মাতৃভাষার পক্ষ নিলে তা জাতিবাদ নয়
গত শুক্রবার ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। প্রত্যেক জনগোষ্ঠীই নিজ উন্মেষ ও বিকাশের জন্য নিজ মাতৃভাষা চর্চার অধিকার রক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে অনুভব করে। একুশে ফেব্রুয়ারি হলো আমাদের মাতৃভাষা চর্চার অধিকার রক্ষার প্রশ্নে এক স্মরণীয় দিন। উনিশ শ’ সাতচল্লিশ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্ম নেয়ার শুরুর কাল থেকেই হবু পাকিস্তানে মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের দিক থেকে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। বুঝে না বুঝে এতে পুবের ভাগ্য যে পশ্চিমের আধিপত্যের তলায় চাপা পড়ে যাবে সেটি আমল করার অনীহা দেখা দিতে শুরু হয়। আর তা থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম বেসুরো হতে শুরু হয়েছিল। এই প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে আমাদের মাতৃভাষা চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে টের পেয়ে আমাদের আপত্তি প্রতিবাদ লড়াইয়ের শুরু এখান থেকেই। আর এখান থেকেই আস্তে আস্তে এক ভাষাভিত্তিক জাতিবাদের দিকে চলে যাই আমরা।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে পালন ও স্মরণ করতে আমাদের দেশের সব ধরনের রাজনৈতিক ধারাকেই কম-বেশি এগিয়ে আসতে দেখা যায়। তবু কোথাও একটা ভাগ বজায় রয়েই যায়। যদিও সব পক্ষ বা ধারার মধ্যে কমন দিকটা দেখা যায় তা হলো- যেকোনো জনগোষ্ঠীরই মাতৃভাষা চর্চার ‘অধিকার’ সমুন্নত রাখতে হবে। অন্য দিকে একুশে ফেব্রুয়ারিকে পালন ও স্মরণ অন্য আর ধারাটা হলো, ভাষাভিত্তিক জাতিবাদের দিক থেকে একুশে ফেব্রুয়ারিকে তুলে ধরা।
কারো মাতৃভাষা চর্চার অধিকারকে বাধা দেয়া বা রুদ্ধ করা হয়ে যায়- এটা করে কারা? আসলে শেষ বিচারে পুরা ব্যাপারটাই হয়ে দাঁড়ায় জাতিবাদী রাষ্ট্রচিন্তার সমস্যাজাত। অর্থাৎ জাতিরাষ্ট্র যাকে অনেক আমরা ‘নেশন-স্টেট’ বলে বুঝি- এই বুঝ থেকে উদ্ভুত সমস্যা।
নেশন বা জাতি ধারণার সবচেয়ে ক্ষতিকর দিকটা হলো এটা অপর জনগোষ্ঠীর ওপর নিজ আধিপত্য বিস্তার ও কায়েমের হাতিয়ার হয়ে যায়। এই আধিপত্য কায়েমের বড় ও প্রবল ধারণাটাই হলো কারো ঘাড়ে উপনিবেশি-কর্তা হয়ে চড়ে বসা অথবা নিজের ঘাড়ে কারো উপনিবেশত্ব কায়েম হতে দেখা।
আধুনিক রাষ্ট্রের জন্ম এই ফেনোমেনা দুনিয়ায় এসেছিল মোটাদাগে বললে ১৬৫০ সালের দিকে। আধুনিক রাষ্ট্রমানে মডার্ন রিপাবলিক রাষ্ট্রের কথা বলছি। অর্থাৎ মনার্কি বা রাজতন্ত্রের শাসনের কবল থেকে বের হতে গিয়ে যে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা শাসনব্যবস্থা দুনিয়ায় কায়েম হতে শুরু করেছিল। রাজতন্ত্রের সবচেয়ে বড় অগ্রহণযোগ্য দিক হলো- রাজতন্ত্র বলতে পারে না কে তাকে ক্ষমতা দিয়েছে বা তার ক্ষমতার উৎস কী?
যদি মেনে নেই যে রাজতন্ত্রে শাসন ক্ষমতার উৎস ‘গায়ের জোর’ মানে, রাজার নিজের বলপ্রয়োগের সক্ষমতাই রাজার ক্ষমতার উৎস, সে ক্ষেত্রে এর অর্থ হবে তাহলে রাজাও অন্য কারো যে রাজার ওপর বলপ্রয়োগে সক্ষমতা রাখে তার হাতে ক্ষমতাচ্যুত হবে ও মারা পড়বে এবং এ কথাটাও গ্রহণযোগ্য হয়ে যাবে এবং এটা জায়েজ তা মানতে হয়। অর্থাৎ এখানে এসে ক্ষমতাকে ন্যায়-অন্যায় বা ইনসাফের প্রশ্ন মোকাবেলায় বসতে হবে। এই পরিস্থিতি সামলাতে সেকালে উপায় না দেখে রাজা ক্ষমতার ন্যায়-অন্যায় ভিত্তি করতে চায় জনসমর্থনকে। যেন যে রাজার পক্ষে জনসমর্থন আছে তার সেই ক্ষমতাটা জায়েজ মনে করা হবে। আর এখান থেকে ইংরাজি করোনেশন বা বাংলায় ক্ষমতার অভিষেক বা পাবলিক অনুমোদন এর ধারণা হাজির হয়েছিল।
কিন্তু সেখান থেকে আরো বিস্তারে নতুন প্রশ্ন উঠেছিল যে, যদি গণসমর্থনই ক্ষমতার ন্যায্যতার ভিত্তি হয়ে থাকে তাহলে কে রাজা হবে বা কার শাসন-ক্ষমতাকে মেনে নেয়া হবে, অনুমোদিত হবে সেটা ‘পাবলিকই’ ঠিক করে দিক। আর এখান থেকেই রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস জনগণ। জনগণ সব ক্ষমতার উৎস এবং জনগণই সেই ক্ষমতা ডেলিগেট করে বা সাময়িক হস্তান্তরিত করে শাসক নির্বাচন করে দেবে- এসব ধারণা বিস্তার লাভ করা শুরু হয়েছিল; কিন্তু সেটি আরো কিভাবে? না, রিপ্রেজেন্টেশন বা জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে নির্বাচিতের হাতে সাময়িকভাবে (পরের নির্বাচন পর্যন্ত) তার হাতে ক্ষমতা তুলে দেবে এসব দিকে ধারণা বিস্তার লাভ করেছিল। এই হলো ক্ষমতার ন্যায়-অন্যায় ইনসাফের কার্যকারিতা দিয়ে পাওয়া ক্ষমতার বৈধতার সমাধান। এক কথায় এটাই রিপাবলিক রাষ্ট্রক্ষমতা, বাংলায় গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র ও এর ক্ষমতা ধারণা। ফলে স্বভাবতই এখানে রাষ্ট্রক্ষমতার আর কোনো চোরা-ক্ষমতা নয়, বরং এক সুবিন্যস্ত ও ডিফাইনড ক্ষমতা। তবে এই অভিজ্ঞতাগুলো মূলত ইউরোপের ভূখণ্ডের বা পরবর্তিতে তা ফেডারেল রিপাবলিক আমেরিকারও। আর তা থেকে দুনিয়াব্যাপী ব্যাপক রাষ্ট্ররূপগুলোতে এটাই কম-বেশি অনুসরণ করে। যেমন নয়া চীনে এসে, চীনের ভাষায় এটা ‘পিউপিলস রিপাবলিক’। এমনকি লেনিনের রাশিয়া নিজেদের ভিন্ন দাবি করলেও সোভিয়েত রাষ্ট্র নিজেকে এক ‘রিপাবলিক’ রাষ্ট্র বলেই মেনেছে।
কিন্তু তবু সব সমস্যা মিটে নাই। রিপাবলিক রাষ্ট্রের সাধারণ রেওয়াজ ও রিচুয়াল দাঁড়িয়ে গিয়েছিল যে নির্বাচনের দিন থেকে শপথের দিন পর্যন্ত চলে থাকে গণক্ষমতা তৈরির প্রক্রিয়া। এই লক্ষ্যে প্রতিনিধি নির্বাচন ও সাময়িক ক্ষমতা হস্তাস্তর সম্পন্ন করে ক্ষমতার অভিষেক ঘটিয়ে নেয়া অবধি- এই সময়কালটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু খেয়াল করেন আমরা এখন দাঁড়িয়ে গেছি নির্বাচনেরও আগের ‘এক নিশীথে’। আর চার দিকে হা-হুতাশে।
রাজতন্ত্র ভেঙে রিপাবলিক বা গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র ও ক্ষমতা তৈরির রেওয়াজ দুনিয়ায় মোটাদাগে চালু হতে দেখা গেছিল ১৬৫০ সালের দিকে; কিন্তু তাতে এর পরেও বড় বিপথগামিতা ঘটেছে দেখা যায়। মানে চোরাবালিতে পা আটকে যাওয়া বা ভুল রাস্তায় চলে যাওয়া আছে আমরা দেখি। আর এরই নাম হলো নেশন-স্টেট বা জাতিরাষ্ট্র ধারণা। মূলত ‘জাতি’ ধারণাটাই সমস্যার আর এটা এক নষ্টা ধারণা হিসেবে তা হাজির হয়েছিল। রিপাবলিক রাষ্ট্র ও ক্ষমতা ধারণার প্রতিশ্রুতি ছিল বা হওয়ার কথা ছিল যে জনগণের সব অংশকেই অন্তর্ভুক্ত করে এখানে এক ‘পলিটিক্যাল’ কমিউনিটি নির্মাণ করা হবে। এটাই হবে রিপাবলিক রাষ্ট্র গঠন। কিন্তু এটা বিপথে চলে যায়। গিয়ে হয়ে যায় জাতি নির্মাণ বা ‘জাতি গঠন’। আর এতে ‘রাজনৈতিক কমিউনিটি’ এভাবে রাষ্ট্র গঠনের ধারণাটাই হারিয়ে যায়।
খেয়াল রাখা দরকার ইউরোপে যখন রিপাবলিক রাষ্ট্র ও ক্ষমতা ধারণা বাস্তবায়নের নানা উদ্যোগ কসরত চলছে- সেটি একই সাথে দুনিয়াতে ব্যাপকভাবে ‘কলোনি দখলের’ শুরুও সে কালটা। এটা আরো সম্ভব হয়েছিল সূক্ষ্মমাত্রার স্টিলের আবিষ্কার ও ব্যবহার আর সাথে বারুদ অস্ত্র কম্পাস এসব মিলিয়ে বড় যুদ্ধজাহাজ তৈরিতে বিনিয়োগ করার সুযোগ আসা থেকে। প্রধান বিনিয়োগের আকর্ষণ হয়ে উঠেছিল যুদ্ধজাহাজ ব্যবসা। যুদ্ধজাহাজ মানে পাল তুলে বেরিয়ে পড়া কলোনি দখল ও লুটের কাজে। যার এক মডেল ধরন হলো এক ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ গড়ে নেয়া। তবে ব্যাপারটা শুধু জাহাজ-বিজ্ঞানের উন্নতি বা বিনিয়োগ ব্যবসার স্বর্ণযুগের নয় বা শুধু তা দিয়ে ঘটেনি। এর সাথেই সবচেয়ে নির্ধারক ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল এক ভাবাদর্শ বা আইডিয়া। সেটি হলো ‘জাতি’ ধারণা- এর যোগ ঘটা। ব্যাপারটা ইউরোপের যার যার দেশ-রাষ্ট্রের ব্যক্তিমালিক কোম্পানির জাহাজে বিনিয়োগের ব্যবসা হিসেবে তা সে ব্রিটিশ, ফরাসি বা ডাচরা নিজের একেকটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খুলে এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোকে কলোনি দখলে ঝাঁপিয়ে পড়া ধরনের হতে পারত। হ্যাঁ, তাই ঘটতে পারত, ঘটেছিলও। কিন্তু সাথে আরো কিছু ছিল- তা হলো কলোনি দখলে প্রতিযোগিতা। একে অপরের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া। কোম্পানিগুলো নিজস্ব একান্ত স্বার্থ আর লাভালাভের এই প্রতিযোগিতাকে যেন নিজেদের নিজ নিজ দেশ ও রাষ্ট্রের স্বার্থ হিসেবে মিথ্যা হলেও তা দেখাতে সক্ষম হয়েছিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলোনি দখল প্রতিযোগিতায় ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চেয়ে কয়টা বেশি দখল সম্পন্ন করতে পেরেছে- যেন এটা হয়ে যায় কোম্পানিওগুলোর একান্ত বিনিয়োগ স্বার্থ নয়, তা নিজ নিজ রাষ্ট্রের স্বার্থ- এই মিথ্যা বয়ান ও তা উপস্থাপন দিয়ে সব কিছু বদলে দেয়া হয়েছিল। আর তা করা গিয়েছিল এক ‘জাতি’ ধারণা দিয়ে, দেশ-রাষ্ট্রকে একটা জাতিরাষ্ট্র যেমন,তা এটা ‘জাতীয় স্বার্থ’ এ ধরনের বুলি দিয়ে। এভাবে কোম্পানির স্বার্থ হয়ে যায় কথিত ‘জাতীয় স্বার্থ’। এতে অন্যের দেশকে কলোনি দখলের কাজ এটা যেন আর কোম্পানিগুলোর স্বার্থ নয়- ব্রিটিশ বা ডাচ ‘জাতীয় স্বার্থ’ হয়ে উঠেছিল।
আর তা থেকেই কলোনি দখল আর কোনো ‘অন্যায়’ বা অপরাধ কাজ নয় বরং ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তামাশার দিকটা হলো, দেশের অভ্যন্তরে যে রাষ্ট্র নিজের জন্য একটা রিপাবলিক রাষ্ট্র গড়াকে নিজের কাজকর্তব্য মনে করে, নিজ দেশের বাইরে সেই রাষ্ট্রই আবার অন্য দেশ-রাষ্ট্রকে কলোনি দখল করে নেয়াকে জায়েজ মনে করেছিল কিভাবে? এর জবাব কারো কাছে ছিল না। তবে এখান থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যেন নিজেরা একেকটা জাতি, আর তাদের ‘জাতীয় স্বার্থ’ হলো অন্য দেশ-রাষ্ট্রকে কলোনি দখল করে নেয়া। এটা জায়েজ মনে করা হতে থাকে কারণ নষ্টা জাতিরাষ্ট্রের ধারণা থেকে উপজাত প্রবল ‘জাত শ্রেষ্ঠত্বের’ ধারণা। [আজকের দিনে যা আবার সাদা শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা হয়ে আবার হাজির হতে দেখা যাচ্ছে] ব্রিটিশরা ফরাসি বা ডাচদের চেয়ে ‘জাতশ্রেষ্ঠ’ শুধু তাই নয় বরং, যেসব অন্য মহাদেশের রাষ্ট্র এরা কলোনি-দখল করছে এমন সবকিছুর পক্ষে সাফাইয়ে সার কত্থাটা হলো জাতিবাদ, জাত শ্রেষ্ঠত্ব অথবা যেমন ব্রিটিশ জাতিরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠত্বের গর্ব।
অথচ জাতি বা জাতি গঠন ধারণার সাথে মূল রিপাবলিক রাষ্ট্র গড়ার ধারণার কোনোই মিল নেই। এক কথা কখনো নয়, ছিল না। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছিল যেমন ব্রিটেনের বেলায়- ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজের ব্যক্তিস্বার্থটাকে কল্পিত এক ‘ব্রিটিশ জাতির’ স্বার্থ বা জাতিরাষ্ট্র স্বার্থ বলে বয়ান তৈরি করে হাজির করেছিল। আর এটাকেই যেন এক ব্রিটিশ রিপাবলিক রাষ্ট্র ও এর স্বার্থ বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছিল।
তাই ‘জাতি’ ‘জাতি গঠন’ শব্দটাই আসলে কলোনি দখল, অন্য জনগোষ্ঠীর ওপর আধিপত্য বিস্তার এ ধরনের কাজ সমার্থক হয়ে উঠেছিল। আর এভাবেই ব্রিটিশদের সেকালের ইন্ডিয়াকে কলোনি-দখল যেন ব্রিটিশ জাতিরাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে একটা কাজ! এভাবে পুরা ইউরোপই রাষ্ট্র গঠনকে কথিত ‘জাতি গঠন’ বুঝেই করে গিয়েছিল; কিন্তু কত দিন?
প্রায় তিনশ বছর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাল পর্যন্ত। কিন্তু এর পরেও হুঁশ এসেছিল কি? হ্যাঁ, অবশ্যই কিন্তু বিশাল খেসারত দেয়ার পরে। জর্মান হিটলারের আগমন ও উত্থান ঘটেছিল সেই খেসারত হিসেবে।
কলোনি দখল যদি জায়েজ হয়, প্রতিদ্বন্দ্বী ইউরোপেরই আরেক রাষ্ট্রের হাত থেকে তার দখলে থাকা কলোনি কেড়ে নেয়া যদি জায়েজ হয়; নিজ জাতিরাষ্ট্রের জাতশ্রেষ্ঠত্ব দেখানো আর বড়াই করা যদি সব আকামের সাফাই হয় তাহলে, হিটলারের জার্মানিরও আরো চরম জাতশ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়ে ইউরোপের ব্রিটেন, ফ্রেঞ্চ দেশ-রাষ্ট্রসহ সবার কলোনিগুলা পাল্টা দখল করে নিলে সেটা নাজায়েজ হবে কেন? এভাবে ইউরোপের সব জাতিরাষ্ট্রই হিটলারের তাণ্ডবের ভেতর নিজ জাতশ্রেষ্ঠ বোধের পরিণতি দেখেছিল। এটাই জাতিবাদের পরিণতি, সবার প্রতিচ্ছবি- দ্বিতীয় বিশযুদ্ধের গ্রেটেস্ট তাৎপর্য। ‘জাতিরাষ্ট্র’ চিন্তার চরম পরিণতি ইউরোপের সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছিল।
তবে এতটুকুই না এর সাথে ভূমিকা রেখেছিল আমেরিকান সামরিক-অর্থনৈতিক সাহায্য পাবার শর্ত যে, কলোনি-দখলের দিন শেষ করতে হবে। এটা নাজায়েজ ও অপরাধ। নাগরিক অধিকারের ওপর দাঁড়াতে হবে। সার্বজনীন মানবাধিকার মানবার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। ইত্যাদি। ইউরোপ নিজেকে ব্যাপকভাবে বদলে নিয়েছিল।
কিন্তু তা সত্ত্বেও আরেক অদ্ভুত ঘটনা হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকা এই মহাদেশগুলোর ট্রেন্ড হলো কলোনিমুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়া তবে সেগুলা বাস্তবে এরা বুঝে না বুঝে নিজেদের জাতিরাষ্ট্র বা নেশন স্টেট বলেই ডাকত ও বুঝত। অর্থাৎ এক দিক থেকে দেখলে সে যুগের অভিমুখ ছিল কলোনি মুক্তির হলেও আর এক দিক থেকে দেখলে সেযুগের অভিমুখ এই তিন মহাদেশে ছিল ‘জাতিরাষ্ট্র’ গড়ার। অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্রের বুঝ তাদের আসেনি। এলোই না।
আর এর সবচেয়ে খারাপ উদাহরণ হিসেবে হাজির হয়েছিল নেহরু-গান্ধীর ভারত। যেমন কাশ্মির ইস্যুতে, কাশ্মির কে শাসন করবে এর একমাত্র নির্ধারক হবে কাশ্মিরের বাসিন্দারা। কোনো রাজা নয়, রাজ যদি কাউকে কাশ্মির দিয়েও দেয় সে রাষ্ট্রও নয়। এই হলো বিশ্বযুদ্ধের পরের দুনিয়ার নতুন নীতি। যে নীতি অনুসরণ করার প্রতিশ্রুতি পালন করতে গিয়ে ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে গিয়েছিল, নেহরু-গান্ধী একটা স্বাধীন ভারত পেয়েছিল। অথচ নেহরু আজীবন ছিল এ সম্পর্কে বেখবর।
অন্য বড় বিপর্যয়টা হলো রাষ্ট্র বলতেই তা ‘জাতিরাষ্ট্র’ বলে বোঝা। বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপের জাতিরাষ্ট্র ধারণা কী পরিণতি হলো, তাদের মধ্যে কী বদল এলো এ নিয়ে নেহরু-গান্ধীর হুঁশ বা বুঝাবুঝি শূন্য থেকে যায়। তাই ভারত হয় একটা জাতিরাষ্ট্র। অথচ এর একটা চেন-রিঅ্যাকশন আছে।
নেহরু-গান্ধীর তথা পুরা কংগ্রেসেরই রাষ্ট্র বলতেই জাতিরাষ্ট্র বুঝার সমস্যা হলো তারা আসলে একটা হিন্দু-জাতিরাষ্ট্রের কল্পনা করছেন বা এমন ধারণার লালন ও অনুসারি হচ্ছেন। এটা গ্রহণে মুসলমানদের অস্বস্তি হবে সেটিই স্বাভাবিক। এতে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে নাগরিক বৈষম্য তৈরি হবে- এই হলো সারকথা। এরই সোজা মানে হলো মুসলমানদের আলাদা রাষ্ট্র গড়তে বেপরোয়া হয়ে ঠেলে দেয়া। এর পরেও ১৯২৮ সালে জিন্নাহর ‘১৪ দফা প্রস্তাব’ এই সমাধানও আমলই না করা। আর তা থেকে রাষ্ট্র বলতেই জাতিরাষ্ট্র বুঝবার ওই কালে মুসলিম-জাতিরাষ্ট্রের পাকিস্তান গড়ার দিকে পরিস্থিতি চলে যায়; কিন্তু তাতেও সমস্যার শেষ হয় না। রাষ্ট্রভাষা উর্দু করতে হবে- বলাতে পূর্ব ভীত হয়ে পড়ে বিপদ দেখতে পায় অসাম্যের যে পশ্চিমের আধিপত্যে চাপা পড়তে যাচ্ছে। ক্রমে সেই একই আবার রাষ্ট্র বলতেই জাতিরাষ্ট্র বুঝতে ভাষাভিত্তিক জাতিবাদে পৌঁছায় স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু আবার একই প্রশ্ন, একই আধিপত্য কায়েমের অভিযোগ এবার পাহাড়িদের দিক থেকে। কিন্তু তাজ্জবের ব্যাপার হলো, পাহাড়িদের চোখে এর সমাধান হলো আবার সেই রাষ্ট্র বলতেই জাতিরাষ্ট্র বুঝবার চিন্তা থেকে এক জম্মু জাতিবাদ! এটা এক লম্বা চেন-রিঅ্যাকশন। কিন্তু দুনিয়ার অভিমুখ আঁচ করা অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র চিন্তা তাদের ছুঁতে পারেনি।
এর ভিতরে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছে ‘প্রগতিশীলেরা’। কারণ তারাও মূলত জাতিরাষ্ট্রবাদী। আর এরা আবার জাতি বলতে সেটা আবার ছুপা হিন্দু-জাতি বুঝ।
এর আদর্শ প্রমাণ রামমোহন রায় ও তার নতুন করে এক ব্রাহ্মধর্ম চালু করার প্রচেষ্টা। অথচ এ নিয়ে আজ পর্যন্ত ‘প্রগতিশীলরা’ এতে কিছু আপত্তিকর দেখেনি।
এ দিকে ব্রাহ্ম প্রকল্প ফেল করাতে এই ব্যর্থতাই আবার সাফাই হিসেবে হাজির হয় যে জাতি বলতে হিন্দু-জাতি বুঝা আর তা থেকে এবার সবাই মিলে হিন্দু-জাতিরাষ্ট্রের ধারণার অনুসারী হয়ে যান। আর এমনটা তারা এতই অবলীলায় হয়ে যান যে জাতি বলতে যে তারা এক্সক্লুসিভ হিন্দু-জাতি বলে বুঝতেছেন এটাও আর অনুভব করেন না। তাই কোনো জিন্নাহ বা কোনো মুসলমান প্রশ্ন বা আপত্তি তুললে তাকেই ‘সাম্প্রদায়িক লোক’ অথবা ‘ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র চাওয়া লোক’ ইত্যাদি ট্যাগ লাগিয়ে ঘৃণাবিদ্বেষ ছড়ানো শুরু করেন তারা। তাদের প্রগতিশীলতার শুরু এখান থেকে। অথচ বাস্তবতা হলো, সমস্যাটা রাষ্ট্র বলতে তা একমাত্র জাতিরাষ্ট্র বলে বুঝা থেকে শুরু।
আর একালের শিক্ষা হলো, সব জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা চর্চাকে তার মৌলিক অধিকার বলে মানতে হবে; কিন্তু এরপর এ থেকে জাতিরাষ্ট্র চিন্তার অনুসারী হওয়ার পথে যাওয়া যাবে না।
জাতিরাষ্ট্র এই চিন্তা বা ধারণাটাই আমাদের পরিত্যাগ করতে হবে। অধিকারভিত্তিক এক পরিচয়, সবাই নাগরিক এমন রাষ্ট্র গড়তে হবে। আর সেই সাথে তা হতে হবে- সবাই একই পরিচয় নাগরিক এবং বৈষম্যহীন সমান নাগরিক। সাম্য, মর্যাদা আর ইনসাফের এক বাংলাদেশ রাষ্ট্র।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com