Site icon The Bangladesh Chronicle

মোদির রকফেলার : গৌতম আদানির বিস্ময়কর উত্থান

 

driknews.com

২০২২-০৯-২০

হাসান শাওন

ভারতে গৌতম আদানির পরিচিতি ‘মোদির রকফেলার’ হিসেবে। বাংলাদেশের ক্ষমতা-ঘনিষ্ঠ মহল এবং স্বয়ং আদানির বক্তব্য থেকে পরিষ্কার যে সামনের দিনে আদানি গ্রুপ বাংলাদেশে একটি প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছে। আদানি গ্রুপের এই বিপুল বিস্তার কীভাবে সম্ভব হলো, সেটা নিয়ে পাঠকদের একটা ধারণা দেওয়াই বর্তমান রচনার লক্ষ্য।

সদ্য সমাপ্ত হওয়া ভারত সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন আদানি গ্রুপের শীর্ষকর্তা গৌতম আদানি। ব্লুমবার্গের তালিকা অনুযায়ী এশিয়ার শীর্ষ ধনী ও বিশ্বের ২য় শীর্ষ ধনী হিসেবে বিবেচিত ভারতের এই গৌতম আদানি। শেখ হাসিনার সঙ্গে তার আলোচনার সূত্রে বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে আদানি গ্রুপের নানা তৎপরতা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায়। তাতে বলা হয়, উন্নয়নে একে অন্যের সহযোগিতা প্রত্যাশা করা হয়েছে গৌতম আদানি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকে।

 

 

গৌতম আদানি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস

সংবাদভাষ্য জানাচ্ছে, আদানি গ্রুপের বাংলাদেশকেন্দ্রিক সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এটি নির্মিত হচ্ছে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে। ভারতের ঝাড়খন্ডে অবস্থিত এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের পুরোটাই দেশে রফতানি হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৮০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার ইউনিট-১-এর বাণিজ্যিক উৎপাদনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ১৬ ডিসেম্বর। আর দ্বিতীয় ইউনিটটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসবে আগামী বছরের ২৬ মার্চ।

দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বিদ্যুতের দাম ও ক্যাপাসিটি চার্জ বেশ বেশি। এ বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন দি এক্সটার্নাল ডেট ও ভারতভিত্তিক গ্রোথওয়াচের এক যৌথ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে,আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ নেওয়া না গেলে এর বিপরীতে বড় অংকের ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে বাংলাদেশকে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে বার্ষিক ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৪ হাজার ৪২০ কোটি ৮৫ লাখ ২৫ হাজার ৮৬৮ টাকা।

আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ নেওয়া না গেলে এর বিপরীতে বড় অংকের ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে বাংলাদেশকে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে বার্ষিক ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৪ হাজার ৪২০ কোটি ৮৫ লাখ ২৫ হাজার ৮৬৮ টাকা

শুধু জ্বালানি খাত নয়, দেশের নৌ-পরিবহন এবং সেবা খাতেও বৃহৎ পরিসরে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী ভারতকেন্দ্রিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আদানি গ্রুপ। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান সম্প্রতি এ তথ্য দৈনিক প্রথম আলোকে জানান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর একটি ছবি টুইটার থেকে গৌতম আদানি পোস্ট দেন। আদানি এতে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পেরে আমি অত্যন্ত সম্মানিত। বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা অত্যন্ত সাহসী এবং অনুপ্রেরণা দেয়।’ ঝাড়খন্ডের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা উল্লেখ করে আদানি তার টুইটে লিখেছেন, ‘বিজয় দিবস, অর্থাৎ ২০২২ সালের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে গোড্ডা বিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ প্রসঙ্গত, আদানি গ্রুপের অন্যতম সহযোগী প্রতিষ্ঠান আদানি পাওয়ার এই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে। ঝাড়খন্ড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য আলাদা একটি সঞ্চালন লাইন তৈরি করেছে আদানি পাওয়ার।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় আদানি গ্রুপ বাংলাদেশের কোন কোন খাতে নতুন করে বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে জানতে চাইলে সালমান এফ রহমান সংবাদমাধ্যমকে জানান, গৌতম আদানি তাদের বন্দরটি বাংলাদেশকে ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছেন। আমরা এখন কলম্বো বা সিঙ্গাপুর হয়ে পণ্য পাঠিয়ে থাকি। তিনি ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য আদানির বন্দর ব্যবহার করতে বললেন। ‘এ ছাড়া আদানি গ্রুপ বিদ্যুতের যে সঞ্চালন লাইন তৈরি করেছে, সেটার ধারণক্ষমতা তো বেশি। এবার তারা সোলার ও উইন্ড মিলে ব্লেন্ডেড এনার্জির নতুন একটি প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাবটি অভিনব এবং ভালো। গৌতম আদানির এসব প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।’

এর কয়েকদিন আগে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম দৈনিক প্রথম আলোকে জানান, এর পাশাপাশি আদানি গ্রুপ বাংলাদেশে আরও বৃহৎ আকারে বাংলাদেশের জ্বালানি ও অবকাঠামো খাতে সুনির্দিষ্ট বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। বিভিন্ন দপ্তরে ও মন্ত্রণালয়ে এসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, এ তথ্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন।

যেভাবে আদানির ফেঁপে ওঠা

১৯৬২ সালের ২৪ জুন গৌতম আদানির জন্ম গুজরাটের আহমদাবাদে। গৌতমের বাবা ছিলেন ছোট আকারের কাপড় ব্যবসায়ী। পরে যা রূপ নেয় টেক্সটাইল কারখানায়। কিন্তু কোনো আহামরি ধনী আদানি পরিবারের কেউ কখনও ছিলেন না।

গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অফ কমার্স ডিগ্রি লাভের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন গৌতম আদানি। কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষেই তিনি পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে শিক্ষাঙ্গন ত্যাগ করেন। তখনই শুরু হয় তার পেশা জীবন।

১৯৭৮ সালে মুম্বাইয়ের মাহেন্দ্রা ব্রাদার্সের একটি হীরা ও স্বর্ণের দোকানে কর্ম জীবন শুরু গৌতম আদানির। হীরার উজ্জ্বলতা বাড়ানোর কাজ করতেন সেখানে। কিন্তু অন্যের হীরা নিয়ে কাজে আদানির মন বসেনি।

১৯৮১ সালে গৌতমের বড় ভাই মাহাসুখভাই আদানি আহমদাবাদে একটি প্লাস্টিক কারখানা ক্রয় করেন। তিনি গৌতমকে দায়িত্ব দেন এর ইউনিট অপারেশন পরিচালনার। এই কারখানাই পরবর্তীতে আদানি গ্রুপের বিশ্বজুড়ে পলিভিনাইল ক্লোরাইড (পিভিসি) আমদানির পথ সুগম করে। ১৯৮৫ সালে ভারত সরকারের শুল্ক সুবিধা কাজে লাগিয়ে এ বাণিজ্যে ব্যাপক মুনাফা অর্জন করে গ্রুপটি। ১৯৮৮ সালে গৌতম কোম্পানির ‘আদানি এক্সপোর্ট’ নামে নতুন একটি উদ্যোগ শুরু করেন। এই হোল্ডিং কোম্পানিটি এখন ‘আদানি এন্টারপ্রাইজ’ নামে ভারতসহ দুনিয়াজুড়ে ব্যাপকভাবে পরিচিত। ১৯৯৪ সালে আদানি ইন্ডাস্ট্রিজ ভারতের স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়।

একই বছর মুন্দ্রা বন্দর ও সে এলাকার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিচালনার দায়িত্ব বর্তায় গৌতম আদানি নেতৃত্বাধীন এ বাণিজ্যিক গ্রুপের ওপর। গৌতম নিজেও একে তার বণিক তৎপরতার এক উল্লফন হিসেবে মনে করে থাকেন।

গুজরাটের দাঙ্গা ও গৌতম আদানির উত্থান

গুজরাট দাঙ্গায় হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ যায়। ছবি: দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

২০০২ সালে ভারতের গুজরাটে এক ভয়াবহ রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত হয়। উত্তেজিত হিন্দুরা সে সময় মুসলিমদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। শিশু, নারীসহ নির্বিচারে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদের খুন করা হয়। ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হয় অসংখ্য মসজিদ ও কবরস্থান। নরেন্দ্র মোদি তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। কাশ্মীরের গোধরায় হিন্দু তীর্থবাহী ট্রেনে আগুন দেয়ার প্রতিক্রিয়ায় সংঘটিত এই দাঙ্গাকে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন তখনকার গুজরাট রাজ্য সরকার থামাবার আদৌ কোনো চেষ্টা করেননি, বরং তার বিরুদ্ধে এ দাঙ্গায় মদদ দেয়ার শক্তিশালী অভিযোগ রয়েছে। পরের কয়েক সপ্তাহে হাজারো মানুষের প্রাণ যায় এতে। প্রাণ বাঁচাতে ১ লাখের বেশি মুসলমানকে অন্য রাজ্যে শরণার্থী হতে হয়।

২০০২ সালে গুজরাটের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় ব্যাপকভাবে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সমর্থন জোগান গৌতম আদানি। সে সময় তাকে তার করপোরেট পরিচয়ের বাইরে মোদির সহযোগী মনে হতে থাকে। দাঙ্গা প্রশমন বা নিবারণে গুজরাটে প্রভাবশালী গৌতম আদানি বা তার প্রতিষ্ঠানের কোনো সক্রিয়তা ছিল না।

ইন্ডিয়া টাইমসের বিবরণ অনুযায়ী,  গুজরাটে ২০০১ সালে রাজ্যে দলের নেতৃত্বে আসীন হন নরেন্দ্র মোদি। তিনি জানতেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হতে তাকে নির্বাচনে জিততে হবে। বিশ্লেষক আকিয়াক ইয়াগনিকের মতে, মোদি প্রমোদ মহাজনের প্রভাবের ওপর নির্ভর করতে চাননি। তিনি তার নিজস্ব অর্থের উৎস খুঁজছিলেন। তা সহজ ছিল না শুরুতে। গুজরাটের দায়িত্ব মোদির মতোন রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ (আরএসএস) এর নেতাকে দেওয়াতে ব্যবসায়ী মহল রীতিমত উদ্বিগ্ন ছিল।

ইয়াগনিকের মতে, তখনও মোদি গৌতম আদানির প্রতি আস্থাশীল ছিলেন না। গ্রুপটির রাতারাতি উত্থান দেখে তাকে ভাবতেন কেশুভাইয়ের (বিজেপির প্রবীণ নেতা, গুজরাটের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী) অনুসারী হিসেবে। তিনি আরও মনে করেন, ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে পরের বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোদির ঘনিষ্ঠ হতে সময় লাগে আদানির। ২০০২ সালের নির্বাচন তখন আসন্ন।

মোদি প্রধানমন্ত্রী হবার পরে গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পরিস্থিতি বদলে যায়। কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি (সিআইআই) এর ব্যবসায়ীদের বড় অংশটি মোদির সমালোচনা করেন। সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা ব্যবসার পরিস্থিতি খারাপ করবে, এই ছিল তাদের আশঙ্কা। কিন্তু রাজ্যে মোদি মদদ পান আদানি, কাদিলা গ্রুপের ইন্দ্রভাদন মোদি, নিরমা গ্রুপের কর্ষণভাই প্যাটেল এবং বাকেরি ইঞ্জিনিয়ার্স গ্রুপের অনিল বাকেরি মতো ব্যবসায়ী ও শিল্পগ্রুপের কাছ থেকে। মোদির সমর্থনে এরাই গঠন করে রিসার্জেন্ট গ্রুপ অফ গুজরাট (আরজিজি)। এ গোষ্ঠী কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি (সিআইআই) কে হুমকি দেয় সংগঠন ত্যাগের।

গুজরাট দাঙ্গা মোদিকে বহুভাবে অস্তিত্বের সঙ্কটে ফেলেছিল। বিশ্বব্যাপী নিন্দার পাশাপাশি রাজ্যস্তরেও তিনি বেশ প্রতিরোধের মুখে পড়েছিলেন। সে বছর গুজরাটে ‍”ভাইব্রেন্ট গুজরাট সামিট” নামে এক বাণিজ্য সম্মেলনের কর্মসূচি ছিল। এই আয়োজনে আদানি গ্রুপ একাকভাবে ঢালে ১৫ হাজার কোটি রুপি। রাজ্যে রিলায়েন্স গ্রুপকে টপকে যাওয়ায় তারা তখন মরিয়া।

এরপর থেকেই ‘মোদির রকফেলার’ নামে ভারতীয় গণমাধ্যমে নিয়মিত আলোচিত হতে থাকে আদানির নাম। গৌতম আদানির আনুগত্য সম্পর্কে এবার নিশ্চিন্ত হন নরেন্দ্র মোদি। এরই কৃতজ্ঞতায় মোদি নানা রাষ্ট্রীয় সুবিধা পাইয়ে দেন আদানি গ্রুপকে।

এরপর আদানি গ্রুপ ভারতের একের পর এক বন্দর ও বিশেষায়িত শিল্প এলাকা নির্মাণ ও তত্ত্বাবধানের ঠিকাদারি পেতে থাকে। অভিযোগ রয়েছে, এসব কাজে দুর্নীতির মাধ্যমে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিয়ে আদানি গ্রুপকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে এবং কাজ পেতে গৌতম আদানি তার রাজনৈতিক যোগাযোগকে ব্যবহার করেছেন। 

২০১৩ সালে নরেন্দ্র মোদির বক্তৃতা দেয়ার কথা ছিল বিখ্যাত মার্কিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হোয়ার্টন বিজনেস স্কুলে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির অতীত নিয়ে বিতর্ক এবং গুজরাট দাঙ্গায় তার সম্পৃক্ততার কারণে সমালোচনা উঠলে এই আমন্ত্রণ বাতিল করা হয়। জবাবে আদানি শিল্প গোষ্ঠী এই প্রতিষ্ঠানটিতে তাদের প্রতিশ্রুত স্পন্সরশিপ বন্ধ করে দেয়। এভাবে নানান সঙ্কটেই আদানি পাশে থেকেছেন নরেন্দ্র মোদির।

৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩ সালে ইকোনোমিক টাইমস অব ইন্ডিয়া’য় প্রকাশিত কলামনিস্ট এম রাজশেখরের এক লেখা থেকে জানা যায়, গত ১৫ বছরে গুজরাটের অবকাঠামো নির্মাণে প্রায় ৪৭ হাজার কোটি রুপির কাজ দেওয়া হয়েছে আদানি গ্রুপকে।

এরপর আদানি গ্রুপ ভারতের একের পর এক বন্দর ও বিশেষায়িত শিল্প এলাকা নির্মাণ ও তত্ত্বাবধানের ঠিকাদারি পেতে থাকে। অভিযোগ রয়েছে, এসব কাজে দুর্নীতির মাধ্যমে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিয়ে আদানি গ্রুপকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে এবং কাজ পেতে গৌতম আদানি তার রাজনৈতিক যোগাযোগকে ব্যবহার করেছেন।

যেন জুটি বেধে চলছে আদানি-মোদি মিত্রতা। সূত্র: আদানিওয়াচ

ভারতের প্রভাবশালী গণমাধ্যম ‘এনডিটিভি’ এর এক প্রতিবেদনে দৃশ্যমান হয়, নরেন্দ্র মোদির রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হওয়ার সাথে গৌতম আদানির ব্যবসা সম্প্রসারণ, সম্পত্তি, সম্পদ ও প্রভাব বৃদ্ধির নজিরবিহীন নমুনা। মোদির আমলের শুরুর ২ বছরেই গৌতম আদানির সম্পদের পরিমান ৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে। মার্কিন ধনকুবের ওয়ারেন বাফেটকে অতিক্রম করে গৌতম আদানি হয়ে ওঠেন গ্রহের ৫ম শীর্ষ ধনী।

সম্পত্তির অংকে ওয়ারেন বাফেটকেও ছাড়িয়ে গেছেন আদানি। ছবি: গার্ডিয়ান

একচেটিয়া ব্যবসা করার বেলায় আদানি এমন বহু সুবিধা পেয়েছেন, অন্য ব্যবসায়ীদের জন্য তা অচিন্তনীয়। নিজস্ব বন্দর ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির উসুল হিসেবে ভারতের পরিবেশ আদালত ২০০ কোটি রুপি জরিমানা করে আদানি গ্রুপকে, ২০১৬ সালে। কিন্তু এই জরিমানা মওকুফ করা হয়। এ নিয়ে ভারত জুড়ে প্রশ্ন ওঠে, মোদির কথিত “আচ্ছে দিন” কেবল আদানি পরিবারের জন্য কি না, তা নিয়ে লেখালেখি হয়।

অন্যদিকে ‘দ্য হিন্দু’ এর এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে শ্রীলঙ্কায় আদানি গ্রুপের ব্যবসা সম্প্রসারণে নরেন্দ্র মোদির তৎপরতা। দেশটির বিদ্যুৎখাতে আদানিকে ব্যবসা দিতে সাবেক রাষ্ট্রপতি রাজাপাকসেকে দিয়ে চাপ প্রয়োগ করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।

ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’তে মিরা ত্রিভাষণ লিখিত ২০২২ সালের ১২ জুন প্রকাশিত এক বার্তায় এ তথ্য পাওয়া যায়।

শুধু শ্রীলঙ্কা নয়, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অস্ট্রেলিয়ায়ও আদানি গ্রুপের ব্যবসায় অনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ আছে।

২০০৬ সালে আদানি গ্রুপ অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে একটি কয়লাখনি ক্রয় করে। এর বিরুদ্ধেও সারা বিশ্বের পরিবেশবাদীরা সোচ্চার হন। এক সময় পরিবেশ আন্দোলনে তরুণদের জনপ্রিয় কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত গ্রেটা থানবার্গও এ নিয়ে প্রতিবাদ জানান। এক পর্যায়ে জাতিসংঘও অস্ট্রেলিয়া সরকারকে এ প্রকল্প থেকে সরে আসার আহ্বান জানায়। তাতে এ কার্যক্রম থেকে সরে আসেনি গ্রুপটি।

২০১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে আদানি গ্রুপের কয়লাখনি বন্ধ করা উচিত এই মর্মে জাতিসংঘ অস্ট্রেলিয়ার সরকারকে অনুরোধ করে। পরিবেশ দূষণের সঙ্গে খনিটি কুইন্সল্যান্ডের প্রকৃত ভূমির আদিমালিকদের অধিকার ক্ষুন্ন করছে বলে জাতিসংঘ জানায়।

অস্ট্রেলিয়ায় আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। সূত্র: এনডিটিডিডটকম

 

যে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য তৈরি করা বিদ্যুৎকেন্দ্র তা নির্মাণেও আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে ভারতের ঝাড়খন্ডে ও গাড্ডায় আদিবাসী কৃষকদের জমি দখল করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উন্মুক্ত কয়লাখনি স্থাপনের অভিযোগ রয়েছে। সংবাদমাধ্যমে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর ভাষ্যে জানা যায়, স্থানীয়দের কাছে বলা হয় এতে এলাকার উন্নয়ন হবে এবং তারাও স্বচ্ছলতার মুখ দেখবেন। যদিও বাস্তবে ঝাড়খন্ডের কয়লাখনি জমির উর্বরতা নষ্ট করাসহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। ভারতের পরিবেশবাদী থেকে শুরু করে ন্যায্যতার পক্ষে থাকা সকল নাগরিক এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন।

৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে দ্য ওয়্যার- এ প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায়, আদানি গ্রুপের ঝাড়খন্ডের গন্দালপুরে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রায় ৪ হাজারের বেশি অধিবাসী ভূমিচ্যূত হন। সে এলাকায় দূষণের শিকার হচ্ছে দামোদর ও ব্রাহমাদিয়ার মতো দুটি প্রধান নদী। বাস্তুভিটাসহ উর্বর জমি হারানো কৃষকরা এ নিয়ে প্রতিবাদ করেন। তাতে কোনো লাভ হয় না। ভারতের ভূমি অধিগ্রহণ আইন ২০১৩ পর্যন্ত লঙ্ঘন করেছে আদানি গ্রুপ।

আদানির কয়লাখনির বিরুদ্ধে ঝাড়খন্ডে আদিবাসীদের বিক্ষোভ। সূত্র: আদানিওয়াচ

২০২১ সালে ২ অক্টোবর মহাত্মা গান্ধির জন্মদিনে ভারতের হাসদেও অরণ্যের আদিবাসী মানুষরা তাদের নিজেদের ভিটায় আদানি গ্রুপের উদ্যোগে নির্মিত হতে যাওয়া কয়লাখনির বিরুদ্ধে পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে প্রতিবাদ জানায়।

২০১৯ সালে ভারত সরকার মুম্বাইসহ ৬টি বিমানবন্দর বেসরকারিকরণ করে। এগুলো তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পায় আদানি গ্রুপ। গণমাধ্যম ইকোনোমিক্স টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় ১৬ অক্টোবর ২০১৯ এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, এ প্রাপ্তিতে আইন লঙ্ঘন হয়েছে বলে বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মনে করেন। কেরালা ও মুম্বাই আদালতে মামলা দায়ের করা হয় আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উচ্চআদালত আদানি গ্রুপের পক্ষেই রায় দিয়েছে।

ভারতের প্রভাবশালী গণমাধ্যম দ্য হিন্দু বিজনেস লাইন এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি চারজন ভারতীয় বিমান যাত্রীর একজনকে এখন আদানির বিমানবন্দর ব্যবহার করতে হয়। গৌতম আদানি নিজেই সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য সংবাদমাধ্যমকে জানান।

ইতোমধ্যে এই বেসরকারীকরণের ফলে ভারতের বিমানযাত্রীদের ব্যয় বেড়ে গেছে। সংবাদমাধ্যম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ন্ড এর ২৩ আগস্ট ২০২২ সালের এক নিবন্ধ অনুযায়ী ধারণা করা হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট যাত্রীদের বিমানবন্দর ব্যবহারের খরচ বৃদ্ধি পাবে ২৫০ রুপি খরচ ২০২৬ সাল নাগাদ গিয়ে দাঁড়াবে ৭২৫ রুপিতে।

ইতোমধ্যে এই বেসরকারীকরণের ফলে ভারতের বিমানযাত্রীদের ব্যয় বেড়ে গেছে। সংবাদমাধ্যম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ন্ড এর ২৩ আগস্ট ২০২২ সালের এক নিবন্ধ অনুযায়ী ধারণা করা হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট যাত্রীদের বিমানবন্দর ব্যবহারের খরচ বৃদ্ধি পাবে ২৫০ রুপি খরচ ২০২৬ সাল নাগাদ গিয়ে দাঁড়াবে ৭২৫ রুপিতে।

এভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কয়লাখনি, বিদ্যুৎ, পরিবহন, লজিস্টিকস, বন্দর, এয়ারপোর্ট, রেল, ভোজ্যতেল, আবাসন, আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসায় যুক্ত হয় আদানি গ্রুপ। গত সপ্তাহের তথ্যানুযায়ী গ্রুপটির বাজার মূলধন ২৫ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে।

বিশেষ করে দ্রুত মুনাফা হয় এমন খাতগুলোর সাথে দূষণ, স্বৈরশাসন, উচ্ছেদ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে। আদানি গোষ্ঠীও তার ব্যতিক্রম নয়। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসেন সিনিয়র জেনারেল মিন অংলাই। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে এই জেনারেল আদানি গ্রুপের আমন্ত্রণে ও উপহার বিনিময়ের সুবাদে প্রতিষ্ঠানটির মুন্দ্রা বন্দর পরিদর্শন করেন। মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে একটি বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল আদানি গ্রপের। শেষপর্যন্ত ভূরাজনৈতিক কারণে আদানি গ্রুপ মিয়ানমারে তাদের বন্দরের প্রকল্প বাদ দিতে বাধ্য হয়।

গণমাধ্যমকে হয়রানি ও চাপ তৈরি

আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে একের পর এক জনঅধিকার লঙ্ঘন, পরিবেশ দূষণ, একচেটিয়া বাণিজ্য, আদিবাসীদের উচ্ছেদ ইত্যাদি বহুরকম অভিযোগ তৈরি হওয়াতে আদানিওয়াচ (www.adaniwatch.org) নামে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেছেন অ্যাকটিভিস্টরা। সেখানকার তথ্য থেকে জানা যায়, গ্রুপটির বিপক্ষে কোনো সংবাদ প্রকাশিত হলেই গণমাধ্যম ও এর কর্মীদের ওপর নেমে আসে মানহানী মামলার খড়্গ। আদানির নিজের রাজ্য হিসেবে পরিচিত গুজরাটে যেমন এটি ঘটছে, একইভাবে তা ঘটে চলেছে ভারতের অন্য অনেক অংশেও। কোভিড মহামারীর ভেতরেও গণমাধ্যমকর্মীদের দেশটির প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে এসব মামলায় হাজিরা দিতে হয়েছে। মানবাধিকারকর্মীদের মতে, এটি মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যমের প্রতি এক মারাত্মক আক্রমণ।

গৌতম আদানি এনডিটিভির বড় অংশের শেয়ার কিনে নেওয়ায় অনেকেই সংবাদমাধ্যমটির স্বাধীনতা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। ছবি: That Cartoonist Kid

সম্প্রতি ভারতের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি’র মালিকানা অধিগ্রহণের তৎপরতায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এনডিটিভির মালিকায় এই বদলের ফলে এই গণমাধ্যমটি আদানি গ্রুপ ও বিজেপির মুখপাত্রে পরিণত হবে, এমনটা আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট সকলে।

আদানি গ্রুপের বিস্তৃতির রাজনৈতিক ভিত্তি

আদানি পরিবারের এই উত্থানের সাথে বিজেপি, এবং বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদির উত্থানের এক বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। ভারতজুড়ে জাতীয় পর্যায়ে যেমন প্রতিষ্ঠানটির রমরমা স্ফীতি দেখা গিয়েছে, একইসাথে শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতেও সুবিধাজনক চুক্তি পেতেও এই রাজনৈতিক যোগাযোগ কাজ করছে।

এ বছরের ২৪ আগস্ট বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, জ্বালানি খাতে আদানি পাওয়ারের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৭০ দশমিক ১৭ বিলিয়ন রুপি। সড়ক অবকাঠামোতে এই করপোরেশনটির বিনিয়োগ প্রায় ৩১ দশমিক ১০ বিলিয়ন রুপি। দেশ ছাড়িয়ে ইসরায়েলের হাইফা বন্দরেও আদানি গ্রুপের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সিমেন্ট বাণিজ্যে আদানির বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১০ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গোটা দুনিয়ায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ বিনিয়োগকারী এই আদানি গ্রুপ।

নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক লক্ষ্যকে গৌতম আদানি যেভাবে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়েছেন, তারই প্রতিদান মোদি সরকার দিচ্ছে। সূত্র: দ্য ওয়্যার

ভারতসহ আশেপাশের রাষ্ট্রগুলোতেও আদানি পরিবারের প্রভাব রীতিমত লক্ষণীয়। এই প্রভাব বহুক্ষেত্রেই নিছক ব্যবসায়ী প্রতিভার জোরে আসেনি, বরং বহুক্ষেত্রেই এসেছে রাজনৈতিক সম্পর্ক ও প্রভাবের সূত্রে। নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক লক্ষ্যগুলোকে গৌতম আদানি যে ভাবে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়েছেন, তারই প্রতিদানে নরেন্দ্র মোদি সরকারও তার সর্বোচ্চ সামর্থ্য অনুযায়ী গৌতম আদানীকে একচেটিয়া ব্যবসা বিস্তারের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। তার জন্য ভারত রাষ্ট্রের আইন লঙ্ঘন ঘটনা যেমন আছে, তেমনি আছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ওপর চাপ প্রয়োগও। বাংলাদেশ ভারত-সম্পর্ক বিষয়ে বাংলাদেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নানান সময়ে যেভাবে ‘স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্ক বলে জানিয়েছেন, সরকার টিকিয়ে রাখার বিষয়ে ভারতের অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, তারই পরিণামে বাংলাদেশে আদানি পরিবারের ভূমিকা ও তৎপরতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না।

বাংলাদেশে আদানি গ্রুপের ব্যবসা সম্প্রসারণ ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিষয়ক প্রসঙ্গে বেলজিয়ামের ফ্রাই ইউনিভার্সিটির পোস্ট ডক্টোরাল গ্রাজুয়েট ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক সাইমুম পারভেজ সম্প্রতি দৃকনিউজ-এ এক লেখায় উল্লেখ করেছেন,

“এই বিনিয়োগের শর্ত অনুযায়ি, শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে বাংলাদেশ আদানির মালিকানাধীন কোম্পানি “গোড্ডা” কে দিবে ১১.০১ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে তিনটি পদ্মা সেতু, নয়টি কর্ণফুলি নদীর টানেল, এবং চারটি মেট্রোরেল প্রজেক্ট বানানো যায়। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ টিম বাকলে ও সাইমন নিকোলাস এর গবেষণা অনুযায়ী, আদানি গাড্ডার সাথে বাংলাদেশের এই চুক্তি ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল।”

বাংলাদেশে আদানি গ্রুপের ব্যবসা সম্প্রসারণ আমাদের অর্থনীতিতে কী প্রভাব রাখবে, তা নির্ভর করবে বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদি সামনের বছরের ভারতের সাধারণ নির্বাচনে কেমন করবেন, তার ওপর যেমন, তেমনি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একই রকম অধিনস্ততার ভেতর দিয়েই যেতে থাকবে কি না, সেটারও ওপরও। বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে আদানি পরিবারের ভূমিকা কেমন হতে পারে, সেটা অতীতের পর্যালোচনায় খানিকটা বোঝা যায়। অন্যদিকে এটাও সত্যি যে, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার সুযোগে অন্যায় সুবিধা ও আইনভঙ্গ করা, ক্ষতিকর প্রকল্প চাপিয়ে দেওয়া কিংবা বেপরোয়া কার্যকলাপ চালানো বহু প্রতিষ্ঠানই অতীতে ভরাডুবির শিকার হয়েছে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণেই।

হাসান শাওন

লেখক ও সাংবাদিক

Exit mobile version