Site icon The Bangladesh Chronicle

মেজর ডালিমের সাক্ষাৎকার এবং আওয়ামী শাসনের প্রতিচ্ছবি

ড. মুহাম্মাদ সাইদুল ইসলাম

সাংবাদিক ইলিয়াস গত ৫ জানুয়ারি মেজর ডালিমের সাক্ষাৎকার নেন, যেখানে সরাসরি সংযুক্ত ছিলেন প্রায় আট লাখ দর্শক। মাত্র তিন দিনের মাথায় ইউটিউবে এই দর্শকের সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যায়। বাংলা ভাষায় ইউটিউবের ইতিহাসে এটা একটা রেকর্ড। মেজর ডালিমের লেখা বই ‘আমি মেজর ডালিম বলছি’ (যা শেখ হাসিনার আমলে নিষিদ্ধ ছিল) এবং এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকার বাংলাদেশের ইতিহাসকে নতুন করে আবিষ্কার করার ক্ষেত্র ও সুযোগ তৈরি করবে নিঃসন্দেহে। আমি এখানে কয়েকটা চুম্বক পয়েন্ট ও তার রিফ্লেকশন তুলে ধরছি।

১. আওয়ামী লীগ একদম শুরু থেকেই ইন্ডিয়ান এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছে এবং এখনো করছে।

২. মুক্তিযুদ্ধ ছিল ভারতের পাতানো ফাঁদ। এই ফাঁদে পা দিয়ে মুজিব ও আওয়ামী লীগ একটা স্বাধীন দেশকে দুই টুকরো করেছে এবং ভারতের দাসত্ব ও পদলেহনকে পুরো জাতির ঘাড়ে চাপিয়েছে।

৩. চুরিতন্ত্র ছিল আওয়ামী রাজনীতির মূল ভিত্তি। গাজী গোলাম মোস্তফার মতো একজন প্রকাশ্য চোরকে বানানো হয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতা এবং রেডক্রসের প্রেসিডেন্ট। আর এসব চোরকে বাঁচাতে মুজিব বিসর্জন দিয়েছে সব ধরনের নীতি-নৈতিকতা। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের কাছে দেশ থেকে দল বড়, দলের চেয়ে নেতা বড়। দেশ পরিচালনায় যখনই সততা, ইন্টিগ্রিটি, প্রেফেশনালিজম বনাম চুরিতন্ত্র ও দলতন্ত্রের প্রশ্ন এসে দাঁড়িয়েছে, শেখ মুজিব চুরিতন্ত্র এবং দলতন্ত্রকেই গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠা করেছেন।

৪. শেখ মুজিবের ক্ষমতার লোভ, আর ব্যক্তিপূজা এতটাই গভীর অন্ধকারে রেখেছিল যে, ইন্ডিয়ান হেজেমনির ভয়াল ফাঁদ তার মাথায় ঢুকত না।

৫. তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির গোপন সাত দফা চুক্তি হয়, যা ভারত আর মুজিবনগর সরকারের চুক্তি নামে পরিচিত। চুক্তির সময়কাল ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাস, যাতে ছিল:

(ক) প্রশাসনিক বিষয়: যারা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, শুধু তারাই প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নিয়োজিত থাকতে পারবেন। যারা বাকি তাদের শূন্য জায়গা পূরণ করবেন ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা।

(খ) সামরিক বিষয়: বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে অবস্থান করবে। ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাস থেকে আরম্ভ করে প্রতিবছর এ সম্পর্কে পুনঃনিরীক্ষণের জন্য দুদেশের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

(গ) বাংলাদেশের নিজস্ব সেনাবাহিনীর বিষয়: বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না। অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মুক্তিবাহিনীকে কেন্দ্র করে একটি প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা হবে।

(ঘ) ভারত-পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধের বিষয়: সম্ভাব্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অধিনায়কত্ব দেবেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান এবং যুদ্ধকালে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়কত্বে থাকবে।

(ঙ) বাণিজ্যের বিষয়: খোলাবাজারের ভিত্তিতে (open market) চলবে দুদেশের বাণিজ্য। তবে বাণিজ্যে প্রমাণের হিসাবনিকাশ হবে বছরওয়ারি এবং যার যা প্রাপ্য সেটা স্টার্লিংয়ে পরিশোধ করা হবে।

(চ) পররাষ্ট্রের বিষয়: বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রশ্নে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে এবং যতদূর পারে ভারত বাংলাদেশকে সহায়তা দেবে।

(ছ) প্রতিরক্ষার বিষয়: বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার বিষয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করবে ভারত।

‘স্বাধীনতার’ পর প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ভারতের হাতে থাকায় বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্য আসতে সমস্যা হচ্ছিল। এজন্য ভারতের পরমর্শে ভারতীয় সৈন্যের বিকল্প হিসেবে রক্ষীবাহিনী নামে প্যারামিলিটারি ফোর্স তৈরির প্রস্তাবনা আসে। যাহোক, এই সাত চুক্তি স্বল্প পরিমার্জিত রূপে ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চে ঢাকায় ইন্দিরা গান্ধী সফরে এলে শেখ মুজিবের সঙ্গে ২৫ বছরের ‘বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও শান্তিচুক্তি’তে রূপান্তরিত হয়, গড়ে তোলা হয় প্যারামিলিটারি রক্ষীবাহিনী। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ২০ মাইলের মধ্যে অবস্থিত এলাকায় অবাধ বাণিজ্যের লক্ষ্যে শেখ মুজিব ভারতের সঙ্গে ‘সীমান্ত অবাধ বাণিজ্য চুক্তি’ স্বাক্ষর করেন ১৯৭২ সালের ২৭ মার্চ। জাতীয় অর্থনীতিতে এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

তাজউদ্দীনের এই সাত দফা চুক্তির পরেই ভারত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সরাসরি যুদ্ধ করার জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ফেলে। অথচ বাংলাদেশের মানুষের কাছে এটা পরিচিতি পায় ‘স্বাধীনতার যুদ্ধ’ হিসেবে! তাজউদ্দীন সাহেব এই চুক্তি করে ভারতকে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে নামাতে পেরেছেন, দেশ পাকিস্তানমুক্ত হয়েছে। কিন্তু তিনি একই সঙ্গে দেশের স্বাধীনতাকে ভারতের হাতে তুলে দিয়ে ভারতের দাসখতে সই করে দিয়েছিলেন। আর সেই ভারতীয় আধিপত্য ও দাসত্বের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন শেখ মুজিব নিজেই।

৬. পূর্ব পাকিস্তানকে ‘স্বাধীন’ করার পর বাংলাদেশ হয়ে পড়ে ইন্ডিয়ার লুটপাটের কেন্দ্রস্থল। মেজর ডালিমের মতে, ভারত ওই সময় বাংলাদেশ থেকে পাচার করে ১৬ হাজার কোটি টাকার সম্পদ, যা বর্তমান হিসাবে কয়েক ট্রিলিয়ন টাকা হবে। ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল এই সম্পদ পাচারে বাধা দিলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসব নিয়ে সোচ্চার হওয়ার কারণে সিরাজ সিকদারকে হত্যা করা হয়, আর চলচ্চিত্র বানানোর কারণে গুম করা হয় জহির রায়হানকে। বাংলাদেশে গুমের ইতিহাস সম্ভবত এখান থেকেই শুরু।

৭. মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ মারা যায়নি। বিবিসি বাংলার সাংবাদিক সিরাজুর রহমানকে মুজিব ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জিজ্ঞেস করলে তিনি তিন লাখের কথা বলেন। ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মুজিব তিন লাখকে তিন মিলয়ন বলে ফেলেছিলেন। সেখান থেকেই ৩০ লাখ সংখ্যাটি এসেছে। ইংরেজিতে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে মুজিব লেজেগোবরে মাখিয়ে ইংরেজি ভাষার পুরো বারোটা বাজিয়েছিলেন বলে ডেভিড ফ্রস্ট কেঁদে ফেলেছিলেন। মেজর ডালিমের মতে, লাখ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিষয়টিও অতিরঞ্জিত। হাতেগোনা কয়েকজনের ক্ষেত্রে ঘটেছিল এবং তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল।

৮. বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ইন্ডিয়া। বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।

৯. হাসিনার নৃশংসতা তার বাবার চেয়ে ছিল হাজার গুণ বেশি। ভয়ানক একনায়কতন্ত্রের ভিত্তি রচনা করেছিলেন মুজিব, আর সেটাকে ফুলে-ফলে সুশোভিত করে চরম নৃশংসতার ইতিহাস গড়েছেন তার কন্যা শেখ হাসিনা।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে—তাহলে মুক্তিযুদ্ধ কি সত্য সত্যিই ‘শেয়ালের (পাকিস্তানের) হাত থেকে মুক্ত হয়ে বাঘের (ইন্ডিয়া) হাতে নিজেদের সোপর্দ করা?’ আজ এজন্যই কি চব্বিশের বিপ্লব অনিবার্য ছিল?

শেখ মুজিব ইন্ডিয়াকে লুটপাট করতে দিয়েছেন ১৬ হাজার কোটি টাকা এবং ১৯৭২-৭৫ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নিজেই ব্যাংক ডাকাতিসহ লুটপাট করেছে আরও প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা।

শেখ হাসিনার আমলে এই লুটপাট সব রকম সীমা ছাড়িয়ে যায়। ২৪টি ব্যাংকিং কেলেঙ্কারির মাধ্যমে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। খেলাপি ঋণ আটগুণ বেড়ে এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা হয়েছে। দেশের আর্থিক ব্যবস্থা থেকে প্রায় ১৭ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার চুরি করা হয়েছে। হাসিনার বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানসহ ৬০ জনের দ্বারা শেয়ারবাজার কারসাজির মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে এক লাখ কোটি টাকা লুট করা হয়েছে! জ্বালানির নামে রাশিয়া ও জাপান থেকে ১৯ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার নেওয়া হয়েছে! এগুলো পরিশোধ করতে এবং সেইসঙ্গে আদানি চুক্তিসহ ক্যাপাসিটি চার্জের জন্য বিশাল ব্যয়ের কারণে বিদ্যুতের দাম ১৪ গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প থেকে হাসিনা, জয়, টিউলিপসহ হাসিনা পরিবার প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। হাসিনা আমলে কর এড়াতে এবং দেশের বাইরে অর্থ পাচারের জন্য ব্যবসায়ীদের পণ্যের মূল্য ভুল ইনভয়েস করার চর্চা ছিল যত্রতত্র। এই দুর্নীতি ও অর্থপাচারের কারণে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৮ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার হারায়। গত ১৫ বছরের হিসাব করলে এভাবে অর্থপাচারের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২৪ বিলিয়ন ডলার! ২০০৯ সালে হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের সময় বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ছিল মাত্র ২৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। হাসিনা আমলে এই ঋণ চারগুণ বেড়ে ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরে বাংলাদেশ যত টাকা বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে, তার ৭৬ ভাগই হাসিনা নিয়েছে তার ১৫ বছরের শাসনামলে!

সব মিলে মুক্তিযুদ্ধ, আওয়ামী লীগ ও সর্বোপরি বাংলাদেশের ইতিহাসকে ‘চেতনার’ মুখোশ উন্মোচন করে নতুন করে পাঠ করার সুযোগ এসেছে। চব্বিশের বিপ্লবই এই সুযোগটা করে দিয়েছে।

লেখক: অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর,নানয়াং টেকনোলোজিক্যাল ইউনিবার্সিটি সিঙ্গাপুর

amardesh

Exit mobile version