Site icon The Bangladesh Chronicle

মিয়ানমারের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ‘না ঘর কা, না ঘাট কা’ রোহিঙ্গারা

ড. মাহফুজ পারভেজ

বাংলাদেশের সীমান্তের পাশে মিয়ানমারে যে সশস্ত্র সংঘাত চলছে, তা জাতিগত আধিপত্য ও ক্ষমতা বিস্তারের রাজনৈতিক প্রচেষ্টা ও সামরিক লড়াই। যে লড়াইয়ে দেশটির বিভিন্ন জাতিসত্তা জোটবদ্ধ হয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন জান্তা সরকারকে সামরিক দিক থেকে পর্যুদস্ত করে চলেছে। জোরালো লড়াই হচ্ছে বাংলাদেশের লাগোয়া মিয়ানমারের সাবেক আরাকান বা বর্তমান রাখাইন প্রদেশে। যে প্রদেশের বাসিন্দা হলো রোহিঙ্গা ও রাখাইন জাতিগোষ্ঠী।

রাখাইনরা বর্তমান লড়াইয়ে অংশ নিলেও রোহিঙ্গারা আগেই স্বদেশ থেকে উৎখাত হয়েছে। ফলে মিয়ানমারের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ‘না ঘর কা, না ঘাট কা’ অবস্থায় রয়েছে রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারের রাজনৈতিক ভবিষ্যতে তাদের আদৌ কোনো অংশগ্রহণ নেই এবং দেশটির ক্ষমতার বিন্যাসে রোহিঙ্গাদের স্থান পাওয়ার সম্ভাবনাও সঙ্কুচিত।

মিয়ানমারের সশস্ত্র সংঘাতে পরভূমিতে প্রায় পনের লক্ষ রোহিঙ্গাদের সামনে এখন দুটি বিকল্প খোলা। ১. পরবাসে শরণার্থী জীবন অব্যাহত রাখা এবং ২. অস্ত্র হাতে কোনো একটি পক্ষের সঙ্গে মিশে লড়াইয়ে যোগ দেওয়া ও নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।

তাছাড়া, মিয়ানমার সংঘাতে সতর্ক নানা দেশ, বিশেষত চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। নিকট প্রতিবেশী হিসাবে বাংলাদেশকেও মিয়ানমার পরিস্থিতিতে চোখ বন্ধ করে থাকার সুযোগ নেই।

চীন অতীতে ক্ষমতাসীন জান্তা সরকারকে সমর্থন করলেও অধুনা বিদ্রোহী ক্যারেন, কোচিন, শান, রাখাইন জাতিসত্তার বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করছে। এদের ঐক্যবদ্ধ করে মিয়ানমারের ক্ষমতায় আনতে চায় চীন। মিয়ানমারে একটি অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরে যাতায়াত পথ ও কর্তৃত্ব কায়েমে আগ্রহী চীন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন খ্রিস্টান অধ্যুষিত মিয়ানমারের চীন জনগোষ্ঠীর প্রতি।মিয়ানমারের চীন প্রদেশ ভারতের খ্রিস্টান-প্রধান রাজ্য নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও মিজোরাজ এবং বাংলাদেশের বান্দরবান সংলগ্ন, যেখানে উপজাতিদের মধ্যে খ্রিস্ট ধর্মের প্রাধান্য রয়েছে। দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গমস্থলে একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় শক্তি লাভবান হবে। অতীতে লাওস ও কম্বোডয়ায় এমন চেষ্টা করে পশ্চিমারা ব্যর্থ হন। মিয়ানমারের সংঘাতের প্রেক্ষাপটে এমন একটি সুপ্ত লক্ষ্য তাদেরও রয়েছে।
বাংলাদেশকে মিয়ানমারের চলমান সশস্ত্র সংঘাতে অত্যন্ত সতর্ক ও কৌশলপূর্ণ অবস্থান নিতে হবে। সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, মিয়ানমারে চলমান পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে একটা যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি। ১৯ ফেব্রুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ অধিবেশনে অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এসব কথা বলেন।

এদিকে, রাখাইনের মুসলিমদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে চায় মিয়ানমারের জান্তা সরকার। রাখাইনের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চল মংডুর মুসলিম নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর কমান্ডাররা। ওই বৈঠকে সেনা কমান্ডাররা মুসলিম নেতাদের প্রস্তাব দিয়েছেন, যদি তারা জান্তা বাহিনীর হয়ে কাজ করেন; তাহলে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হবে। বৈঠকে উপস্থিত এক মুসলিম নেতার বরাতে ১৯ ফেব্রুয়ারি এ তথ্য জানিয়েছে রাখাইনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নারিনজারা নিউজ।

সূত্র জানায়, গত ৯ ফেব্রুয়ারি মংডুর ময়ো থু গি গ্রামের ৫নং বর্ডার গার্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নে বৈঠকটি হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন জান্তার ডিভিশন কমান্ডার থুরেন তুন এবং বিভাগীয় প্রশাসক নায়ো ও। তাদের আয়োজিত এ বৈঠকে স্থানীয় মুসলিম নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়।

যখন পুরো রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দ্বারপ্রান্তে বিদ্রোহীরা, তখন এমন একটি বৈঠকের খবর পাওয়া যায়। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী এক মুসলিম নেতা নারিনজারা নিউজকে বলেছেন, “বৈঠকে কমান্ডার থারুন তুন আমাদের বলেছেন, রাখাইনের মানুষের (বৌদ্ধ আরাকান আর্মি) কারণে আমরা মুসলিমরা ভুগছি। ফলে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অস্ত্র তুলে নেওয়া উচিত। এমনকি এই কমান্ডার আমাদের নিশ্চয়তা দিয়েছেন, যদি আমাদের গ্রামের কাছে যুদ্ধ শুরু হয় তাহলে সেনারা আমাদের গ্রামে হামলা চালাবে না। তারা শুধুমাত্র রাখাইনের গ্রামে হামলা চালাবে। এজন্য আমরা যেন জান্তার হয়ে কাজ করি।” তবে বৈঠকে উপস্থিত মুসলিম নেতাদের একটি অংশ বলেছেন, “যদি তাদের সত্যিকার অর্থে মিয়ানমারের নাগরিকের মর্যাদা দেওয়া হয়; তাহলে তারা এই প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখবেন।”

একাধিক সংবাদভাষ্য পর্যালোচনা করে অনুমান করা যায় যে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা নেতা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধান্বিত। কিছু নেতা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের সত্যিকার নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তবে রাখাইনের মানুষের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন বেশিরভাগ নেতা। তা সত্ত্বেও সেনা কমান্ডার তাদের আহ্বান জানিয়েছেন, বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতে।

মংডুর পাশাপাশি বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী আরেক অঞ্চল বুচিডংয়েও মুসলিম নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জান্তার কমান্ডাররা। সেখানেও বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতে মুসলিমদের উদ্বুদ্ধ করছেন তারা।

এদিকে রাখাইনের মুসলিমদের হাতে জান্তা বাহিনীর অস্ত্র তুলে দেওয়ার প্রস্তাবের বিষয়টি এমন সময় সামনে এলো— যখন জানা যাচ্ছে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে জান্তাকে হটিয়ে পুরো রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নেবে বৌদ্ধ বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। রাখাইনে জান্তা বাহিনীর আসন্ন পতনের ব্যাপারে একটি বিবৃতিতে বিদ্রোহীদের জোট ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স জানিয়েছে, জান্তা বাহিনী রাখাইনে একের পর এক সেনা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। বিদ্রোহীদের এ জোট আরও দাবি করেছে, কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছোট ও বড় ক্যাম্পের সেনারা বিদ্রোহীদের কাছে খুব দ্রুতই আত্মসমর্পন করবে। যেসব ক্যাম্পের সেনারা এখনো আত্মসমর্পণ করেনি; তাদের বিরুদ্ধে আরাকান আর্মির (এএ) যোদ্ধারা হামলা অব্যাহত রেখেছে।

বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মংডুতে বিমান হামলা
ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স আরও জানিয়েছে, জান্তাবাহিনী তাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। তারা আরাকান আর্মির যোদ্ধাদের অগ্রসর হওয়া ঠেকাতে পথে পথে বাধা সৃষ্টি করছে। এমনকি বেশ কয়েকটি সেতুও ধ্বংস করেছে তারা। জান্তা বাহিনী বর্তমানে যেভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করছে; এতে বোঝা যাচ্ছে তারা যুদ্ধে হারছে— বিবৃতিতে দাবি করেছে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স।

কক্সবাজারের রামু, টেকনাফ, উখিয়া এবং বান্দরবানের সীমান্তে প্রায়ই মিয়ানমারের সংঘাতের আঁচ অনুভূত হওয়ায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থীরাও বিচলিত। গবেষণা কাজে সীমান্তে যোগাযোগ আছে, এমন একাধিক সূত্রের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তাদের মতে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে মিয়ানমার পরিস্থিতিতে তিন মত রয়েছে। ১. শরণার্থী হিসাবে চুপচাপ থাকা, ২. জান্তা বাহিনীর সঙ্গে হাত মেলানো, এবং ৩. বিদ্রোহী আরাকান আর্মিকে সমর্থন করা।

রোহিঙ্গাদের অনেকের মতে, কারো কারো কাছে আরাকান আর্মিকে ভালো লাগছে। তবে তারাও যদি জান্তা বাহিনীর মতো অত্যাচার করে, তাই এখনো তাদের বিশ্বাস করতে পারছে না সবাই। জান্তার অতীত কার্যক্রমের জন্য তাদেরকেও সমর্থন করা ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে বিরাজ করছে চরম দ্বিধা।

সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হলো এই যে, গোপনে রোহিঙ্গাদের কাছে নানা গ্রুপের তরফে অস্ত্র আসছে। প্রায়ই ক্যাম্পে ও আশেপাশে অস্ত্র পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি, রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন অংশ মিয়ানমারের বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। রোহিঙ্গারা যে নিজের মধ্যে সশস্ত্র লড়াই করে খুন-খারাবি করছে, তার নেপথ্যে রয়েছে বিভিন্ন গ্রুপের পক্ষে আধিপত্য বিস্তারের মতলব।

মিয়ানমারে যে সামরিক যুদ্ধ চলছে, তার নানামুখী প্রভাব বাংলাদেশে বসবাসকারী তথা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কতদিন সামাল দিতে পারবে, এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাদের মধ্যে যে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে কোন পথে চালিত করে, সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। তদুপরি, মিয়ানমারে যদি নতুন কোনো সরকার আসে, তাহলে রাতারাতি রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাবে কিনা, তা-ও অস্পষ্ট। কারণ, মিয়ানমারের জান্তা সরকার, বিদ্রোহী ও সিভিল সোসাইটির সংগঠনগুলো তথা কোনো পক্ষই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের অধিবাসী বা নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে না।

যদিও আশাব্যঞ্জক দিক হচ্ছে, আরাকান আর্মি এবং ন্যাশনাল ইউনিটি গভমেন্ট রোহিঙ্গাদের ‘রোহিঙ্গা’ বলে শনাক্ত করছে, ‘রোহিঙ্গা’ বলে ডাকছে, ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটা ব্যবহার করছে। তারপরও যদি সামরিক জান্তার পতন হয়ে বিদ্রোহীরা সরকারে আসে, তাহলে প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গা রাতারাতি মিয়ানমারে চলে যেতে পারবে নাকি তাদের ভবিষ্যৎ আরো কঠিন হবে, তা বলা কঠিন। পরিস্থিতি যা-ই হোক, রোহিঙ্গারা তাদের নাগরিকত্ব ও নিজ ভূমি ফেরত পাবে কিনা তাতেও ঘোরতর অনিশ্চয়তা রয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগাস্টে মিয়ানমারের সরকারি সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে পালিয়ে বাঁচতে দেশটির রাখাইন বা আরাকান রাজ্য থেকে বাংলাদেশ অভিমুখে রোহিঙ্গাদের যাত্রা শুরু হয়। এরপর কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়, যেখানে আগে থেকেই ক্যাম্পে বসবাস করছিলেন আরো ৪ লাখ রোহিঙ্গা। পরে সেই সংখ্যা বাড়তে থাকে। এরপর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা (বেসরকারি মতে তাদের সংখ্যা এখন বেড়ে ৫ লক্ষাধিক) প্রত্যাবাসনের বিষয়টি বারবার আলোচনায় এলেও সেটি বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হয়নি। এমতাবস্থায়, মিয়ানমারে সশস্ত্র সংঘাত শুরু হওয়ায় পুরো পরিস্থিতি, বিশেষত রোহিঙ্গা ইস্যুটি আরো সংকটাপন্ন আকার ধারণ করেছে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

manabzamin

Exit mobile version