Site icon The Bangladesh Chronicle

মোদির অধীনে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ভবিষ্যৎ

মোদির অধীনে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ভবিষ্যৎ 

রামচন্দ্র গুহ

এই বসন্তে ভারতের ১৮তম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। জরিপে উঠে এসেছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা বেশ প্রবল। এই বিজয় একক নেতা হিসেবে মোদির গুরুত্বকে আরও উজ্জ্বল করে তুলবে। তবে তাঁর কর্তৃত্ব চর্চার বিশেষ ধরন, বৈচিত্র্যময় ও জটিল একটি দেশের ওপর তাঁর ও তাঁর দলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বেপরোয়া চেষ্টা ভারতের পরাশক্তি হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে হুমকির মুখে ফেলছে।

বিপুল জনমোহিনী ক্ষমতার অধিকারী মোদি এসেছেন একেবারে সাদামাটা প্রেক্ষাপট থেকে। তবে ভারতের রাজনীতির ওপর তাঁর যে নিয়ন্ত্রণ, সেটি দেশটির এর আগের ১৫ জন প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে মাত্র দু’জন প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। একজন জওহরলাল নেহরু, যিনি ১৯৪৭ থেকে ’৬৪ সাল অবধি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন; আরেকজন তাঁরই কন্যা ইন্দিরা গান্ধী, যিনি প্রথমবার ১৯৬৬-৭৭ এবং পরে ১৯৮০-৮৪ মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। নেহরু ও ইন্দিরা দু’জনই ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা। দলটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করেছিল এবং স্বাধীনতার পর তিন দশক ক্ষমতায় ছিল।

অন্যদিকে মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টি, বর্তমানে যাকে দেশটির বিকল্পহীন শাসক দল বলে মনে হচ্ছে– বহু বছর বিরোধী দলে ছিল। কংগ্রেস ও বিজেপির মতাদর্শের মধ্যকার প্রধান পার্থক্য হলো ধর্মীয় বিশ্বাস ও রাষ্ট্রের প্রতি দল দুটির ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। বিশেষত নেহরুর আমলে কংগ্রেস ভারতের সংবিধান অনুযায়ী নাগরিকদের চিন্তা ও মতপ্রকাশ, সাধারণ বিশ্বাস, ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রার্থনা করার স্বাধীনতা পালনে বাধ্যবাধকতার সঙ্গে সমন্বয় রেখে ধর্মীয় বহুত্ববাদের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল।

অন্যদিকে বিজেপি ভারতকে এমন একটি সংখ্যাগুরুবাদী রাষ্ট্ররূপে গড়ে তুলতে চায়, যেখানে রাজনীতি, জননীতি, এমনকি দৈনন্দিন জীবন হিন্দু লব্জের ছাঁচে বেঁধে ফেলা যায়। মোদি বিস্ময়কর মাত্রায় তাঁর দপ্তরে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেছেন। এ ছাড়া তিনি বিচার বিভাগের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও মিডিয়ার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করেছেন; নিজের ব্যক্তিত্ব ঘিরে একটি ‘কাল্ট’ তৈরি করেছেন এবং সাংঘাতিক এক দক্ষতার মধ্য দিয়ে দলের মতাদর্শিক লক্ষ্য বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবে নড়বড়ে করে দেওয়ার পরও মোদি কিন্তু এখনও বেশ জনপ্রিয়। তিনি অবিশ্বাস্য রকম পরিশ্রমী ও রাজনৈতিকভাবে চতুর। ভোটারদের মনোভাব বেশ ভালো বুঝতে পারেন এবং পরিস্থিতি বুঝে বুলি ছাড়েন ও কৌশল প্রয়োগ করেন। যদিও অর্থনীতির বিচারে ভালো-মন্দ দুটো দিকই রয়েছে তাঁর; অনেক দরিদ্র মানুষ তাঁর ওপর আস্থা রাখে। বিশেষত সর্বোচ্চ ভর্তুকি দিয়ে খাদ্য ও রান্নার জ্বালানি গ্যাস সরবরাহ করে তাঁকে মোদির ব্যক্তিগত উপহার বলে চালিয়ে দিয়ে তিনি এই বিশ্বাস অর্জন করেছেন। তবে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ভবিষ্যৎ মোদি ও তাঁর মতাদর্শীদের দাবির চেয়ে অনেক ম্লান বলে মনে হয়। তাঁর সরকার ধর্মীয় ও আঞ্চলিক সংঘাত কমায়নি, বরং তা বাড়ানোর জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করে গেছে। এতে ভবিষ্যতে দেশটির সামাজিক বুনন আরও বিনষ্ট হবে।

মোদি সরকার গণতান্ত্রিকভাবে ভিন্নমত পোষণের পরিসর সংকীর্ণ করতে সুকৌশলে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ওয়ার্ল্ড প্রেস ইনডেক্সের জরিপ অনুসারে, সাংবাদিকতার স্বাধীনতার দিক থেকে বর্তমানে ভারত ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬১তম। আরেকটি কম আলোচিত মৌলিক চ্যালেঞ্জ হলো, ভারতের ফেডারেল কাঠামোর ক্ষয়। ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোদি সরকার সুচতুরভাবে অবিজেপি-শাসিত প্রাদেশিক সরকারের স্বায়ত্তশাসনকে ক্ষুণ্ন করে চলেছে।

মোদির অধীনে বিজেপি বিভিন্ন জাতপাত ও মতপার্থক্য এড়িয়ে হিন্দু ধর্মের বহুত্ববাদকে হীনবল করার জন্য কাজ করছে। তারা এমন এক ‘হিন্দু রাজ্য’ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়, যেখানে হিন্দুদের অবস্থান হবে সবার ওপরে। সংসদের দুটি কক্ষে বিজেপি ৩৯৭টি আসন পেয়েছে, যেগুলোর একটিতেও কোনো মুসলমান সদস্য নেই। মোদি নিজেও গত সংসদ নির্বাচনে বারাণসী থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন, যা মন্দিরে ভরপুর প্রাচীন একটি শহর। সাধারণত এটি হিন্দুত্ববাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত।

কেউ কেউ পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক নেতাদের কাছ থেকে মোদির কর্তৃত্ববাদী শাসনের সমালোচনা আশা করেছিলেন। কিন্তু সেটা হয়নি। এর পেছনে কিছুটা পাশ্চাত্যের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জকারী চীনা নেতা শি জিন পিংয়ের উত্থান দায়ী হতে পারে। তিনি পরাশক্তি হিসেবে চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের সমঅবস্থানে দেখতে চান, যা মোদির জন্য সুবিধা নিয়ে এসেছে। হোয়াইট হাউসে নিজের ও ভারতের গুরুত্ব তুলে ধরতে সম্পদশালী অসংখ্য ভারতীয় প্রবাসীকে কাজে লাগিয়ে মোদি মার্কিন এস্টাব্‌লিশমেন্টের সঙ্গে দারুণভাবে খেলেছেন। ট্রাম্প ও বাইডেন উভয়েই মোদির প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহ দেখিয়েছেন।

মোদি ও তাঁর দল ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যে হাল করেছেন, দেশটির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এ জন্য ভয়াবহ মাশুল দিতে হবে। যদি মে মাসের নির্বাচনে বিজেপি তৃতীয়বারের মতো জয়ী হয়, তাহলে মোদির অধীনে হামাগুড়ি দেওয়া সংখ্যাগুরুবাদ এক দানবে পরিণত হতে পারে। এই ধারা ভারতীয় জাতিসত্তার জন্য একটি মৌলিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

ভারতের অভ্যন্তরে তো বটেই, গোটা বিশ্বের সামনে– একমাত্র দল বিজেপি, তার একক নেতা প্রধানমন্ত্রী মোদিকেই দেশটির একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। আসন্ন নির্বাচন তাঁর এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভাবমূর্তিকে আরও পোক্ত করবে। তিনিই ভারতের মুক্তিদাতা– এমন বার্তাও তুলে ধরবে। তবে এই বিজয়োল্লাস দেশটির গভীরে থাকা বিচ্যুতি রেখা মুছে দেবে না; বরং স্বীকৃতি ও প্রতিকারহীন থাকলে তা সামনের দিনগুলোতে আরও বিস্তৃত হবে।

samakal

Exit mobile version