Site icon The Bangladesh Chronicle

মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি খোলা চিঠি – বিষয়: ছাত্র-জনতার প্রতি অঙ্গীকার সমুন্নত রাখা

Interim government’s chief adviser Dr Muhammad Yunus

 

মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা,

 

জাতির এক ঐতিহাসিক ক্রান্তিলগ্নে এবং জনগণের আশা আকাঙ্খার মহা সন্ধিক্ষণে আপনি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। দেশের জনগণের জন্য এটা অতীব সৌভাগ্য ও গৌরবের বিষয় যে তারা আপনার মত একজন দেশের সুযোগ্য সন্তান ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যাক্তিকে এই মহান ও পবিত্র দায়িত্বে পেয়েছে।

 

দায়িত্ব গ্রহণের শুরু থেকেই আপনি অঙ্গীকার করে এসেছেন যে ছাত্র-জনতা আপনাকে যে বিশ্বাসে দায়িত্ব অর্পণ করেছে তা থেকে আপনি পিছপা হবেন না। বিগত মাসগুলোতে আপনি নিরলস ভাবে তা সম্পন্ন করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং প্রশাসনের অন্যান্য উচ্চ ব্যাক্তিবর্গ বিভিন্ন সময়ে জনসমক্ষে জোর দিয়ে তা প্রতিফলন  করে ব্যক্ত করেছেন যে আপনার সরকার ক্ষমতা নয়, তিনটি প্রধান দায়িত্ব পালনে অঙ্গীকারবদ্ধঃ যথা খুনি-লুটেরা ও অত্যাচারীদের বিচার, অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার এবং সর্বশেষে একটি সুষ্ঠ নির্বাচন। অর্থাৎ, প্রথম কাজ দুটি সম্পন্ন হলেই তৃতীয় কাজটি করা সম্ভব।

 

দেশের সার্বিক পরিস্থিতি, যথা উন্নত আইনশৃঙ্খলা, তরান্বিত গণমুখী বিচারিক প্রক্রিয়া, অবাধ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা, লুন্ঠিত সম্পদ উদ্ধারের প্রচেষ্টা,  এসবে সরকারের  সফলতা দৃশ্যমান। বহু রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, যার মধ্যে দেশের বরেণ্য নেতা-নেত্রী রয়েছেন, বেআইনী শৃঙ্খল, এমনকি মৃত্যুর ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে, আজ মুক্ত। আপনার আন্তর্জাতিক প্রতিভার ছোয়াঁয় দেশ বিদেশে বাংলাদেশের মানসম্মান উন্নত, ব্যবসা-বাণিজ্য, সাহায্য-সহযোগিতার বিশাল সম্ভাবনা দৃশ্যমান। সর্বোপরি, বিগত দেড়-দুই যুগের স্বৈরাচারী যাঁতাকলের পিশন থেকে জাতি আজ মুক্ত।

 

তবে আমরা পুরোপুরি সংকটমুক্ত নই। কিছু দেশীয় ও বিদেশী শক্তি, দৃশ্যত পরাজিত অপশক্তির প্রভাবে, আপনার প্রশাসনের এই প্রয়াসকে বিনষ্ট, বিঘ্নিত বা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অহরহ চেষ্টা চালাচ্ছে। এ বিষয়ে কয়েকটি দিক উল্লেখ করতে চাই:

 

প্রথম, জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের আত্মত্যাগ ও অর্জনকে অস্বীকার করার প্রবণতা। বার বার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও বিপ্লবের সনদ এখনও ঘোষিত হতে পারছেনা, আপনার প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও। বিগত আওয়ামী আমলের অত্যাচার, অবিচার, গুম খুন, লুটতরাজ ও সর্বাত্মক স্বৈরাচারী যাঁতাকলের পিশন থেকে মুক্তকারী এই বিপ্লবকে অগ্রাহ্য-অস্বীকার করা জাতির সাথে বেঈমানির  সামিল। খুশির খবর শুনা যায় যে আগামী ৫ ই আগস্টের মধ্যে তা ঘোষিত হবে। আলহামদুলিল্লাহ!

 

দ্বিতীয়পরাজিত ফ্যাসিবাদী শক্তির অনেক প্রভাবশালী দোসর এখনও রাজনীতিতে, প্রশাসনে, সামরিক ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিদ্যমান। তারা প্রতিনিয়ত পতিত অপশক্তির পক্ষে নীরবে অথবা প্রকাশ্যে কারসাজি করে যাচ্ছে। নমুনার অভাব নাই, প্রথম দিন থেকেই যা দৃশ্যমান। এসব চিহ্নিত অপশক্তির দোসরদের নির্মূল না করা পর্যন্ত দেশ নিরাপদ নয় এবং তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পদে পদে বাধাগ্রস্ত হবে ও হচ্ছে । এক্ষেত্রে কোনরূপ ছাড় বা নমনীয়তা প্রদর্শন বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

 

তৃতীয়, প্রয়োজনীয় সর্বজনীন সংস্কার। বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিগত আওয়ামী আমলে—মুজিব থেকে হাসিনা পর্যন্ত—ব্যাক্তি, পারিবারিক ও দলীয় স্বার্থে নিয়োজিত অপশাসনের ফলে প্রশাসন ও সমাজের সকল স্তরে-রন্ধ্রে যে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির জঞ্জাল সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করা শুধু কঠিনই নয়, সময় সাপেক্ষও বটে। তবুও আপনার সুযোগ্য প্রশাসন তা দূরীকরণের বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এখনও অনেক বাকি। পদে পদে আসছে বিরোধী শক্তিদের বিভিন্নরূপী বাধা-বিপত্তি। এক্ষেত্রেও দেশ ও দশের স্বার্থে কোনপ্রকার ছাড় দেয়া শুধু যে অনুচিত হবে তা নয় বরং সামান্যতম গাফলতি জাতির জন্য হতে পারে আত্মঘাতী। প্রয়োজনীয় সংস্কার অতি সত্বর করণীয়, এবং এতে “চলমান প্রক্রিয়া”র ছলে কোনোরূপ বিলম্বিত বা বিঘ্নিত হবার অবকাশ নাই।

 

চতুর্থ, খুনি-লুটেরাদের বিচারকার্য সম্পন্ন করা। দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিন থেকেই আপনি জাতিকে বার বার স্মরণ করে দিয়ে এসেছেন যে খুনিদের বিচার নিশ্চিত করবেন। স্বস্তির বিষয় যে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অনুমেয় যে প্রয়োজনীয় জনবল, যেমন অভিজ্ঞ তদন্তকারী কর্মকর্তা, সরকারী আইনজ্ঞ (প্রসিকিউটর), বিচারকদের অভাবে বিচারিক কার্যক্রম যেই গতিতে চলার দরকার তা হচ্ছে না। এই কার্যক্রম ত্বরান্বিত না করলে আপিল সংক্রান্ত প্রক্রিয়া শেষ করে বিচারে রায় কার্যকর করতে মাস-বছর লেগে যাবে। মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের আগে বিচারকার্য এবং রায় কার্যকর না হলে, পরবর্তী কালে তা এগিয়ে নেবার তাগিদ নাও থাকতে পারে, এমনকি যাত্রার চাকা/গতি উল্টোদিকে চালিত হতে পারে, যা হবে জাতির জন্য কলঙ্ক এবং মহা বিপর্যয়। তাতে কষ্টার্জিত মূল্যবান অর্জন বিলীন তো হবেই, জাতি অতীত পরিস্থিতি, অর্থাৎ স্বৈরাচার, অরাজকতা, দুর্নীতি ও খুন-খারাবিতে ফিরে যাবার সংশয় থাকবে।

 

অর্থাৎ, অবশ্যকরণীয় সংস্কার ও বিচার অসম্পন্ন রেখে গেলে তা জাতির কাছে হবে মহা  হতাশাব্যঞ্জক, এমনকি প্রতারণার সামিল। আগামী নির্বাচন যত সুষ্ঠই হোক না কেন, এই প্রবঞ্চনা জাতিকে পীড়া দিতে থাকবে এবং জাতি তা কোনদিন ক্ষমার চোখে দেখবে না।

 

সম্মানীয় প্রধান উপদেষ্টা, আপনি ছাত্র-জনতা, তথা জাতির কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, কোন দল বা বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে নয়। “জাতীয় ঐক্যমত” ভাল কথা, কিন্তু সেই ঐক্যমত কোন দল বা শ্রেণীর চাপিয়ে দেয়া শর্ত হতে পারে না। দেশ ও জাতির জন্য কোন পদক্ষেপ সঠিক তা আপনার চেয়ে ভালো কেউ বুঝতে পারে বলে আমি মনে করি না। তাই, যেমন পশ্চিমা প্রবাদে বলে: কুকুর ঘেউ ঘেউ করুক, কাফেলা চলতে থাকবে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে (Let the dogs bark, the caravan must proceed (to its destination.)।

 

মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, দেশের ভাল ও জনগণের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে আপনি কাজ করে আসছেন, করে যান । স্বার্থান্বেষী মহলের বাক-বিতণ্ডা বা বিরোধিতায় কান দেবার প্রয়োজন নাই। সরকার প্রধান হিসাবে জনস্বার্থই আপনার প্রধান উদ্দেশ্য। জনস্বার্থে, জনকল্যাণে কাজ করলে বিরোধী ও নিন্দুকদের মুখে ছাই পড়বে, তারা জনরোষে পড়বে। দেশের জনগণ চায় আপনি আপনার কাজ অসমাপ্ত রেখে যাবেন না, সেই কাজ সমাধা করতে যত সময়ই লাগুক। বস্তুতঃ জনতার দাবি, আপনি যতদিন সক্ষম, দেশ পরিচালনায় নিয়োজিত থাকুন। জনগণ আপনার পেছনে আছে।

 

আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন !

আল্লাহ আমাদের সহায় হোন!

 

সশ্রদ্ধ সালাম সহকারে,

রাশেদ চৌধুরী

একজন সামান্য দেশপ্রেমী নাগরিক

 

 

 

 

 

Exit mobile version