Site icon The Bangladesh Chronicle

মোদির এক মন্তব্যে ভারতের রাজনীতিতে তোলপাড়

‘ব্যক্তিগতভাবে চড়া মূল্য চোকাতে হতে পারে’—প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এই এক মন্তব্যেই ভারতের রাজনীতিতে জল্পনার ঝড় উঠেছে। কৃষক, পশুপালক ও মৎস্যজীবীদের স্বার্থরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিতে গিয়ে তার এই ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য এমন এক সময়ে এলো, যখন ভেতর ও বাইরের প্রবল চাপে তার ১১ বছরের শাসনামলে সবচেয়ে বড় সংকটের মুখোমুখি হওয়ার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। একদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চাপানো বিপুল বাণিজ্য শুল্ক, অন্যদিকে দলের আদর্শিক নিয়ন্ত্রক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) অসন্তোষ—এই দুইয়ের যাঁতাকলে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ জুটির বজ্রমুঠি কি আলগা হচ্ছে?

নরেন্দ্র মোদি

প্রধানমন্ত্রীর এই অস্বস্তির পেছনে সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আরএসএস। সংঘ এখন আর মোদি-শাহ জুটিকে বিজেপির ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ দিতে রাজি নয়। এর স্পষ্ট প্রমাণ মেলে দলের সর্বভারতীয় সভাপতি নির্বাচন নিয়ে চলতে থাকা টানাপোড়েনে। জে পি নাড্ডার মেয়াদ বারবার বাড়ানো হলেও সংঘ ও মোদি শিবিরের মতের অমিলের কারণে আজও চূড়ান্ত সভাপতি নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মোদির নিজের তৈরি করা ‘৭৫ বছর বয়সসীমার’ নিয়ম। ২০১৪ সালে যে নিয়ম দেখিয়ে তিনি লালকৃষ্ণ আদভানি, মুরলী মনোহর যোশির মতো বর্ষীয়ান নেতাদের দলের ‘মার্গদর্শক’ করেছিলেন, সেই নিয়ম এখন তার নিজের জন্যই খাঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর ৭৫ বছরে পা দেবেন মোদি, আর তার মাত্র ছয় দিন আগে ৭৫ পূর্ণ হবে সংঘচালক মোহন ভাগবতের। ভাগবত ইতিমধ্যেই ‘শাল উপহার পাওয়া মানে সরে যাওয়ার সময়’ বলে মোদির ওপর চাপ বাড়িয়েছেন।

ভেতরের এই চাপের পাশাপাশি বাইরে থেকে সংকট তীব্রতর করেছেন ‘বন্ধু’ ডোনাল্ড ট্রাম্প। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে বাণিজ্য যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করেছেন। ভারতের কৃষিক্ষেত্রে বাজার পাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে চাপ দিয়ে আসা যুক্তরাষ্ট্রকে বাড়তি সুবিধা না দেওয়ার কথা জানিয়েই মোদি ‘চড়া মূল্য’ দেওয়ার মন্তব্যটি করেন। এছাড়া, সাম্প্রতিক একটি যুদ্ধ বন্ধে নিজের ভূমিকার কথা বারবার বলে ট্রাম্প ঘরোয়া রাজনীতিতেও মোদিকে বিড়ম্বনায় ফেলছেন, যা ভারতের দীর্ঘদিনের ‘তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা না মানা’ নীতির পরিপন্থী।

এই দ্বিমুখী চাপের সুযোগে ক্রমেই শক্তি সঞ্চয় করছে বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোট। বিহারে নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকা সংশোধনকে (এসআইআর) ‘ভোট চুরির’ চক্রান্ত আখ্যা দিয়ে একজোট হয়েছে বিরোধীরা। রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে কর্ণাটকের মহাদেবপুরা আসনের লক্ষাধিক ভুয়া ভোটারের তথ্য প্রকাশ এবং পরবর্তীতে একটি সর্বভারতীয় নিউজ চ্যানেলে তার সপক্ষে প্রতিবেদন প্রচারিত হওয়ায় মোদি সরকারের অস্বস্তি আরও বেড়েছে। এই অভিযোগের জের ধরেই বিরোধী জোটের নেতারা নির্বাচন কমিশনে যাওয়ার পাশাপাশি আগামী ১ সেপ্টেম্বর বিহারের পাটনায় এক বিশাল সমাবেশের ডাক দিয়েছেন।

ক্ষমতার ভিত নড়ে গেলে তার প্রতিফলন বিভিন্ন দিকে দেখা যায়। সম্প্রতি মোদির আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়ের অপ্রত্যাশিত পদত্যাগ এবং আরেক জাট নেতা ও সাবেক রাজ্যপাল সত্যপাল মালিকের মৃত্যুর পর বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের নীরবতা জাট সমাজে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এই নিয়ে প্রশ্ন তোলায় রাজস্থানের বিজেপি মুখপাত্র কৃষ্ণকুমার জানুকে ছয় বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। এর পরপরই নাগাল্যান্ড থেকে দলের আরেক জাতীয় মুখপাত্র মোহনলুমো কিকন পদত্যাগ করেন। এই সমস্ত ঘটনা বিজেপির অভ্যন্তরীণ ফাটলকেই প্রকাশ্যে আনছে।

আগামী দিনে বিহারের নির্বাচন, মোদির ৭৫ বছর বয়স এবং ট্রাম্পের শুল্কনীতির পরিণতিই ঠিক করে দেবে ভারতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোন দিকে মোড় নেবে। তবে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক মন্তব্য এবং পারিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহ অন্তত এটুকু স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, তিনি একেবারেই স্বস্তিতে নেই।

Exit mobile version