Site icon The Bangladesh Chronicle

মিথ্যাকে জাতীয়করণ করা হয়েছে


মিথ্যাকে এখন আর মিথ্যা বলা যায় না, বলতে হয় ‘অসত্য’। কেউ কারো বয়স জিজ্ঞাসা করলে বলে, আপনার সার্টিফিকেট এজ কত হয়েছে? কারো প্রকৃত বয়স কত, তা এখন আর কেউ জিজ্ঞাসা করে না; বরং সবাই বিশ্বাস করে সবার অভিভাবকই এখন বয়স গোপন করেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বা জন্মনিবন্ধন করান। এটি এখন শুধু সংস্কৃতির অংশ নয়, বরং মিথ্যাকে সত্য মেনেই চলছে সব কর্ম। এটিই বর্তমান সমাজে প্রচলিত ব্যবস্থা।

ড্রাইভার নিয়োগ দেয়ার সময় নিয়োগকর্তা জিজ্ঞাসা করেন, তোমার লাইসেন্স নকল না জেনুইন? ড্রাইভিং জানে অথচ লাইসেন্স পায় না। ফলে নকল লাইসেন্স জেনেই নিয়োগকর্তা ড্রাইভার নিয়োগ দিয়ে আসছেন। বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে মিথ্যা কথা, মিথ্যা রিপোর্ট, মিথ্যা সংবাদ, মিথ্যা প্রতিবেদন। মিথ্যা কথা ছাড়া বাদির এজাহার হয় না। এজাহারে মিথ্যা কথা না লিখলে বাদির মামলায় প্রতিকার প্রত্যাশা করে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরাসরি গুলি করে হত্যা করে বলে ক্রসফায়ারে মৃত্যু হয়েছে এবং এ সূত্র ধরেই সব মিডিয়া হত্যাকে ক্রসফায়ার বলে চালিয়ে দিচ্ছে। ইনকাম ট্যাক্স আইন এতই জটিল, এর চেয়ে বেশি জটিল ইনকাম ট্যাক্স অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সরকারকে ট্যাক্স দেয়ার আগে ইনকাম ট্যাক্স অফিসের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের খুশি করতে হয়। তাদের খুশি করাকে নাম দিয়েছে ‘টেবিল মানি’। অর্থাৎ যে টেবিলে ফাইল যাবে সে টেবিলকেই দক্ষিণা পূজা দিতে হবে।

জনগণের অধিকার রক্ষার্থে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা সাংবিধানিকভাবে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন। যেমন- জাতীয় নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্থা, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। এ ছাড়াও সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ জনগণের অধিকার হরণ করায় সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘জনস্বার্থে’ প্রজ্ঞাপন জারি করা হলো। আইন প্রয়োগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যে প্রতিবেদন দাখিল করে, তার প্রতি জনগণ কতটুকু আস্থা রাখতে পারছে?

প্রতিটি মোকদ্দমার বাদি নিজেই মামলার ক্ষতি করে। আইনাঙ্গনে প্রচার রয়েছে যে, মিথ্যা বলা ছাড়া মামলা দায়ের হয় না। চলছে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা করার প্রতিযোগিতা। আইন প্রয়োগের প্রশ্নে চলছে দুই ধরনের নীতি, ক্ষমতাসীনদের প্রশ্নে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা একরকম সিদ্ধান্ত নেয়, ভিন্নতর সিদ্ধান্ত হয় ক্ষমতাহীনদের প্রশ্নে। রাষ্ট্রযন্ত্র বা সরকারি-বেসরকারি যেকোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান কোনো বক্তব্য প্রচার বা প্রকাশ করলে কোন অংশ সত্য, কোন অংশটি মিথ্যা; তা নিরূপণ করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। আইনি আদালতের চেয়ে জনতার আদালত সত্য-মিথ্যা নিরূপণের প্রশ্নে জনতার চোখে কার অবস্থান কতটুকু, তাও পর্যালোচনার দাবি অযৌক্তিক নয়। শিল্প প্রতিমন্ত্রী মো: জাকির হোসেন আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে ০৮/৯/২০২১ দেশে সাক্ষরতার সংখ্যা নির্ণয়ের মিথ্যা প্রতিবেদন সম্পর্কে বলেছেন, ‘শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে সাক্ষরতার হার কম দেখানো হচ্ছে। একই সাথে নিরক্ষর ও ঝরে পড়া শিশুদের সংখ্যা বেশি দেখিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচির নামে সরকারি-বেসরকারি অর্থের অপচয় ও লুটপাট করা হচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সাক্ষরতা কর্মসূচির নামে কিছু কর্মকর্তার (সরকারি কর্মকর্তা) মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট হচ্ছে। কাগজ-কলমে কাজ দেখালেও আসলে তারা কিছুই করছে না। প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের টাকা (ঘুষ) দিয়ে ঝরে পড়ার সংখ্যা বাড়িয়ে অনৈতিকভাবে সরকারি অর্থ ভাগাভাগি করে নেয়া হচ্ছে।’

সাক্ষরতা জাতির শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত। সর্বজনস্বীকৃত ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’। অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা সম্পর্কে সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১৭তে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র :
(ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য,
(খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য,
(গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।

মিথ্যা প্রতিবেদন আমলাদের একটি নিয়মে পরিণত হয়েছে। ডাকাত অস্ত্র ঠেকিয়ে ডাকাতি করে সর্বস্ব লুট করে, অন্য দিকে আমলারা মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়ে জাতির সাথে প্রতারণাসহ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অস্ত্রের পরিবর্তে কলম দিয়ে ডাকাতি করে। দণ্ডবিধির ৩৯০/৩৯১ ধারায় রবারী ও ডাকাতির সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে, সে সংজ্ঞার চেয়ে মিথ্যা প্রতিবেদনের মাধ্যমে জাতির সম্পদ ডাকাতি আরো জঘন্য অপরাধ, কিন্তু আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সরকার নিজেদের অপকর্ম ঢাকার জন্য আমলাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা ও সাক্ষরতার মিথ্যা প্রতিবেদন সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য একটি উদাহরণ মাত্র। প্রকৃতপক্ষে সরকারের প্রতিটি স্তরে ও ক্ষেত্রে মিথ্যা প্রতিবেদন, মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের বিপুল অর্থ দেশের বাইরে মানি লন্ডারিং হচ্ছে।
রাজনীতির অপর নাম নাকি মিথ্যার বেসাতি। যে যত বেশি মিথ্যা অর্থাৎ অসত্য কথা বলতে পারে সে তত বড় রাজনীতিবিদ। কারো যদি কোনো ব্যক্তির কথায় সন্দেহ হয় তখন বলে, ‘ভাই’ এখানে রাজনৈতিক কথা বলবেন না, প্রকৃত কথা বলুন। ফলে জনমনে ধারণা জন্মেছে যে, রাজনীতিতে সত্য বলার সংস্কৃতি উঠে গেছে। ফলে গণমানুষ এখন আর রাজনীতিবিদদের কথা বিশ্বাস করে না। সজ্জন ব্যক্তিরা বলে থাকেন, ‘সত্য সমাগত’। বিভিন্ন পুস্তকেও নীতিবাক্য হিসেবে কথাটা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। ‘সত্যের’ জয় হবেই, হবে এ কথা বললে নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষ আশার আলো দেখতে পায় বটে, কিন্তু বাস্তবে কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না। তবে আশার কথা এই যে, যারা জুলুম অত্যাচার নির্যাতন করে এবং মানুষের অধিকার ছিনিয়ে নেয় প্রকৃতির নিয়মে তারা সাজা ভোগ বা পরিণাম পেয়ে থাকে। সীমালঙ্ঘনকারী কোনো না কোনোভাবে পরিণাম ভোগ করে, কিন্তু ‘মিথ্যার’ প্রভাব থেকে দুর্বল মানুষেরা মুক্তি পাচ্ছে না। সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য সময়ে সময়ে গণমানুষ, সাধারণ মানুষ, জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম করেছে, রক্ত ঝরিয়েছে, আন্দোলন-সংগ্রাম করে কোনো কোনো সময় ‘সত্যকে’ প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেও যারাই জয়ী হয় তারাই নিজেদের জয়ের আসনে চিরস্থায়ীভাবে পাকাপোক্ত করার জন্য মিথ্যাকে পুঁজি করে অগ্রসর হতে থাকে। ফলে ‘সত্য’ নামক আখ্যাঙ্কিত প্রদীপটি অল্পতেই নিভে যায়। আবার নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের হতাশা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে, অসহায়ত্বে নিমজ্জিত হয় গণমানুষ।

রাষ্ট্র একটি জড়বস্তু, সে নিজে কথা বলতে পারে না, রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে ‘সংবিধান’। এ সংবিধানও একটি জড়বস্তু, যা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত একটি বই হলেও এর শক্তি অপরিসীম। যদি রাষ্ট্র পরিচালনাকারী ব্যক্তিরা নীতিবহিভর্‚তভাবে মৌলিক অধিকারের অপব্যাখ্যা দেয়, তখন সংবিধান মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। এ অবস্থায় রাষ্ট্রের নাগরিকরা অসহায় প্রজায় পরিণত হয়। জমিদারি শাসনামলে প্রজার রক্ত ঝরলেও যেমন প্রতিবাদের সুযোগ ছিল না, হালে আইনের অপপ্রয়োগে স্বাধীন রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের চলছে সে করুণ অবস্থা।

মন্ত্রীরা যখন কথা বলেন তখন হা করে তাকিয়ে থাকতে হয়। কারণ অনেক ক্ষেত্রে তাদের বক্তৃতার সারবস্তুর সাথে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com

Exit mobile version