– মাহমুদুর রহমান ০৯-০৭-২০২২
হিন্দু পুরাণ, মহাভারতের গল্প বলছি। পান্ডবদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে কুরুপান্ডবের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। সেই যুদ্ধে অন্ধ কৌরবরাজ ধৃতরাষ্ট্র ও রাণী গান্ধারীর শতপুত্রের মধ্যে দলত্যাগ করে পান্ডবদের সাথে মিশে যাওয়া মাত্র একজন ছাড়া আর সবাই নিহত হয়েছে। সম্পর্কে কৌরবরাজ বিজয়ী পঞ্চপান্ডবদের পিতৃব্য। যুদ্ধশেষে যুধিষ্ঠির, অর্জুন, ভীম, নকুল এবং সহদেব, পাঁচ পান্ডব গেছে চাচার কাছে তার নিরানব্বই পুত্র হত্যার জন্য ক্ষমা চাইতে। এদিকে বৃদ্ধ কৌরবরাজ অন্ধ হলেও প্রচন্ড শক্তি রাখেন। এমনই শক্তি যে, রাজা কাউকে দুই হাতের মধ্যে পেলে পিষে মেরে ফেলতে পারেন। তিনি অপেক্ষা করে আছেন ভীমের জন্য। সে কাছে এলে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরবার ছলে পিষে মেরে ফেলবেন, এই হলো মৃত্যুর আগে শেষ বাসনা। ভীমের ওপর ভয়ংকর ক্রোধ, কারণ সে অন্যায়ভাবে গদাযুদ্ধের নিয়ম ভেঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রিয় পুত্র দুর্যোধনকে হত্যা করেছে। এদিকে রাজার পরিকল্পনার কথা পঞ্চপান্ডব আগেভাগেই জেনে ফেলেছে। প্রথমে বড়পান্ডব যুধিষ্ঠির গেছে চাচার পদস্পর্শ করতে। ধৃতরাষ্ট্র ভাতিজার মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করলেন। দ্বিতীয় পান্ডব অর্জুনের ক্ষেত্রেও আনুষ্ঠানিকতার কোন ব্যতিক্রম হলো না। এবার তিন নম্বর ভীমের পালা। পাঁচ ভাই আগেই যুক্তি করে এসেছিল। আসল ভীমের জায়গায় তারা লোহা দিয়ে তৈরি ভীমের এক মূর্তি অন্ধ রাজার সামনে এগিয়ে দিল। তিনি সেই লোহার ভীমকে এমনভাবে চাপ দিলেন যে সেটি চুরমার হয়ে গেল। এই গল্পে বোঝা গেল, আলিঙ্গন সবসময় নিরাপদ নয়। মহাভারতের গল্প থেকে বাস্তবে ফেরা যাক।
গুজরাটের কসাই নরেন্দ্র মোদি বিদেশি নেতাদের আলিঙ্গন করতে খুবই ভালবাসেন। এই কিছুদিন আগে নরেন্দ্র মোদি এবং জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল গুতেরেসের একটা ছবি খুব ভাইরাল হয়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে মাস্ক দিয়ে মুখ না ঢেকেই, নরেন্দ্র মোদি গুতেরেসকে আলিঙ্গন করবার জন্য দুই হাত বাড়িয়ে তার ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ছেন, আর মহাবিরক্ত গুতেরেস ভ্রু কুঁচকে, শরীর পিছনে বাঁকা করে মোদির আলিঙ্গন থেকে রক্ষা পাওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। আমি যতদুর জানি আন্তর্জাতিক দেখাসাক্ষাতের প্রটোকল আগেই ঠিক করা থাকে। মোদি সম্ভবত: সেই প্রটোকল ভেঙ্গেছিলেন বলেই এই বিপত্তি ঘটেছে। তবে সব বিদেশি নেতারাই যে মোদির আলিঙ্গনস্পৃহাকে অপছন্দ করেন ব্যাপারটা সেরকম নয়। অনেকেই তার আলিঙ্গনে সোৎসাহেই ধরা দেন। ট্রাম্প আর বরিস জনসনের কথাই বলি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে মোদির বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছিল এবং প্রতিবারই মোদি তাকে জড়িয়ে ধরেছেন। মোদির ইংরেজী নিয়ে ট্রাম্প তার স্বভাবসুলভ কায়দায় হাসিঠাট্টা করলেও দুই মুসলিমবিদ্বেষী নেতার মধ্যে বেজায় খাতির ছিল। ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মোদি কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভঙ্গ করে ভারতীয় বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দিতেও আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিজেপির লোকজন ট্রাম্পের বিজয়ের জন্য ভারতে পূজাআর্চার বন্দোবস্তও করেছিল। কিন্তু মোদির আলিঙ্গনে হিতে বিপরীত হয়েছে। বাইডেনের কাছে নির্বাচনে হেরে ট্রাম্প কিছু সন্ত্রাসী ভক্তদের দিয়ে মার্কিন কংগ্রেসে তান্ডব সৃষ্টি করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে সেই নজিরবিহীন ঘটনার বিচার এখনও চলছে। সেই বিচারে ট্রাম্পও উসকানি প্রদানের দায়ে ফেঁসে যেতে পারেন। ব্যাপারটা ওই পর্যন্ত গড়ালে, ২০২৪ এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের আবারও প্রতিদ্বন্দিতা করার ইচ্ছা আর বাস্তবে রূপ নেবে না। সুতরাং, মোদির একাধিক আলিঙ্গন ট্রাম্পের জন্য অশুভ ফল নিয়ে এনেছে বলেই এখন পর্যন্ত প্রতীয়মান হচ্ছে।
বৃটেনের চরম ইসলামবিদ্বেষী প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন কদিন আগে ভারত সফরে এসে মোদির সাথে উষ্ণ আলিঙ্গন করে গেছেন। সফরকালে জনসন ভারতে মুসলিম জনগণের উপর চলমান রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের প্রতীক ‘বুলডজার’ নিজে চালিয়ে বেশ বিতর্কেরও সৃষ্টি করেছেন। বিজেপি সরকার বিভিন্ন রাজ্যে বেআইনীভাবে মুসলমানদের বাসস্থান, মসজিদ, ব্যবসায়িক স্থাপনা এখন নিয়মিতভাবে বুলডজার দিয়ে গুড়িয়ে দিচ্ছে। হিন্দুত্ববাদিরা বুলডজারকে প্রায় নব্য দেবতা বানিয়ে ফেলেছে। তারা উত্তর প্রদেশের মুসলিমবিদ্বেষী, ফ্যাসিস্ট মুখ্যমন্ত্রী কথিত যোগী আদিত্যনাথের মুসলমানদের উপর নির্মমভাবে নির্যাতন করার সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে ‘বুলডজার বাবা’ নতুন নামকরণ করেছে। সেই বুলডজারে চড়ে বরিস জনসন নানান ভঙ্গিমায় ছবি তুলে ভারতে সংখ্যালঘু নির্যাতনকে একপ্রকার বৈধতা দিয়ে গেছেন। বৃটেনে ফিরে মোদির আলিঙ্গনের স্বাদ ভোলার আগেই বরিস জনসনের বিরুদ্ধে অযোগ্যতা ও অনৈতিকতার অভিযোগ তুলে তার দলের মন্ত্রি, এম পিরা বিদ্রোহ করায় তিনি কনজারভেটিভ দলের প্রধানের পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছেন। বৃটেনের ক্ষমতাসীন দলটির নতুন প্রধান নির্বাচিত হওয়া মাত্র বরিস জনসনের প্রধানমন্ত্রীত্বের পদও চলে যাবে। তিনি এখন কোন ক্রমে শরৎকাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর পদে টিকে ধাকার জন্য দেনদরবার করছেন। অথচ এই বরিস জনসনের নেতৃত্বেই গত নির্বাচনে কনজারভেটিভ দল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বৃটেনে সরকার গড়েছিল। এ ক্ষেত্রেও মোদির আলিঙ্গনে হিতে বিপরীত হয়েছে।
আশা করি, পাঠক এতক্ষণে ধরতে পেরেছেন যে, আমি কেন আজকের সম্পাদকীয় মহাভারতের অন্ধরাজার আলিঙ্গনের গল্প দিয়ে শুরু করেছি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং প্রধানমন্ত্রী জনসনের পরিণতির পর হয়ত অনেক বিদেশি নেতারাই এখন জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল গুতেরেসের মত মোদির আলিঙ্গন থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবেন। বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বছরের সেপ্টেম্বরে ভারত সফরের কথা রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রি আবদুল মোমেনের বক্তব্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক থাকলেও, শেখ হাসিনাও হয়ত ট্রাম্প এবং জনসনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভারত সফরের সময় মোদির আলিঙ্গন থেকে দূরে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। বাংলাদেশে প্রবাদই তো রয়েছে, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। আলিঙ্গনের সময় এলে হাসিনা আবদুল মোমেনকে ঠেলে দিতে পারেন।
অরণ্যে রোদন জেনেও বিএনপির নেতৃত্বের প্রতি একটা পরামর্শ রেখে আজকের সম্পাদকীয় শেষ করব। জনশ্রুতি শুনতে পাই, শহীদ জিয়ার মত দেশপ্রেমিক, সাচ্চা জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রনায়কের হাতে গড়া দলটির বর্তমান শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অনেকের মনে নাকি হিন্দুত্ববাদি মোদির আলিঙ্গন প্রাপ্তির বড়ই বাসনা। মহাভারতের রাজা ধৃতরাষ্ট্র যেমন করে লোহার ভীম আলিঙ্গনে চুরমার করে দিয়েছিলেন সেই করুণ পরিণতি ভোগ করতে না চাইলে মোদির আলিঙ্গন থেকে দূরে থাকুন।
লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ
০৯-০৭-২০২২