মিজানুর রহমান খান ও পিনাকী ভট্টাচার্য
কোভিডে আক্রান্ত হয়ে সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের অকাল মৃত্যুতে আমি লিখেছিলাম, “স্নেহভাজন মিজানের এভাবে চলে যাওয়ায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছি। বিদায়! ভালবাসা, মিজানুর রহমান খান। আমি সবে কোভিডের কবল থেকে এলাম। মিজানের খবর শুনে ভেবেছি, ও ঠিকই বেরিয়ে আসবে। কিন্তু হোল না”।
তরুণ সাংবাদিক হিশাবে মিজান একটা সময় পর্যন্ত আমার খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল। রাত্রে অফিস শেষ করে মধ্য রাত থেকে ভোর অবধি মিজান দিনের পর দিন আমার বাসায় এসে গল্প করে গিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা পর্যালোচনার জন্য বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে আমি আশির দশক থেকেই লেখালিখি শুরু করি। কিছু লেখা ‘‘সংবিধান ও গণতন্ত্র’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। সেইসব লেখা সংবিধানের প্রতি মিজানের বিপুল আগ্রহ তৈরি করেছিল। রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামের সবচেয়ে ঘনীভূত ও কেন্দ্রীয় লড়াইয়ের ক্ষেত্র হচ্ছে আইন ও সংবিধান, এটা সে বুঝে গিয়েছিল। কিন্তু মিজান এই উপলব্ধি ব্যাবহার করেছিল আওয়ামী লীগের পক্ষে দাঁড়িয়ে নির্বিচার বিএনপির বিরোধিতায়, যা তার প্রতিটি লেখায় কোন না কোন ভাবে হাজির থাকত। যা বিদ্যমান ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে মদদ দিয়ে গিয়েছে। সমকাল ও যুগান্তরে থাকার সময় গড়ে ওঠা তার দিল্লী প্রেম ও মার্কিন প্রীতি ২০০৫ সালের নভেম্বরে প্রথম আলোতে যোগ দেবার পর আরও প্রবল হয়ে ওঠে। এক এগারোর পর ডেইলী স্টার ও প্রথম আলোর বৃত্তে মিজান একসময় হারিয়ে গেল, হয়ে গেল ডেইলী স্টার ও প্রথম আলোর চাকুরীজীবী। আমার সঙ্গে সম্বন্ধও ছিন্ন হয়ে গেল।
সে যাই হোক, মিজান রাজনৈতিক ভাবে আমার রাজনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর হলেও কোভিডে তার মৃত্যুর খবর শুনে আমার খারাপ লেগেছে। আমি কখনই মানবিক বৃত্তি খোয়াতে চাই নি। স্নেহ করেছি, তাই ব্যথিত বোধ করেছি। আমি অমানুষ হতে রাজি না। কখনই হবো না। রাজনৈতিক ও আদর্শিক বিরোধ আর মানুষ হিশাবে সাহচর্য, স্মৃতি ইত্যাদির অনুভূতি বা বোধটুকু আমি হারাতে চাই না। মানুষের বাচ্চা মানুষ থাকতে চাই।
কিন্তু মিজানুর রহমান খান সম্পর্কে আমার স্টেটাস বন্ধুভাজন পিনাকী ভট্টাচার্যের পছন্দ হয় নি। আমি নিজে সদ্য কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। আমি চাইনা আমার ঘোর শত্রুও কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হোক। নিঃশ্বাস নিতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে মানুষের মৃত্যু ভয়াবহ ব্যাপার। শত্রু/মিত্র ভেদ, বলপ্রয়োগ,ক্ষমতা চর্চা বা রাজনীতির ক্ষেত্র বিচার করা এক কথা, আর মানুষের প্রতি মানুষের সহজ ও স্বাভাবিক সংবেদনা হারিয়ে ফেলা ভিন্ন মামলা; এটা নতুন সিম্পটম। সমাজের ভয়ংকর অসুখ।
দেখলাম, মিজানুর রহমান খানের মৃত্যুতে সোশ্যাল মিডিয়ায় এক শ্রেণীর প্রবল অহংকারী ও আত্মভরী ফেইসবুকারগণ মরণের পরপরই তার বিচার বসিয়ে দিয়েছে, যেন পারলে মিজানের কৃতকর্মের জন্য এক্ষুণি শাস্তি দিয়ে তারা শান্তি পেতে পারেন। মিজানুর রহমান খানের চিন্তা সমাজ থেকে তার মৃত্যুর পর রাতারাতি উবে যাবে না। মৃত্যুর পর মিজানকে নিয়ে মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমানের লেখা পড়লে আমরা বুঝব, সে ছিল ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর নয়নের মণি। তার চিন্তা ধারণ করে শক্তিশালী মিডিয়াগুলো বাংলাদেশে এখনো আছে। থাকবে। মতাদর্শিক লড়াইয়ের দিন কিম্বা জায়গা শেষ হয়ে যায় নি। চলবে। কিন্তু অনেকের ধারনা, মরবার পরপরই যাকে অপছন্দ করি তার বিরুদ্ধে বলা ভাল সময়! এটা শস্তা পথ। যারা এই শস্তা পথ নিয়েছেন তাদের সুবুদ্ধি ফিরুক, এই কামনা করি।
কিন্তু পিনাকীর স্টেটাসে আমি থমকে গিয়েছি। মানুষের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান এবং মানবিক বৃত্তির ক্ষয় আমাকে স্তম্ভিত করেছে। এর আগের স্টেটাসে আমি ‘ডিজিটাল ফ্যাসিবাদ’ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ব্যাখ্যা করেছি কমিউনিকেশান ইন্ডাস্ট্রি এবং নতুন ইন্টারনেট টেকনলজি কিভাবে আমাদের যারপরনাই স্টুপিড বা গর্দভে পরিণত করে। শত্রু/মিত্র ভেদের বাইরে মানুষের সঙ্গে মানুষের নানাবিধ মানবিক সম্বন্ধ থাকতে পারে, সে ব্যাপারে আমাদের বিকট অসচেতনতা চিন্তার বিষয়। এটা পরিষ্কার, কোন বিষয় নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করবার সময়, ইচ্ছা কিম্বা নিষ্ঠা সোশ্যাল মিডিয়া লোপাট করে দেয়। আমাদের চিন্তা এলসিডি স্ক্রিনে আঠার মতো আটকে যায়, গভীরে যেতে পারে না। মিজানের মৃত্যুর পর এই প্রথম ভাল ভাবে বুঝলাম বাংলাদেশে একটি ফেইসবুক-টুইটার সমাজ তৈরি হয়েছে যারা রাজনৈতিক বিচার এবং সহজ মানবিক সংবেদনার মধ্যে ফারাক করতে অক্ষম। বাংলাদেশের নতুন ডিজিটাল সমাজ বুঝতে গেলে এই সিম্পটমগুলো বোঝা জরুরী হয়ে উঠেছে।
মিজানুর রহমান খানের অবশ্যই কঠোর সমালোচনা/পর্যালোচনা হতে পারে। যারা করছেন, তাদের আপত্তি অনর্থক নয়। সত্যও বটে। কিন্তু ভাইরে, মানুষটিকে একটু শান্তিতে মরতে দিন! আমার প্রশ্ন মিজানুর রহমান খান জীবিত থাকার সময় আপনারা কোথায় ছিলেন? তখন তার মোকাবিলা করেন নি কেন? মিজান মরবার পরপরই তার বিরুদ্ধে হামলে পড়াটা কি খুবই জরুরী? জীবদ্দশায় কিছু বললাম না, যখন সে উত্তর দিতে পারত, মৃত্যুর পর তড়িঘড়ি নিন্দায় মেতে ওঠা খুবই কাপুরুষোচিত কাজ। মিজান কবর থেকে উঠে এসে এখন নিজের পক্ষে কিম্বা আপনাদের বিরুদ্ধে কিছু লিখতে পারবে না। এই সুযোগটাই তো নিলেন। তাই না? নিন।
বন্ধুভাজন পিনাকী ভট্টাচার্যের স্টেটাস পড়ে তাই আমি প্রথমে বিশ্বাস করি নি। আমি তাকে ম্যাসেজ দিলাম, পিনাকী আপনি কি এই কর্ম করেছেন? ইনবক্সে কি করা যেত না? যেমন আমি আপনাকে এর আগে কয়েকবারই করেছি? পাবলিকলি আমার বিরুদ্ধে কামান দাগালেন? কেন? কি অর্জন করতে চাইছেন? আমাকে তো এর উত্তর এখন পাবলিকলি দিতে হবে। বাংলাদেশের যে বাস্তবতা তাতে কি এখন আমার সঙ্গে আপনার ঝগড়ার সময় হাজির হয়ে গিয়েছে? তিনি গর্বিত কন্ঠে উত্তর দিলেন, তিনি সজ্ঞানেই পাবলিক স্টেটাস দিয়েছেন। খোন্দকার রাকীবকে ধন্যবাদ। আমাকে সতর্ক করার জন্য রাকীব প্রথম আলোয় প্রকাশিত মিজানের একটি লেখার লিঙ্ক দিয়েছেন। রাকিবের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমি লিখেছি, “রাকীব, অনেক কথা বলার আছে। আজ, মিজানুরের মৃত্যুর পরপরই বলতে চাই নি। আপনি উল্লেখ করেছেন, ভাল হোল। একটা রক্তক্ষয়ী লড়াই আমাদের লড়তে হচ্ছে, আগামি দিনেও তার বিরতি হবে না সহজে। ভাল যে তরুণদের কাছে অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে”। মানুষটি সবে মারা গেল, তার বিরুদ্ধে আমি এখনই নিন্দা করে স্টেটাস দেব? আমি কি বিবেক শয়তানের কাছে বেচে দিয়েছি?
পিনাকীর গর্বিত উত্তরে আমি খুশী হয়েছি। বলেছি, তথাস্তু! ধন্যবাদ, পিনাকী ভট্টাচার্য। আসলেই। বিনয়ের সঙ্গে শুধু বলেছিলাম, বহু বিষয়েই তার সঙ্গে আমার চিন্তা রাজনীতি এবং রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে পার্থক্য আছে। যে সকল দিক মারাত্মক মনে হয়েছে সে সম্পর্কে আমি ইনবক্সে পিনাকীকে সতর্ক ও সাবধান করেছি। যেমন ডক্টর কামাল হোসেন এবং ঐক্যফন্টের রাজনীতির পক্ষে পিনাকীর অবস্থান। সম্প্রতি পিনাকী দাবি করেছেন বাংলাদেশে তিনি ‘রোবাস্ট ক্যাপিটালিজম’ চান। ‘রোবাস্ট ক্যাপিটালিজম’ কি আমি জানি না, তবে বুঝতে পারলাম তিনি পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রেমে পড়েছেন। আমি ইনবক্সে তাকে এই বিষয়ে সতর্ক করেছিলাম। পাবলিক পোস্ট দেওয়া জরুরী মনে করি নি। কারন তার ভুল চিন্তার সংশোধন সম্ভব। কিন্তু মিজানুরের মৃত্যুতে আমার ব্যাথিত হওয়া পিনাকীর সহ্য হোল না।
পিনাকী লিখেছেন, মিজানুরের মৃত্যুতে আমার দুঃখ পাওয়া ‘লীলা’। আমি তাদেরই দলের অন্তর্গত যারা ‘সাপ এবং ব্যাঙ্গের মুখে একসঙ্গে চুমা’ খাই। মিজানুরের মৃত্যুতে ব্যাথিত হওয়ার অর্থ সাপের মুখে চুমা খাওয়া’। বিএনপির লোকদের সঙ্গে একই কাতারে দাঁড়িয়ে আমি সাপের মুখে চুমা খেয়েছি। কেউ মারা গেলে তার ডেড বডিকেও আমাদের সজীব রাজনৈতিক দুষমণ গণ্য করতে হবে। না করাটা পিনাকীর কাছে ‘প্যাথেটিক’ মনে হয়েছে। ।
পিনাকী লিখেছেন, “মিজানুর রহমান খানের মৃত্যতে পরিষ্কার হইছে। যারা আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট বলে, তারা বেখবর কারা কারা আওয়ামী ফ্যাসিবাদ তৈরিতে বয়ান খাড়া করাইছে”। অর্থাৎ মিজানুর রহমান খান যে ফ্যাসিস্ট বয়ান খাড়া করেছে সেটা আমি জানি না। এটা শুধু পিনাকী ভট্টাচার্য জানে।
মিজানুর রহমান খান ফ্যাসিস্ট বয়ান তৈরীর করেছেন, এটা অবশ্য আমি মনে করি না। তার জ্ঞান হবার আগে থেকেই বাঙালি জাতিবাদী বয়ান শক্তিশালী ছিল, তিনি বাকশাল সমর্থক এবং ঘোরতর ভাবে আওয়ামী লীগার ছিলেন। বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট বয়ান বাঙালি জাতীয়তাবাদী ন্যারাটিভের সঙ্গে যুক্ত, পিনাকী ভট্টাচার্য নিজেও একদা সেই ন্যারেটিভ তৈরিতে যুক্ত ছিলেন। তিনি ভুলে যাচ্ছেন আদতে তিনি সিপিবি ঘরানার লোক। এখনো তিনি সেই ন্যারাটিভের বাইরে নন। পিনাকীকে তাই প্রমান করতে হয় এই দেশের আলেম, ওলেমা ইসলামপন্থিরাও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের – অর্থাৎ বাঙালি জাতিবাদী ছিলেন। অথচ ইসলামের সঙ্গে জাতিবাদের দ্বন্দ্ব মৌলিক। একাত্তরে ইসলামপন্থিদের একাংশের ভূমিকা নিয়ে তর্ক মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ নিয়ে তর্ক। মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলামকে হাজির করার তর্ক দিয়ে সেই ক্ষত আড়াল করা যাবে না।
ফ্যাসিবাদ এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে মিজানুর রহমান খানের সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে তিনি ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষাকারী লিবারেল মতাদর্শীদের মনে এই আশা জাগাতে পেরেছিলেন যে বাংলাদেশে আরেকটি গণ অভ্যূত্থান, নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন এবং নূতন ভাবে গণতন্ত্রের ভিত্তি গড়বার কঠিন কাজ না হলেও চলবে। স্রেফ বিদ্যমান সংবিধান ও আইনের সংস্কারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সহনশীল লিবারেল ডেমোক্রাসি তৈরি করে নেওয়া সম্ভব। এটা বাংলাদেশে ডেইলি-স্টার-প্রথম আলো সহ পশ্চিমা লিবারেলদের স্রেফ বালখিল্য ইলিউশান, কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষিত লিবারেল সমাজ এতে পুলকিত বোধ করেছে। মিজানুর রহমান খান নিয়ে আমি আমার স্টেটাসে সেটা খুব পরিষ্কার ভাবেই উল্লেখ করেছি, পিনাকী যা পড়তে ব্যর্থ হয়েছে:
“সেই সব দেশে পরিস্থিতি আরও কঠিন থেকে কঠিনতর যেখানে ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা দৃঢ় ভাবে কায়েম রয়েছে, এবং সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে আমরা এই ব্যবস্থা গত কয়েক দশক ধরে কায়েমে সহযোগিতা করেছি। করছি। বিশেষ ভাবে সাংবাদিকতার নামে নির্বিচারে করেছি। বুঝি নি, বুঝতে চাই নি বা বুঝি না যে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার মোকাবিলা সাংবিধানিক তর্ক কিম্বা আইনী সংস্কারের বিষয় না — এটা গণ আন্দোলন, ফ্যাসিস্ট শক্তির বিপরীতে পালটা গণশক্তি নির্মাণ এবং গণ অভ্যূত্থানের মামলা। ইতিহাস সেটাই শিক্ষা দেয়”।
মিজানুর রহমান খানের মৃত্যুর জন্য সমবেদনা জানাবার স্টাটাসে এর চেয়ে বেশী বলা আমি প্রয়োজনীয় মনে করি নি।
আমার দুর্ভাগ্য, পিনাকী পড়তে জানেন না। তাঁর বিরুদ্ধে আমার এই অভিযোগ তাকে জানিয়েছি। কারন মিজান সম্পর্কে আমি যা বলার দুই এক লাইনেই বলে দিয়েছি। তিনি এই কথাগুলো পড়েন নি। পড়লেও বোঝেন নি। বুঝলেও কিভাবে সাংবিধানিক, বৈচারিক কিম্বা আইনী তর্ক বিতর্কের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা দীর্ঘায়িত করা হয় সেটা জানেন না। আইন ও বিচার ব্যবস্থার পর্যালোচনা ও সংস্কার ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট বানাতে পারে, মিজানুর রহমানের এই সাংবাদিকতার মর্ম পিনাকী নিজেও ধরতে পারেন নি। তার কোন লেখায় সেটা দেখি নি। পিনাকী বোঝেন নি বলেই, সাপ আর ব্যাঙের মুখে চুমা খাবার রগরগে উদাহরণ দিয়েছেন।
পিনাকী শাহবাগের সমর্থক ছিলেন, তার পুরানা আইডিতে গেলে আমরা শাহবাগী পিনাকী ভট্টাচার্যকে চিনতাম। এতে অন্যায় কিছু নাই। এর দ্বারা তাকে আমি বিচার করি না, অন্য শাহবাগীদেরও নয়। এ নিয়ে তার সঙ্গে সেই সময় ফেইসবুকে তর্কবিতর্কও হয়েছে। কিন্তু শাহবাগের যোগদান করা আরও অনেকের মতো পিনাকীরও শাহবাগের পতনের আগে থেকেই দূরত্ব বাড়তে থাকে। শাহবাগের পতনের পর তাঁর ও আরো অনেকের অবস্থানের বদল আমি বুঝতে পারি, তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্কও দ্রুত ঘনিষ্ঠ হয়। পারিবারিক সূত্রে এবং তাঁর নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাস অনুযায়ী তিনি সারা জীবন সিপিবি করেছেন, কিন্তু সম্প্রতি ঘোরতর ভাবে সিপিবি, বাম ও কমিউনিস্ট বিরোধী। বামদের ইসলাম বিদ্বেষ এবং ইসলাম নির্মূল রাজনীতির প্রতি সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতার তিনি সমালোচনা করেন। সেই ক্ষেত্রে আমি তাঁকে নিঃশর্তে সমর্থন করি। কিন্তু কথায় কথায় বাম ও বাম রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে তার বিষোদগার আত্মঘাতী এবং চরম অদূরদর্শিতা। বাচ্চাকে গোসল করিয়ে পরিচ্ছন্ন করে সঠিক ভাবে বেড়ে উঠতে দেওয়া আমাদের কাজ। কিন্তু গামলার ময়লা পানি ফেলে দিতে গিয়ে বাচ্চাকেও ডাস্টবিনে বা ড্রেনে ফেলে দেওয়া কোন কাজের কথা না।
আমি কার্ল মার্কসের একনিষ্ঠ ছাত্র। কিন্তু সংকীর্ণ ‘মার্কসবাদী’ নই, কখনই ছিলাম না। আমি মার্কসের কাছ থেকে যে কোন মতবাদের ‘ক্রিটিক’ বা পর্যালোচনা করতে শিখেছি, কিন্তু ‘মতবাদী’ হওয়া শিখি নি। বামপন্থিদের পিনাকীর একাট্টা ও একতরফা সমালোচনা আমি সমর্থন করি না কারন শেষাবধি তা ‘পুঁজি’ ও পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষালম্বন হয়ে ওঠে এবং বাংলাদেশে নিপীড়িত ও মজলুম শ্রেণীর বিকাশের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। এটা আমাদের রাজনীতি হওয়া উচিত নয়। তাই পিনাকী ‘রোবাস্ট ক্যাপিটালিজম’ চায়, এটা জেনে আমি অবাক হই নি। একাট্টা বামপন্থার বিরোধিতা এই জায়গাতেই পৌঁছায়। অথচ দরকার পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের যুগে আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাগে বাংলাদেশের জন্য শক্তিশালী অবস্থান আদায় করে নেওয়া। সেটা বহুজাতিক কোম্পানি, বাংলাদেশের লুটেরা শ্রেণী, বিশ্ব ব্যাংক-আইএম এফ- বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াই করে আদায় করতে হবে। আমাদেঢ় কাজ বাংলাদেশের তরুণ বিপ্লবী বামপন্থীদের সঠিক পথ দেখানো। মার্কস ও কমিউনিজম সম্পর্কে ইসলামপন্থিদের ভুল অনুমান ও ধারণা শুধরে দেওয়া, ইসলামের বৈপ্লবিক মর্ম পরিষ্কার ভাবে হাজির করে জনগণের মধ্যে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বৃহত্তর সংগ্রামের জন্য গণঐক্য তৈরি। তাই বামদের এক তরফা সমালোচনা আমি আত্মঘাতী মনে করি। বরং ধর্মের প্রশ্নে বাংলাদেশে বামপন্থীদের সঠিক অবস্থান কি হতে পারে সেটা দেখিয়ে দিয়ে ফ্যাসিবাদ এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করবার বুদ্ধিবৃত্তিক শর্ত তৈরি করা আমাদের প্রধান রাজনৈতিক কর্তব্য বলে আমি মনে করি। আমাদের লেখালিখির মধ্য দিয়ে মার্কস-লেনিন-মাওজে দং-এর অনুসারী এবং ইসলামপন্থিদের মধ্যে ইতিবাচক বোঝাপড়ার শর্ত তৈরি হোক। সেটাই প্রধান কাজ। অর্থাৎ মজলুম ও সর্বহারা শ্রেণীকে বিভিন্ন মতবাদী রাজনীতি যেভাবে বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত ও পরস্পরের বিরোধী করে রেখেছে সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো এই কাজটাই সবচেয়ে বেশী দরকারী, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে এটাই বিপ্লবী মতাদর্শিক লড়াই। অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব বলে আমি মনে করি।
ইসলাম ও বাংলাদেশে ইসলামন্থিদের প্রতি পিনাকীর সদয় অবস্থান আমি পছন্দ করি এবং সমর্থন করি। এই ক্ষেত্রে পিনাকী ভট্টাচার্যের নির্ভীক ভূমিকা এই দেশের মজলুম জনগণ মনে রাখবে। আমার দিক থেকেও প্রশংসার কমতি হবে না। কিন্তু তার নির্বিচার ইসলামপন্থিদের সমর্থন শেষাবধি জাতিবাদী ইসলামপন্থাকে উসকে দেয়, যা বাঙালি জাতিবাদের উলটা পিঠ; একই ময়লার অপর পৃষ্ঠা মাত্র। এই ক্ষেত্রে পিনাকীকে সতর্ক হতে হবে।
শাহবাগের পর পিনাকীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। তার মধ্যে জানবার এবং পুরাতন চিন্তার বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসা এবং সঠিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী অর্জনের চেষ্টা আমি দেখেছি এবং অকুন্ঠচিত্তে প্রশংসা করি। সবসময়ই করব। মানুষের চিন্তার বদল ঘটতেই পারে। আমরা সকলেই নিজেদের ভুল ও অভিজ্ঞতা থেকেই শিখি। আমরা কেউই ফেরেশতা নই।
আশা করি পিনাকীও তার ভুল বুঝবেন।