Site icon The Bangladesh Chronicle

মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুগের সূচনা হচ্ছে

মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুগের সূচনা হচ্ছে – ফাইল ছবি

মধ্যপ্রাচ্য পাল্টে যাচ্ছে। একটি নতুন শক্তির অভ্যুদয় ও একটি নতুন যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে। পরিবর্তনের এই অভিযাত্রা বিশ্বকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেবে। পুরো বিশ্বের শান্তি ও স্থিতির স্বার্থেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ঐক্য অপরিহার্য। বৃহৎ শক্তিগুলো বিভক্ত হলে, ছোট দেশগুলোও বৃহৎ শক্তির পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে সমস্যা বাড়ে, অশান্তি বাড়ে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা হলে তা পুরো বিশ্বেই শান্তির অনুকূলে বড় ভূমিকা রাখবে।

মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরেই বহুধা বিভক্ত। এক দেশ আরেক দেশের সাথে যুদ্ধ করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দুই শক্তিশালী দেশ ইরান ও সৌদি আরবের দ্বন্দ্ব পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। অবশেষে দুই দেশের নেতৃত্বের শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে এবং এর ফলাফল হিসেবে একে অন্যের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়েছে। গত ১০ মার্চ সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার খবর বের হয়। চীন এতে মধ্যস্থতা করে।
ইতোমধ্যেই তাদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং পরস্পরের দেশে দূতাবাস চালু হয়েছে। দীর্ঘ সাত বছর পর সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা হওয়ায় দেশ দু’টির মধ্যে সার্বিক যোগাযোগ এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যও শুরু হয়েছে। সৌদি আরব ও ইরানের সম্পর্ক ইতোমধ্যেই মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। সৌদি আরব-ইরান সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর সৌদি আরব-সিরিয়া সম্পর্কও পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং সিরিয়াকে আরব লিগে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। গত ১৯-২০ মে জেদ্দায় অনুষ্ঠিত আরব লিগের শীর্ষ সম্মেলনে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ অংশ নেন। সিরিয়ার সাথে আরব আমিরাতের সম্পর্ক আগেই পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছে।

ফিলিস্তিনের হামাসের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্কও পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছে। ফলে দীর্ঘদিন পর হামাসের শীর্ষ নেতারা সৌদি আরব সফর করেছেন এবং সৌদি আরব তার কারাগারে বন্দী হামাসপন্থী অনেক নেতাকে মুক্তি দিয়েছে। সৌদি আরব প্রথমবারের মতো ফিলিস্তিনে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দিয়েছে। এর মধ্যে কাতারের সাথে আরব আমিরাতের সম্পর্কও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ইয়েমেনে চলমান গৃহযুদ্ধ অবসানেও সম্মত হয়েছে সৌদি আরব। সৌদি আরবের একটি প্রতিনিধিদল ইয়েমেন সফর করেছে এবং সেখানেও শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ ১০ বছর পর তুরস্ক ও মিসরের মধ্য কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং এর অংশ হিসেবে গত ৪ জুলাই দেশ দু’টি পর¯পরের দেশে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেয়। ২০১৩ সালে মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুরসি ও তার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করলে, তুরস্ক এর প্রতিবাদ করে। তুরস্ক মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে, তাদের ওপর দমন-নিপীড়নের নিন্দা করে এবং এ জন্য মিসরের ক্ষমতাসীন আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি সরকারের সমালোচনা করে। এই প্রেক্ষাপটে দেশ দু’টির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়, যা দীর্ঘ ১০ বছর পর আবার জোড়া লেগেছে। এভাবে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন শুরু হয়েছে।

এ দিকে তুরস্কের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট এরদোগান আবারো ক্ষমতায় এসেছেন। ফলে তুরস্কে স্থিতিশীলতা বিরাজ করবে। তুরস্কের ক্ষমতায় এরদোগানের টিকে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য আরো জোরদার করবে। তুরস্ক বরাবরই সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে আসাদের বিরোধী পক্ষকে সহযোগিতা করেছে এবং আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে কাজ করেছে। যে আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব লড়াই করেছে- সেই আসাদের কিন্তু পতন হয়নি। অথচ এই যুদ্ধে সিরিয়ার প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ মারা গেছে, ৫০ লক্ষাধিক মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে এবং সিরিয়ার সামগ্রিক অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। আসাদ এখনো ক্ষমতায় বহাল আছেন এবং ক্ষমতাকে শক্তিশালী করেছেন। সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও আরব লিগ আসাদকে আবার বরণ করে নিয়েছে। আর এটি হচ্ছে বাস্তবতা। সুতরাং এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে এখন তুরস্কের উচিত হবে সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।

চলমান এই পরিবর্তন একটি ঐক্যবদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য গড়তে ভূমিকা রাখবে। রাজনৈতিকভাবেই সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন ও ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান করতে হবে। তুরস্ক ও মিসরের মধ্যে সম্পর্ক লিবিয়ার সঙ্ঘাত বন্ধে সহায়ক হবে। মধ্যপ্রাচ্য এক হলে বিভক্ত ফিলিস্তিনিরাও এক হবে, যা তাদের দীর্ঘ দিনের সমস্যাকে সমাধান করবে। সুদানে চলমান গৃহযুদ্ধ ও রাজনৈতিক সঙ্ঘাত নিরসনেও ঐক্যবদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য বিরাট ভূমিকা পালন করবে। এভাবে ঐক্যবদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য মুসলিম বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মুসলিম দেশগুলোকে উন্নতি, সংহতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। একইভাবে তা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করবে।

মধ্যপ্রাচ্যের এই সর্বশেষ ঘটনাবলি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিব্রতকর। এটি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে বড় বিপর্যয়। এতে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমবে। ফলে এটি ইসরাইলের জন্যও বিপর্যয়কর।

সৌদি আরবের সাথে ইরানের ঐক্য ইসরাইলের জন্য রাজনৈতিক হুমকি সৃষ্টি করবে। একই সাথে ঐক্যবদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য ইসরাইলের ওপর সৃষ্টি করবে বিরাট এক চাপ। সেটি ফিলিস্তিনিদের জন্য নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করবে। মূলতপক্ষে ফিলিস্তিনিদের ওপর বছরের পর বছর ধরে ইসরাইলের বর্বর নির্যাতন, ইসরাইলের প্রতি পশ্চিমাদের অন্ধ সমর্থন এবং ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান না করা- আজ ইসরাইল ও পশ্চিমাদের জন্য বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে। এ দিকে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের প্রভাব বাড়বে। ইরান ও সিরিয়ার সাথে আগে থেকেই চীনের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এখন সৌদি আরবের সাথে নতুন সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ইতোমধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে চীন একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ভবিষ্যতে সৌদি আরব, ইরান, সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে চীনের ব্যবসায়-বাণিজ্য বাড়বে। বাড়বে চীনের বিনিয়োগও। এভাবে নতুন এক মধ্যপ্রাচ্যের সূচনা হতে যাচ্ছে, যা আগামী দিনের বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে।

লেখক : প্রকৌশলী এবং উন্নয়ন গবেষক
ইমেইল : omar_ctg123@yahoo.com

Exit mobile version