১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে হামলা, মামলা, নির্যাতনে শিকার এখন দলটির লাখো নেতাকর্মী। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি লাটে উঠেছে অনেকের। অনেকের মাথার ওপর ঝুলছে সাজার দণ্ড। একান্ত আলাপে অপেক্ষাকৃত বহু তরুণ ছাত্রনেতা চোখে মুখে অন্ধকার দেখছেন বলে জানিয়েছেন।
দ্বাদশ নির্বাচন ঘিরে গত ছয় মাসের আন্দোলনে বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নেতাকর্মীরা। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশ ভণ্ডুল হয়ে যাওয়ার পর নেতাকর্মীরা ছিলেন এক ধরনের ঘরছাড়া। গ্রেফতার এড়াতে অনেককে জঙ্গলে, ধানক্ষেতে, সবজি বাগানে রাত কাটাতে দেখা গেছে। এক রকম উদ্বাস্তু জীবন-যাপন করছেন তারা। এখনো সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। নির্বাচনের সময় বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মীর বাড়িঘরে হামলা হয়েছে। নেতাকে না পেয়ে তার ভাই, অথবা ছেলে অথবা স্ত্রীদের পর্যন্ত গ্রেফতার হতে হয়েছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলেছেন, গ্রেফতার হওয়া নেতাকর্মীদের মুক্ত করতে আইনি সহায়তা সেল গঠন করা হয়েছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মী জানিয়েছেন, মামলা পরিচালনা করার সামর্থ্যও তারা দিনদিন হারিয়ে ফেলছেন। অনেক পরিবার ইতোমধ্যে ফতুর হয়ে গেছে।
বিএনপির তথ্যানুযায়ী, গত ২৮ ও ২৯ জুলাই হতে গত সাড়ে পাঁচ মাসে মোট গ্রেফতার হয়েছেন ২৭ হাজার ৪৯৫ জন, মামলা হয়েছে ১১৮০টির অধিক। এতে আসামি করা হয়েছে এক লাখ ৫২৮১ জনকে। একই সময়ে আহত হয়েছেন ৯৭০৯ জনের অধিক নেতাকর্মী। মৃত্যুবরণ করেছেন ২৯ জন। ৮৪টি মামলায় ৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশসহ ১২৯৪ জনের অধিক নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে।
বিভিন্ন মামলায় গত তিন মাসে ১৩ শ’র বেশি নেতাকর্মীকে সাজা দিয়েছেন আদালত। সাজাপ্রাপ্তদের বেশির ভাগই এখন ফেরারি জীবন-যাপন করছেন। তাদেরকেও আত্মসমর্পণ করতে হবে আদালতে। কেউ কেউ জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে আদালতে আত্মসমর্পণ করা ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ কারাগারে যেসব সাজাপ্রাপ্ত নেতা রয়েছেন তাদের জামিন দিচ্ছেন না আদালত।
সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, আমাদের নেতাকর্মীদের আত্মবিশ্বাস আছে। তবে, আমরা গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে পারি নাই। পাকিস্তান শাসনামল থেকে শুরু করে অদ্যাবধি কোনো সরকারবিরোধী দলের ওপর এত দমন-পীড়ন চালায়নি। আর এ অত্যাচারে শুধু আওয়ামী লীগ নয়, প্রশাসনও সরাসরি সম্পৃক্ত।
তিনি বলেন, ৮৫ ভাগ মানুষ নির্বাচনে ভোট দেয় নাই। এটাই বিএনপির সার্থকতা। কর্মীদের সাহস ও অবদান আন্দোলনকে আরো গতিশীল করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
দিনাজপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বখতিয়ার আহমেদ কচি বলেন, আন্দোলনে আমরা ব্যর্থ হয়েছি এটা বলব না। বিশ্বব্যাপী তারেক রহমানের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকার শত চেষ্টা করেও বিএনপির ক্ষতি করতে পারেনি। তবে যতটুকু আশা করেছিলাম সেটা পারিনি। একটি ফ্যাসিস্ট সরকার দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে। আন্দোলনের প্রশ্নে কেন্দ্র থেকে নিশ্চয়ই একটি সিদ্ধান্ত হবে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিএনপি হতাশ নয়। সংগঠনও অনেক শক্তিশালী। সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে গণতন্ত্রকামী মানুষের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে, গুলি চালানো হচ্ছে নিরস্ত্র নেতাকর্মীদের ওপর। বিএনপি আন্দোলনকে আরো জোরদার করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অচিরেই আমরা সমমনা জোটগুলোর সাথে আলোচনা করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করব।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, একটি ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা কঠিন। সরকার যদি গণতন্ত্রমনা হতো তাহলে জনগণের দাবি মানতো। আমরা জনগণকে ভোট বর্জনের আহ্বান জানালে জনগণ আমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছে। আমাদের লক্ষ্য জনগণের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া। তিনি বলেন, সরকার বিরোধী দল দমনে বিচার বিভাগকেও ব্যবহার করছে। আওয়ামী লীগ আমাদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা না করে প্রশাসন দিয়ে আক্রমণ করেছে। দমনপীড়ন সহ্য না করেও ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। আর বিএনপি কোনো ভুল করেনি, তাই আমরা হতাশও নই।
নয়াদিগন্ত