেছেন। কেউ বুঝে এবং অংক কষে এই প্রচারণা চালাচ্ছে, কেউবা আবেগের বশবর্তী হয়ে বিষয়টার গভীরে না গিয়ে সহজ অনুমান থেকে এদের সাথে যোগ দিয়েছেন। অথচ ভারতের কারণেই যে খালেদা জিয়া, তারেক রহমান এবং বিএনপির নির্যাতন, দুর্ভোগ এবং এতদিন ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা তা একটি মহল ইচ্ছা করেই চেপে যাচ্ছেন এবং অপর মহলটি তা ভুলে যাচ্ছেন। তারা কি জানেন না যে বিএনপি যদি চাইতো তাহলে দিল্লির সাথে আপস করে আগেই ক্ষমতায় যেতে পারতো বা ক্ষমতায় ভাগ বসাতে পারতো? এরা পাল্টা যুক্তি দেন, ভারত বিএনপিকে বিশ্বাস করতে পারেনি বলেই তাদেরকে ক্ষমতায় আসতে দেয়নি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তারা এই দলকে আস্থায় নিতে পারেনি কেন? কারণ তারা জানে, খালেদা জিয়া আপসহীন এবং বিএনপি ভারতের  কাছে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্বার্থকে বিকিয়ে দেবার মতো দল নয়। যারা এখন বিএনপি নেতৃত্বকে আপসকামী বলছেন তারাই সেসময় সফরকারী ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির সাথে নিরাপত্তাজনিত কারণে খালেদা জিয়া দেখা করতে না যাওয়ার সিদ্ধান্তকে হঠকারি বলে তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। এরা শাঁখের করাতের মতো বিএনপিকে দুদিকেই কাটেন।

এরা ধরে নিয়েছেন বিএনপি এবার ক্ষমতায় যাচ্ছে এবং তারা  চাচ্ছেন, ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই বিএনপির সাথে নয়াদিল্লীর একটা চরম বিরোধ বাঁধাতে। তাতে আখেরে তাদের লাভ হবে। অন্যদিকে একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি তার তিনদিক পরিবেষ্টিত দেশটির সাথে আগ বাড়িয়ে বিরোধ সৃষ্টি করতে পারে না। বাংলাদেশের পক্ষে তো তার প্রতিবেশীকে বদলে ফেলা সম্ভব নয়। ভূগোল একটা নির্মম বাস্তবতা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ভারতের কাছে আমাদের Vital National Interest তথা গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়াটা মেনে নেয়া হবে। বিএনপি যদি এটা করে তাহলে এই দলটিও আওয়ামী লীগের মতো ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। আশা করা যায় এই বিষয়টি বিএনপির ভালোভাবেই জানা আছে।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বিএনপিতে ডান, বাম, মধ্যমসহ বিভিন্ন ধারার লোক আছে। বিএনপি চীনপন্থী, ভারতপন্থী, পাকিস্তানপন্থী বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রপন্থী দল নয়। এটি একটি বাংলাদেশপন্থী দল যার মূল প্রেরণা হচ্ছে ”প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ।”এর পরেও বাস্তবতা হচ্ছে, এই দলের ভেতরেও ওয়াশিংটন, বেইজিং, নয়াদিল্লী কিংবা ইসলামাবাদ ঘেঁষা বা তাদের কারো প্রতি বেশি বন্ধু মনোভাবাপন্ন প্রভাবশালী লোকজন রয়েছেন। তাদের কারণে দলীয় সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হতে পারে।

ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য  বিএনপি ভারতের সাথে আপস করেছে বলে যে ধারণা সৃষ্টি হয়েছে তার একটি কারণ,  ভারত সম্পর্কে বিএনপির ভূমিকাটা এখন অস্পষ্ট বলে মনে হচ্ছে। এটাকে স্পষ্ট করতে হবে। তিস্তা প্রকল্প কাকে দেয়া হবে, ভারতকে নাকি চীনকে সে সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান খোলাসা করতে হবে। এর আগে বিএনপি সরকারের আমলে অযথা চীনকে ক্ষেপিয়ে বাংলাদেশে তাইপের একটি প্রতিষ্ঠানের অফিস খুলতে দেয়া হয়েছে। কোয়াড নিয়ে বিএনপির ভাবনাটা প্রকাশ করতে হবে। বিএনপিকে  এমনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যাতে চীন, ভারত, আমেরিকা সকলেই মনে করে বাংলাদেশ নিজেদের স্বার্থ দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কাউকে খুশি এবং অন্যকে অখুশি করার জন্য নয়। তাহলে আমরা কারো বিরাগভাজন হব না।
পারসেপশান  (ধারণা) এবং বাস্তবতা কিন্তু এক নয়। কখনো কখনো তা সম্পূর্ণ বিপরীতও হতে পারে। একজন সম্পর্কে বাইরে থেকে খারাপ ধারণা হতে পারে। কিন্তু ঘনিষ্ঠভাবে জানার পর এই ধারণাটা পাল্টেও যেতে পারে। কোনো ভালো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি সম্পর্কে সমাজে বা জনমনে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হলে সঠিক ব্যাখ্যা ও উপস্থাপনার মাধ্যমে তা ইতিবাচক ধারণায় রূপান্তরিত করা সম্ভব। হাতে কিন্তু বেশি সময় নেই। বিএনপিকে দ্রুত এ ব্যাপারে একটি চৌকস সেল গঠন করে মাঠে নামতে হবে।

এটা ডিজিটাল টেকনোলজির যুগ। ছাত্রশিবির গত ডাকসু নির্বাচনে এই টেকনোলোজি অত্যন্ত  smartly বা বুদ্ধিমত্তার সাথে ব্যবহার করে ছাত্রদলকে এই ব্যাপারে কুপোকাত করেছে। তারা কম্পিউটারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সকল ছাত্র-ছাত্রীর ডাটাবেজ সংগ্রহ করেছে এবং তাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে এমনকি তাদের অভিবাবকদের সাথেও কথা বলেছে। জাতীয় নির্বাচন তো সামনে। বিএনপির উপজেলা পর্যায়েও ভালো সাংগঠনিক কাঠামো আছে। সেখানে ডিজিটাল টেকনোলোজিকে কার্যকরভাবে গড়ে তুলে ভোটারদের কাছে যেতে হবে। মেঠো সভা-সমাবেশ এবং দলীয় কর্মীর সংখ্যায় তারা হয়ত প্রতিপক্ষকে টেক্কা দিতে পারবে। কিন্তু  এখনকার ডিজিটাল যুগের কথাটাও তাদের মাথায় রাখতে হবে।

আগামী নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এক সময়ে দলের ভূমিকাটাই ছিল প্রধান। তখন দলীয় পরিচয়ে ”কলাগাছও” নির্বাচিত হয়ে যেতে পারতেন। সেদিন এখন আর নাই। এবার ডাকসু নির্বাচনে তা প্রমাণিত হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে সব দলকেই এ বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

• আনিসুর রহমান সুইডেন প্রবাসী একজন সিনিয়র বাংলাদেশী সাংবাদিক

Exit mobile version