Site icon The Bangladesh Chronicle

মধ্যরাতেও লোডশেডিং

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ

১১ অক্টোবর ২০২২, মঙ্গলবার

5

ঘড়ির কাঁটা ঠিক তখন রাত ১২টা। অফিস-আদালত পুরোপুরি বন্ধ। ছিল সরকারি ছুটিও। হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে যায়। তখন গভীর ঘুমে থাকা শিশু ফাহাদের ঘুম ভেঙে যায়। চার বছরের শিশুটির মা উপায়  না পেয়ে হাতপাখা দিয়েই কোনো রকম বাতাস করতে থাকেন শিশুটির গায়ে। এভাবেই মা- ছেলের এক ঘণ্টা কেটে যায়। ওই রাতেই ভোর পাঁচটার দিকে পুনরায় লোডশেডিং। আসে যথারীতি এক ঘণ্টা পর।  রোববার রাতে রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকার চিত্র ছিল এটি।

 শুধু হাজারীবাগ এলাকায়ই নয়, রাজধানীজুড়ে কী রাত বা কী দিন। এভাবেই যখন তখন বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে। লোডশেডিং বাড়ায় অসীম ভোগান্তিতে পড়ছেন মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিদ্যুতের সীমাহীন কষ্টের কথা তুলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। ঢাকার বাইরে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতাধীন এলাকায় আট থেকে ১০ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার কার্যদিবসে ঢাকায় লোডশেডিং ধরা হয়েছে ৫৬৫ মেগাওয়াট। যা মোট লোডশেডিংয়ের ১৩ শতাংশ (প্রাক্কলিত চাহিদার)। সারা দেশে ১০ই অক্টোবর এক হাজার ৩৯৫ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে।  সংশ্লিষ্টদের মতে, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সেক্টরে সুসংবাদের জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে ভোক্তাদের। শিগগিরই এই সংকট কাটছে না। এই পরিস্থিতিতে গ্যাস সংকট আরও বেড়েছে, কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের সময় বন্ধ হয়ে যাওয়া কয়েকটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি গ্যাস কেনা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে বেড়েছে অনিয়ন্ত্রিত লোডশেডিং।

 

পরিস্থিতি সামাল দিতে সিএনজি ফিলিং স্টেশন বন্ধ রাখার সময় আরও ২ ঘণ্টা বাড়িয়ে মোট ৭ ঘণ্টা বন্ধ রাখতে চাচ্ছে পেট্রোবাংলা।  এদিকে, গতকাল সচিবালয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেছেন, গ্যাস আনতে না পারায় নভেম্বরের আগে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতির আশা নেই। লোডের কারণে আমরা দিনের বেলা কিছু পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ রাখছি। আবার দিনে যেগুলো চালাচ্ছি সেগুলো রাতে বন্ধ রাখছি। এজন্য লোডশেডিংয়ের জায়গাটা একটু বড় হয়ে গেছে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা চেয়েছিলাম অক্টোবর থেকে কোনো লোডশেডিংই থাকবে না। কিন্তু সেটা আমরা করতে পারলাম না। কারণ আমরা গ্যাস আনতে পারিনি। সমস্যাটা সাময়িক হতে পারে। তবে আমি মনে করি, বললেই এটা সাময়িক হচ্ছে না। কারণ বিশ্ব পরিস্থিতি আবার অন্যরকম করে ফেলে। তিনি বলেন, অক্টোবর মাসটা একটু কষ্ট করতে হবে। আশা করছি, সামনের মাস থেকে আরেকটু ভালো হবে। নভেম্বর থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অক্টোবর থেকে ভালো পরিস্থিতি হয়ে যাবে বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু শিল্পে চাহিদা বেড়ে গেছে। তাই আমরা বিদ্যুতে গ্যাস কমিয়ে দিয়েছি। বিদ্যুতের ঘাটতি মোকাবিলায় গত ১৯শে জুলাই থেকে দিনে এক ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তখন থেকেই রাজধানীতে দুই থেকে চার ঘণ্টা এবং ঢাকার বাইরে ছয় থেকে আট ঘণ্টা লোডশেডিং করা হয়। তখন বলা হয়েছিল, সেপ্টেম্বরের শেষদিকে লোডশেডিং থাকবে না। অক্টোবর থেকে পুরোপুরি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের কথা বলেছিল বিদ্যুৎ বিভাগ।

উল্টো সেপ্টেম্বরের  শেষ দিক থেকে লোডশেডিং আরও বেড়ে গেছে। রাজধানী ঢাকায় ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা এবং জেলাগুলোতে ১০ ঘণ্টারও অধিক সময় বিদ্যুৎ থাকছে না।  ডিপিডিসি’র নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) আব্দুর রউফ খান মানবজমিনকে গতকাল বলেন, তাদের চাহিদা ১ হাজার ৭৫০ মেগাওয়াট। কিন্তু এখন বিদ্যুৎ পাচ্ছি ১ হাজার ১৫০ মেগাওয়াট।  ফলে দিনে-রাতে ৫০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে। উৎপাদন কম হওয়ায় সরবরাহ ঘাটতি। তাই লোডশেডিং করা ছাড়া কোনো উপায় নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন। বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন গড়ে ৯৫০ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ করছে পেট্রোবাংলা। গ্যাস দিয়ে ১১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা থাকলেও ৫০০০ মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। পরিস্থিতি সামাল দিতে বন্ধ থাকা ডিজেলচালিত (ছয়টি) কেন্দ্র দিয়ে উৎপাদন শুরু করায় খরচ বেড়ে গেছে। পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এতদিন কাতার থেকে গড়ে প্রতি মাসে পাঁচটি করে এলএনজির কার্গো আসতো। কিন্তু চলতি অক্টোবর ও আগামী নভেম্বরে আসবে চারটি করে। ফলে জাতীয় গ্রিডে ১০০ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ কমে যাবে। গ্যাস সাশ্রয়ের জন্য আরও দুই ঘণ্টা সিএনজি স্টেশন বন্ধ রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে সিএনজি স্টেশন ওনার্স এসোসিয়েশনের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের পর ঘোড়াশাল, আশুগঞ্জ, হরিপুর ও সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একাধিক ইউনিট বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুতের লোডশেডিং বাড়ার কারণ কী জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন মানবজমিনকে বলেন, কয়েক দিন আগে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয় হয়েছে।

এ জন্য একটু সাবধানে এগুচ্ছি। ফলে লোডশেডিং বেড়েছে। তিনি বলেন, গ্যাস দিয়ে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্যাপাসিটি ১১ হাজার মেগাওয়াট। আমরা ৫০০০-এর বেশি উৎপাদন করতে পারছি না বা ৫০০০-এর কম। অর্ধেকের কম উৎপাদন করতে হচ্ছে। ডিজেলের সব কেন্দ্র চালু হয়েছে, একান্ত প্রয়োজন না হলে চালানো হয় না। শুধু পিক আওয়ারে চালানো হয়। কারণ খরচ অনেক বেশি হয়। তিনি বলেন, তেলে ৬ হাজার  মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। সেখানে ৪ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করা হয়েছে। এক হাজার এমএমসিএফডি গ্যাস দিয়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। এটা হলে প্রতিদিন এক ঘণ্টা লোডশেডিং করলেই হয়। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে এক হাজার এমএমসিএফডির কম গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। গ্যাস দিয়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। ডিজেল এবং ফার্নেস অয়েল দিয়েও সক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। সরবরাহ ঘাটতির জন্য উৎপাদন কমানো হয়েছে। এ জন্য লোডশেডিং বেড়ে গেছে। জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের পর কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনে আসতে সময় লাগছে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে দেশে গত ২৪শে আগস্ট থেকে অফিস আদালত সকাল ৮টা থেকে ৩টা পর্যন্ত চলছে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে দু’দিন ছুটি ভোগ করছে।

তারপরেও কেন বিদ্যুতের লোডশেডিং, প্রশ্ন সাধারণদের। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)-এর হিসাব অনুযায়ী, ১০ই অক্টোবর কর্মদিবসে সারা দেশে সন্ধ্যায় বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ধরা হয় ১৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। এই সময়ে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উৎপাদন ধরা হয়েছিল ১২ হাজার ৬৮৬ মেগাওয়াট। তাতে লোডশেডিং ধরা হয় ১ হাজার ৩৯৫ মেগাওয়াট। প্রাক্কলিত সর্বনিম্ন উৎপাদন ধরা হয় ৯ হাজার ৯৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের। পিডিবি’র ওয়েব সাইটে উল্লিখিত বিদ্যুতের লোডশেডিং পরিসংখ্যানে দেখা যায়,  সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকায় লোডশেডিং ধরা হয়েছে ৫৬৫ মেগাওয়াট এবং চাহিদা ৪ হাজার ৪১৯ মেগাওয়াট, চট্টগ্রাম এলাকায় লোডশেডিং ১৫৫ মেগাওয়াট এবং চাহিদা ১ হাজার ২৫২ মেগাওয়াট, খুলনা এলাকায় ১৬০ মেগাওয়াট এবং চাহিদা ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬৫২ মেগাওয়াট, রাজশাহী এলাকায় ১৪০ মেগাওয়াট লোডশেডিং এবং চাহিদা ১ হাজার ৪৬৬ মেগাওয়াট, কুমিল্লা এলাকায় ১২০ মেগাওয়াট এবং চাহিদা ১ হাজার ২৪৮ মেগাওয়াট, ময়মনসিংহে ১১০ মেগাওয়াট লোডশেডিং এবং চাহিদা ধরা হয়েছে ১ হাজার ৩১ মেগাওয়াট, সিলেটে ৪৫ মেগাওয়াট লোডশেডিং এবং চাহিদা ৪৬১ মেগাওয়াট, বরিশাল অঞ্চলে লোডশেডিং শূন্য এবং চাহিদা ৩৭৬ মেগাওয়াট, রংপুর অঞ্চলে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের লোডশেডিং এবং চাহিদা ৮১৪ মেগাওয়াট।

যদিও দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে সাড়ে ২৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। গত ১৮ই জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকের পর দেশে গত ১৯শে জুলাই থেকে বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় দেশজুড়ে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়। এ ছাড়া রাত ৮টার পর শপিং মলসহ দোকানপাট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত কার্যকর এবং উপাসনালয়ে প্রার্থনার সময় ছাড়া এসি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হবার আহ্বানো জানানো হয় সরকারের তরফে। রাত ৮টার পর দোকানপাট, মার্কেট, শপিংমল খোলা থাকলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। রাত ৮টা থেকে কোনোরকম দোকানপাট, শপিংমল, আলোকসজ্জা-সব বন্ধ থাকবে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ বিভাগকে বলা হয়েছে, তারা খুব কঠিনভাবে এ বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করবেন। যদি কেউ অমান্য করেন তাদের বিদ্যুতের লাইন বিচ্ছিন্ন করার কথা বলা হয়েছিল।

Exit mobile version