Prothom Alo | শশী থারুর
টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেটে পাকিস্তান ভারতকে হারিয়ে দেওয়ার পর ভারতীয় দলের বোলার মোহাম্মদ শামি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভয়ানকভাবে ঘৃণাসূচক প্রচারণা বা ট্রলের শিকার হন। নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) শাসনামলে কীভাবে সমাজে ইসলামবিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে, তার সর্বশেষ উদাহরণ এটি। ওই ম্যাচে মোহাম্মদ শামির পারফরম্যান্স ভালো ছিল না। কিন্তু দলের বাকি ১০ জনও পাকিস্তান দলের হাতে নাস্তানাবুদ হয়েছেন। কিন্তু শামিকেই আলাদা করে গালি দেওয়া হয়েছে, কারণ তিনি একজন মুসলমান। বিপক্ষের দলের খেলোয়াড়েরা যেহেতু মুসলমান এবং মোহাম্মদ শামিও যেহেতু একজন মুসলমান, সেহেতু তাঁর এ হেরে যাওয়ার মধ্যে ট্রল করা লোকেরা বিপক্ষের প্রতি শামির পক্ষপাতের গন্ধ খুঁজে পেয়েছেন।
ভারতে সম্প্রতি যেসব ইসলামভীতি ছড়ানো কর্মকাণ্ড ঘটে চলেছে, তার তুলনায় অবশ্য মোহাম্মদ শামির এ ঘটনা খুবই মামুলি। আসামের দারাং জেলায় বিজেপি রাজ্য সরকার মুসলমানদের ভিটেবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা শুরু করেছে। রাজ্য সরকার বলছে, এই মুসলমানরা সরকারি জায়গায় ‘অবৈধভাবে বসতি গেড়েছে।’ উচ্ছেদের সময় এক গ্রামবাসীকে ক্যামেরার সামনেই পুলিশ সদস্যরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছেন। ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, এই গ্রামবাসীকে মেরে ফেলার পর একজন ফটোসাংবাদিক তাঁর প্রাণহীন দেহের ওপর লাফিয়ে পড়ে লাথি মারছেন।
এ হত্যার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে উগ্রবাদীরা আরও হামলার জন্য উৎসাহিত হচ্ছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দিল্লির বিভিন্ন এলাকায় দাঙ্গা হয়েছে। এতে কমপক্ষে ৫৩ জন নিহত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে অল্প কয়েকজন বাদে প্রায় সবাই মুসলমান নাগরিক। মুসলমান নাগরিকদের গণপিটুনি দেওয়ার ঘটনাও নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে গরুর মাংস খাওয়ার ‘অপরাধে’ প্রায়ই মুসলমানদের ওপর চড়াও হওয়ার খবর পাওয়া যায়। বেশির ভাগ রাজ্যে গরুর মাংস খাওয়াকে নিষিদ্ধ করে আইন করা হয়েছে এবং পুলিশ ও স্বপ্রণোদিত উন্মত্ত জনতা বিচারবুদ্ধি ছাড়াই সেই আইন ‘প্রয়োগ’ করার বিষয়ে অতিরিক্ত আগ্রহ দেখাচ্ছে। এই ‘গো-রক্ষকেরা’ মুসলমানদের পেটানো এবং মুসলমানদের ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিতে বাধ্য করায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। এ ধরনের ঘৃণা ছড়ানো অপরাধ সংঘটিত হলেও কেউ কোনো সাজা পাচ্ছে না।
অন্যদিকে, পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের জয়ে ‘উল্লাস’ করায় মুসলমান ছাত্রদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও দেশদ্রোহের আইনে মামলা দেওয়া হচ্ছে। মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর শহরের একটি কলেজে নবরাত্রিতে আয়োজিত নাচের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য চারজন মুসলমান ছাত্রকে আটক করা হয়েছে। সেখানকার বিজেপি–সমর্থিত বজরং দল মনে করে, ওই অনুষ্ঠানে মুসলমানদের যোগ দেওয়ার কোনো অধিকার নেই। সিদ্দিক কাপ্পান নামের এক মুসলিম সাংবাদিক এক বছর ধরে জেলে রয়েছেন। জামিয়া মিলিয়া ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের নির্যাতনের খবর দেওয়ায় সিদ্দিকী কাপ্পানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ, সন্ত্রাস ও হিন্দুবিরোধিতায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।
উত্তর ভারতে ইসলামভীতি ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে গেছে। দক্ষিণ ভারতে অবশ্য তা এখনো ততটা নয়। হতাশার কথা হলো, ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলো এ পরিস্থিতিতে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। অনেক সংবাদমাধ্যম এ ঘৃণা ছড়াতে সরকারকে সহায়তাও করছে। বিজেপি শাসনাধীন ভারতে ‘আমরা’ এবং ‘তারা’—এ দুই ভাগে সমাজ ভাগ হয়ে যাচ্ছে এবং সেটি দিনে দিনে স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে।
এ ধরনের ঘটনায় জ্যেষ্ঠ নেতারা কোনো রকম বিব্রত বোধ তো করছেনই না, উল্টো তাঁরা প্রকাশ্যে আরও উসকানি দিয়ে যাচ্ছেন। মোদি একবার বলেছিলেন, পোশাক দেখে সরকারবিরোধীদের চিহ্নিত করা হবে। অর্থাৎ মুসলমানরা ঐতিহ্য হিসেবে যে পোশাক পরে থাকেন, তা দেখেই বিক্ষোভকর্মীদের চিহ্নিত করা হবে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া মুসলমান অভিবাসীদের ‘উইপোকা’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘আমরা একটা একটা করে অনুপ্রবেশকারীদের ধরব এবং তাদের বঙ্গোপসাগরে ছুড়ে ফেলে দেব।’
এই বিজেপির শাসনামলে আন্তধর্মীয় বিয়ের বিরুদ্ধেও জোর প্রচারণা চালানো হচ্ছে। কোনো মুসলমান পুরুষ কোনো হিন্দু নারীকে বিয়ে করলে সেটিকে বিজেপির পক্ষ থেকে ‘লাভ জিহাদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে মুসলমানরা হিন্দু নারীদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে মুসলমান বানানোর তালে রয়েছে (যদিও আমাদের সংবিধানে এ ধরনের আন্তধর্মীয় বিয়ে সম্পূর্ণ বৈধ)। তাবলিগ জামাতের মুসল্লিদের জমায়েতকে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার জন্য দায়ী করা হলেও তার চেয়ে হাজার গুণ লোকসমাগমে কুম্ভ মেলা অনুষ্ঠান শুধু করতে দেওয়া হয়েছে তা–ই নয়, সেই মেলায় যোগ দিতে সরকারের দিক থেকে রীতিমতো উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
এই বিজেপি সরকার এমন একটি আইন করেছে, যার আওতায় প্রতিবেশী দেশ থেকে ভারতে আসা অমুসলমানদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। পরিবার পরিকল্পনাবিষয়ক প্রচারে বারবার বলা হচ্ছে, মুসলমান নাগরিকদের বেশি সন্তান গ্রহণের প্রবণতা রয়েছে। এটি নাকি ভারতের ‘জনসংখ্যার ভারসাম্য’ নষ্ট করছে। ভারতের সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতার বহিরাবরণ যে কতটা পাতলা তা খোলাসা হয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমার মতো উদারপন্থীদের হতাশ করেছে। বহু দশক ধরে ভারত যে সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ এবং হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির সমাজ গড়ে তুলেছিল, তা বিজেপির মাত্র সাত বছরের শাসনে ধ্বংস হয়ে গেছে।
একটা সময় ছিল যখন বড় বড় পদে থাকা মুসলমানদের দেখিয়ে সরকারি কর্মকর্তারা ভারতের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা প্রমাণ করতেন এবং পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরও ভারতীয়রা ধর্মীয় সম্প্রতি ধরে রেখেছেন বলে তাঁরা গৌরব করতেন। আজ পুলিশ বাহিনী ও কেন্দ্রীয় এলিট বাহিনীতে মুসলমানদের অবস্থান নাটকীয়ভাবে অবনমিত হয়েছে। জেলখানাগুলোতে মুসলমান কয়েদির সংখ্যাও নাটকীয়ভাবে অনেক বেড়ে গেছে।
উত্তর ভারতে ইসলামভীতি ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে গেছে। দক্ষিণ ভারতে অবশ্য তা এখনো ততটা নয়। হতাশার কথা হলো, ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলো এ পরিস্থিতিতে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। অনেক সংবাদমাধ্যম এ ঘৃণা ছড়াতে সরকারকে সহায়তাও করছে। বিজেপি শাসনাধীন ভারতে ‘আমরা’ এবং ‘তারা’—এ দুই ভাগে সমাজ ভাগ হয়ে যাচ্ছে এবং সেটি দিনে দিনে স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। যখন-তখন মুসলমানদের বলা হচ্ছে ‘পাকিস্তানে চলে যাও।’ আমার মতো যাঁরা উদারপন্থী আছেন, তাঁরা এর প্রতিবাদ করলেই আমাদের গায়ে ‘জাতীয়তাবাদবিরোধী’ তকমা এঁটে দেওয়া হচ্ছে।
২০১৫ সালে আমি পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, ‘বিজেপিশাসিত ভারতে একটা গরু একজন মুসলমানের চেয়ে সুরক্ষিত।’ দুঃখের বিষয়, আমার সেই কথা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
● শশী থারুর জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী