Site icon The Bangladesh Chronicle

মুনাফায় দেশি ব্যাংক কেন পিছিয়ে

মুনাফায় দেশি ব্যাংক কেন পিছিয়ে 

বছর শেষে মুনাফার দিক থেকে দেশি বেসরকারি ও রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংগুলো বিদেশি ব্যাংকের চেয়ে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। এ দেশে গত ১০ বছরে বিদেশি ব্যাংকগুলোর মুনাফা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। এর বিপরীতে দেশি মালিকানাধীন বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মুনাফা বেড়েছে দেড় গুণ, আর রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের মুনাফা রীতিমতো ধস নেমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের শেষে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর কর–পরবর্তী সম্মিলিত মুনাফার পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা, যা ১০ বছর পরে ২০২২ সালের শেষে কমে হয়েছে ৪৯৫ কোটি টাকায়। ২০১৩ সালে দেশি মালিকানাধীন বেসরকারি ব্যাংকগুলো কর–পরবর্তী মোট মুনাফা করেছিল ৩ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা। গত বছর শেষে তা প্রায় দেড় গুণ বেড়ে ৬ হাজার ১৩৮ কোটি টাকায় ওঠে। অন্যদিকে গত ১০ বছরে বিদেশি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মুনাফা বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। ২০১৩ সালের শেষে বিদেশি ব্যাংকগুলোর কর–পরবর্তী সম্মিলিত মুনাফা ছিল ১ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা, যা ২০২২ সালে এসে দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ৩ হাজার ১৫৭ কোটি টাকায় উন্নীত হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশে ৯টি বিদেশি ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক আছে ৬টি আর বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা ৪৩। এর বাইরে বিশেষায়িত ব্যাংক রয়েছে ৩টি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও বেসরকারি খাতের দেশীয় ব্যাংকগুলোর মুনাফা অর্জনে পিছিয়ে পড়ার বড় কারণ হলো অনিয়ম–দুর্নীতি। এসব ব্যাংকে গত ১০–১৫ বছরে বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারি বা অর্থ তছরুপের ঘটনা ঘটেছে। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের ঋণের বিপরীতে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশনিং বাবদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষণ করতে হয়। যখন কোনো ঋণ পুরোপুরি খেলাপি হয়ে পড়ে, তার বিপরীতে শতভাগ অর্থ প্রভিশনিং করতে হয়। আর এই প্রভিশনিং করতে হয় বছর শেষে ব্যাংকের মুনাফা থেকে। এ কারণে প্রতিবছর দেশের রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অর্জিত মুনাফার একটি বড় অংশ প্রভিশনিং ঘাটতি মেটাতেই চলে যায়। ফলে বছর শেষে ব্যাংকগুলো খুব বেশি মুনাফা করতে পারে না। সে তুলনায় বিদেশি ব্যাংকগুলোতে ঋণসংক্রান্ত অনিয়মের ঘটনা খুবই কম। ফলে এসব ব্যাংককে প্রভিশনিং বাবদ তেমন অর্থ সংরক্ষণ করতে হয় না।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদেশি ব্যাংকগুলোর সুশাসন, পরিচালনা পর্ষদ ও ঋণ দেওয়ার মানদণ্ড অনেক বেশি উন্নত। আবার ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে যাচাই–বাছাই প্রক্রিয়াও অনেক ভালো। এ কারণে বিদেশি ব্যাংকগুলো মুনাফার দিক থেকে দেশি ব্যাংকগুলোর চেয়ে এগিয়ে আছে। দেশের ব্যাংকগুলো (সরকারি–বেসরকারি) কুঋণের দুষ্টচক্রে আটকে গেছে। কয়েক বছর ধরে আমরা দেখেছি, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকেও অনিয়মের ঘটনা বাড়ছে। বছরের পর বছর কুঋণ আদায় করা যাচ্ছে না। আবার সামান্য কিছু অর্থ পরিশোধের মাধ্যমে এসব ঋণ পুনঃ তফসিলও করা হচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না।’

শুধু মুনাফায় নয়, ব্যয় নিয়ন্ত্রণেও বেশ এগিয়ে আছে বিদেশি ব্যাংকগুলো। এর কারণ হিসেবে অবশ্য ব্যাংক খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিদেশি ব্যাংকগুলোর জনবল অনেক কম, আবার দেশজুড়ে কার্যক্রমও বিস্তৃত নয়, অর্থাৎ শাখা খুব কম। ফলে বিদেশি ব্যাংকগুলোর খরচের খাত দেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তুলনায় অনেক কম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো বছরে সম্মিলিতভাবে যে আয় করে, তার প্রায় ৮৩ শতাংশই খরচ হয়ে যায়। সর্বশেষ ২০২২ সালে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত আয় ছিল ২৮ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা। এর বিপরীতে তাদের খরচ হয়েছিল ২৩ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা।

বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন খাতে খরচ করতে হয় তাদের মোট আয়ের ৭৯ শতাংশ। গত বছর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত আয় ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা, আর খরচ ছিল ৮২ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।

অন্যদিকে বিদেশি ব্যাংকের আয়ের তুলনায় খরচ অনেক কম, মাত্র ৩৬ শতাংশ। গত বছর বিদেশি ব্যাংকগুলো তাদের সম্মিলিত ৮ হাজার ৯১ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে খরচ করেছে ২ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা।

আর্থিক হিসাবপদ্ধতি অনুযায়ী, মোট আয় থেকে সব ধরনের খরচ বাদ দেওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকে, তা–ই মুনাফা। এ মুনাফার ওপর আবার সরকার নির্ধারিত কর প্রদান করতে হয়। এ ছাড়া ব্যাংককে প্রভিশন সংরক্ষণও করতে হয় মুনাফা থেকে। ফলে কর ও প্রভিশন সংরক্ষণের পর প্রকৃত মুনাফা বেশ কমে যায়।

এ নিয়ে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির সহসভাপতি ও সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, বিদেশি ব্যাংকগুলোর মুনাফায় প্রবৃদ্ধির কারণ হলো, তাদের বেশির ভাগই ভালো মুনাফা করে। অন্যদিকে, স্থানীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে ছয়–সাতটি ভালো মুনাফা করলেও বাকিগুলোর মুনাফা কম। এ কারণে স্থানীয় ব্যাংকগুলোর গড় মুনাফা কমে যায়। এ ছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলোর ভালো মুনাফা অর্জনের কারণ হলো, ঋণ প্রদান ও আদায় এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রে সুশাসন থাকা। আবার তারা কম খরচে আমানত সংগ্রহ করতে পারে। সারা দেশে তাদের কার্যক্রম না থাকায় খরচ কম হওয়ার আরেকটি কারণ। সেই তুলনায় স্থানীয় ব্যাংকের খরচ অনেক বেশি। কারণ, দেশজুড়ে এসব ব্যাংকের কার্যক্রম রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৩০ বছরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছিল ২০১৩ সালে। ওই বছর রাষ্ট্রমালিকানাধীন সব ব্যাংক মিলে ২ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল। দেশীয় বেসরকারি সব ব্যাংক মিলে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছিল ২০২০ সালে। করোনায় আক্রান্ত বছরটিতে দেশের বেসরকারি সব ব্যাংকের মোট মুনাফা হয়েছিল ৮ হাজার ২৩ কোটি টাকা। আর বিদেশি ব্যাংকগুলো গত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছে গত বছর, যা পরিমাণে ৩ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা।

মুনাফা পরিস্থিতির উত্তরণে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পেশাদার লোক নিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি ব্যাংকগুলোর মতো ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে যাচাই–বাছাই প্রক্রিয়া শক্তিশালী করার পরামর্শ দেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, দেশের ব্যাংকগুলোকে দুষ্টচক্র থেকে বের করে আনতে হবে। তাহলেই পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।

প্রথম আলো

Exit mobile version