- অ্যানড্রিয়াস স্টেফানসন, এলিজাবেথ উইন্টার, লিভ কেজোলসেথ ও জেসিকা হ্যাজেলউড
- ১৮ ডিসেম্বর ২০২১, ২০:০৩, আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২১, ২২:২৮
আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতাসীন হওয়ার তিন মাস পর চোখের সামনে আমরা একটি মানবিক বিপর্যয়ের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি। দারিদ্র্য এবং অপুষ্টি নজিরবিহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে দ্রুত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে ২০২২ সালে খাদ্যের অভাবে বিপুলসংখ্যক মানুষ মৃত্যুবরণ করবে। আফগানিস্তানে যুদ্ধ সঙ্ঘাত ও সহিংসতায় গত ২০ বছরে যত লোক মৃত্যুবরণ করেছে ক্ষুধায় তার চেয়েও বেশি মানুষ মারা যাবে।
আফগানিস্তানের ব্যাপারে অনেক দূর থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে এই মারাত্মক পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণের পর আফগান রাষ্ট্রের জন্য আন্তর্জাতিক তহবিল তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। বর্তমান তালেবান সরকারকে টার্গেট করে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের সম্মতিক্রমে নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের, আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ আটকে দিয়েছে। এ ছাড়াও দাতারা উন্নয়ন সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে। আগে সরাসরি আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে স্বাস্থ্যসেবাসহ আফগান সরকারের প্রায় ৭৫ শতাংশ ব্যয় মেটানো হতো। এই তহবিল আকস্মিকভাবে বন্ধ করে দেয়ার কারণে সরকারি খাতের হাজার হাজার কর্মচারীর বেতন দেয়া যাচ্ছে না।
লাখ লাখ মানুষ যারা ওই আয়ের ওপর নির্ভরশীল শিগগিরই তারা তীব্র দারিদ্র্যের কবলে পড়বে। বেসরকারি খাত এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যের ওপর আঘাত মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। আর সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
বর্তমানে অর্থনীতি ও ব্যাংকিংব্যবস্থা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে সরাসরি কাজ করবে না। প্রধানত যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসঙ্ঘের নিষেধাজ্ঞার কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও তাদের সাথে রয়েছে। আফগানিস্তানের ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, তারা বিদেশ থেকে অর্থ গ্রহণ করতে পারে না।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বা অর্থ বিভাগ কিছু ক্ষেত্রে সীমিত দায়মুক্তির অনুমতি দিয়েছে। সুনির্দিষ্ট মানবিক কার্যক্রম চালানোর লক্ষ্যে অর্থ আদান-প্রদানের জন্য জাতিসঙ্ঘ এবং কিছু আন্তর্জাতিক এনজিওকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার অনুমতি দিয়েছে। যাই হোক না কেন, আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে শাস্তি পাওয়ার ঝুঁকি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অত্যন্ত সতর্ক রয়েছে।
আর্থিক ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়া ছাড়াও বর্তমানে সেখানে মারাত্মক অনাবৃষ্টির ফলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির মতে, চলতি বছর প্রায় ৪০ শতাংশ শস্য হারাবে দেশটি। জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ প্রতিদিন নিজের জন্য খাদ্য জোগাড় করতে পারে না। এই সংখ্যা আরো বাড়বে বলে জাতিসঙ্ঘ সংস্থাগুলো মনে করে। বছর শেষে পাঁচ বছরের নিচের প্রায় ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন অর্থাৎ প্রায় ৩০ লাখ ২০ হাজার শিশু মারাত্মক পুষ্টিহীনতায় ভুগবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অবিলম্বে চিকিৎসা না করালে কমপক্ষে ১০ লাখ শিশু মৃত্যুবরণ করার ঝুঁকিতে পড়বে।
খুব কম নাগরিক ব্যাংকে যাদের টাকা আছে তারা কয়েক দিন ব্যাংকের বাইরে লাইন ধরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ব্যাংকে ‘কোনো নগদ টাকা নেই’ বলে জানানোর পর বেপরোয়া লোকজন মারমুখো হয়ে ওঠে। তাদের পরিবার পরিজন ক্ষুধার্ত। সাহায্য সংস্থাগুলো হাসপাতালের কর্মচারী এবং শিক্ষকদের বেতন দেয়ার জন্য তাদের তহবিল পৌঁছানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে অথবা এমনকি মেটার্নিটি ওয়ার্ডের জন্য রান্নার কাঠ বা লাকড়ি সরবরাহ অথবা ওষুধ কেনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তালেবানদের মানবাধিকার রেকর্ড, সুনির্দিষ্টভাবে নারী ও জাতিগোষ্ঠীগত সংখ্যালঘুদের বিষয়টি বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তালেবান সরকারকে বৈধতা দিতে অনিচ্ছুক এবং তারা এ কারণে আফগান রাষ্ট্রটিকে তহবিল দেয়ার ব্যাপারেও নেতিবাচক মনোবৃত্তি পোষণ করছে। কেউ তালেবান সরকারকে তহবিল দিতে চাচ্ছে না। নিষেধাজ্ঞা প্রদানের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো আফগানিস্তানে তহবিল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে দেশটির বেসামরিক লোকদের ‘হত্যা’ করছে। তালেবান, খোরাসান প্রদেশের ইসলামিক স্টেট, যুদ্ধবাজরা, সাবেক সরকারগুলো এবং আন্তর্জাতিক সামরিক বাহিনীগুলো আফগানিস্তানে সম্মিলিতভাবে গত ২০ বছরে যত লোককে হত্যা করেছে ব্যাংকব্যবস্থা অচল এবং সহায়তা তহবিল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে তার চেয়েও অনেক বেশি লোককে হত্যা করা হচ্ছে।
আফগান জনগণকে গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা দিতে অস্বীকৃতি জানানো এবং খাদ্য ছাড়াই পরিত্যাগ করা উচিত হবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেখতে পাচ্ছে, অর্থনৈতিক দুঃখকষ্টজনিত মৃত্যুই হচ্ছে তালেবান সরকারের ওপর প্রভাব খাটানোর একমাত্র উপায়। তাই তালেবান সরকারের কর্মকাণ্ডের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বেসামরিক লোকদের কার্যকরভাবে শাস্তি দিতে যাচ্ছে; অথচ এই সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়ার ব্যাপারে তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। তালেবান সরকারের অধীনে আমরা সম্ভবত দেখতে পাবো- নারীদের বৈষম্যের বিষয়টিকে প্রাতিষ্ঠানিকরূপে দেখা হচ্ছে। কিন্তু এই বৈষম্যের সাথে অর্থনেতিক অচলাবস্থার তুলনা করলে নারী বৈষম্যের বিষয়টি গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। কারণ অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিলে তাদের স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার বিষয়টি ঝুঁকিতে পড়বে- সেটা কয়েক দশক ধরে একটি ভালো অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছিল। মানবিক বিপর্যয় আমরা কেবল শুরু হতে দেখছি- যেটা আফগানিস্তানের আগামী প্রজন্মকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সুইডিশ কমিটির সাথে এক কথোপকথনে নারী অধিকার উপদেষ্টা জামিলা আফগানি বলেছেন, ‘ক্ষুধার্ত রেখে আমরা আফগান নারীদের সমর্থন দিচ্ছি না।’
দেশের মাটিতে লাখ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছে আমরা ইউরোপীয় এনজিওদের প্রতিনিধিত্ব করছি। সম্প্রতি বিভিন্ন সরকার আফগানিস্তানে মানবিক সমর্থন দেয়ার ব্যাপারে যে প্রতিশ্রতি দিয়েছে তাকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু জাতিসঙ্ঘ সংস্থাসমূহ, এনজিওগুলো এবং আফগানিস্তানের মানুষ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় প্রবেশ করতে না পারলে এসব প্রতিশ্রুতি কোনো কাজে আসবে না।
নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে গবেষণা করে দেখা গেছে, বেসামরিক লোকেরাই এতে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অপর দিকে বাস্তবে রাজনৈতিক এলিটদের জীবনযাত্রার ওপর এর কোনো প্রভাব পড়ছে না। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদকে সাথে নিয়ে অবিলম্বে অবশ্যই নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি পর্যালোচনা করে মানুষের দুঃখকষ্ট ও দুর্দশা লাঘবে নগদ অর্থের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ২০ বছর আগে শান্তি, সমৃদ্ধি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আফগান জনগণকে সমর্থন দেয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এখন ক্ষুধা ও মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া আফগানদের রক্ষা করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব।
লেখক : অ্যানড্রিয়াস স্টিফানসন : সেক্রেটারি জেনারেল অব দ্য সুইডিশ কমিটি ফর আফগানিস্তান
এলিজাবেথ উইন্টার : আফগানিস্তানে ব্রিটিশ ও আইরিশ এজেন্সিগুলোর নির্বাহী পরিচালক
লিভ কেজোলসেথ : নরওয়েজিয়ান আফগানিস্তান কমিটির সেক্রেটারি জেনারেল
জেসিকা হ্যাজেলউড : অ্যাক্সেস টু জাস্টিস এক্সপার্ট
আলজাজিরার সৌজন্যে; ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার