Site icon The Bangladesh Chronicle

মূল্যস্ফীতি বাড়ছেই, সরকারি পদক্ষেপ কাজে আসছে না

মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা যাচ্ছে না। সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার দুই অঙ্কের ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। যদিও খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘর আগেই পার করেছে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন সীমিত আয়ের মানুষেরা।

যদিও মূল্যস্ফীতি কমে আসবে বলে আশার কথা শোনানো হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে। কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমছে না।

দেশে বিগত ১৪ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে। গতকাল সোমবার সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির সর্বশেষ হিসাব প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যাচ্ছে, মে মাসে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ, যা এপ্রিলে ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের মে মাসে আপনি পণ্য কিনতে যদি ১০০ টাকা খরচ করেন, এ বছর মে মাসে একই পণ্য কিনতে ১০৯ টাকা ৮৯ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।

মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় স্বস্তিতে নেই মানুষ। গতকাল সোমবার কারওয়ান বাজারে কথা হয় ১৫তম ধাপে (গ্রেড) বেতন পাওয়া সরকারি কর্মচারী ফজলুল কাদেরের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে আর টাকার মান যেভাবে কমছে, টাকাকে মনে হয় তেজপাতা। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে প্রতি মাসেই আমার আয় কমছে।’

জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় আয় বেশি বাড়লে মানুষের তেমন সমস্যা হয় না। ২০২২ সালের মে মাসে মূল্যস্ফীতি জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে যায়। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির তুলনায় মানুষের আয় কম হারে বাড়ছে। বিবিএসের হিসাবে, গত এপ্রিলে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ। সেখানে মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ।

মূল্যস্ফীতির চাপে অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। কেউ ব্যাংকের স্থায়ী আমানত ভাঙছেন, কেউবা তুলে ফেলছেন মেয়াদ পূর্তির আগেই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা টাকা। রাজধানীর দিলু রোডের বাসিন্দা হাজেরা সুলতানা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সঞ্চয়পত্রে তাঁর পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ ছিল। মূল্যবৃদ্ধির কারণে তাঁর সংসারে টানাপোড়েন বেড়েছে। ফলে মেয়াদ পূর্তির আগেই সঞ্চয়পত্র ভাঙতে হয়েছে।

বেড়েছে খাদ্য মূল্যস্ফীতিও

বিবিএসের গতকাল প্রকাশিত হালনাগাদ হিসাব বলছে, মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ হয়েছে, যা আগের মাসে ছিল ১০ দশমিক ২২ শতাংশ। মে মাসে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি অবশ্য কিছুটা কমেছে। এপ্রিলের ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ থেকে কমে মে মাসে হয়েছে ৯ দশমিক ১৯ শতাংশ।

যদিও বিবিএস যে হিসাব দিচ্ছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি তার বেশি বলে মনে করা হয়। গত ১০ মে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা শীর্ষক বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেছিলেন, মাছ ও পোলট্রি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দরিদ্রদের ক্ষেত্রে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন ১৫ শতাংশে পৌঁছেছে। বিআইডিএসের জরিপের ভিত্তিতে তিনি এ কথা বলেন।

মূল্যস্ফীতি কমাতে পদক্ষেপ

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংকঋণের সুদের হার বৃদ্ধির কথা অর্থনীতিবিদ ও গবেষকেরা কয়েক বছর ধরে বলে আসছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংক আমলে নেয়নি। তবে চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করেছে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার কিছুটা বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সুদহার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। আমদানিও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। যদিও এসব পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না।

২০২৩ সালের ৭ নভেম্বর ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশ ও জুনের মধ্যে তা ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে।’

অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশায় থাকা শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতি কমিয়ে এনেছে। ২০২২ সালের অক্টোবরেও দেশটিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭০ শতাংশ। গত ফেব্রুয়ারিতে তা নেমে আসে ৫ দশমিক ৯ শতাংশে। ভারতও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। পারছে না বাংলাদেশ।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, হয়তো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সরকার গুরুতর সমস্যা হিসেবে দেখছে না। দেখলে এরই মধ্যে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে আরও কিছু যোগ হতো। শুধু মুদ্রানীতি দিয়েই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হবে না। দরকার রাজস্ব নীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনাসহ সমন্বিত উদ্যোগ। তা কিন্তু দেখা যাচ্ছে না।

সময়মতো পদক্ষেপ না নেওয়ার উদাহরণ দিয়ে সেলিম রায়হান বলেন, মূল্যস্ফীতি কম থাকার সময় ডলারের তুলনায় টাকার অবমূল্যায়ন না করে করা হয়েছে এমন সময়, যখন দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি আছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। ঢাকা ওয়াসা পানির বাড়িয়েছে। নতুন করে বাড়ানো হয়েছে তেলের দাম। সব মিলিয়ে মনে হয় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সমন্বয়হীনতাও কম দায়ী নয়।

prothom alo

Exit mobile version