- দুদক গত সোমবার তাঁর বেতন–ভাতা, গৃহসম্পত্তি, ব্যবসার তথ্য চেয়ে এনবিআরে চিঠি দিয়েছে।
- ব্যাংক হিসাব, এমএফএস হিসাব এবং বিও হিসাবে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত আর কোনো লেনদেন করা যাবে না।
ঢাকা
ছাগল-কাণ্ডে দেশজুড়ে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদ্য সাবেক সদস্য মতিউর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব, মুঠোফোনে আর্থিক সেবার (এমএফএস) হিসাব ও শেয়ারবাজারের বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব জব্দের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এই কর্মকর্তার বেতন-ভাতা, গৃহসম্পত্তি, ব্যবসার তথ্য চেয়ে এনবিআরের কাছে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) নির্দেশের পর মতিউর রহমান, তাঁর দুই স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানের ব্যাংক হিসাব, এমএফএস হিসাব ও বিও হিসাবে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত আর কোনো লেনদেন করা যাবে না। এসব হিসাব থেকে কেউ অর্থ তুলতে পারবেন না।
হিসাব জব্দের পাশাপাশি ওই আটজনের ব্যাংক, এমএফএস ও বিও হিসাবের যাবতীয় তথ্যও চেয়ে পাঠিয়েছে বিএফআইইউ। আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তাঁদের ব্যাংক হিসাব খোলার ফরম, কেওয়াইসি (গ্রাহক সম্পর্কিত তথ্য) ও লেনদেন বিবরণী জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একটি ব্যাংক এ চিঠি পাওয়ার বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছে।
আলাদাভাবে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্দেশের পর শেয়ারবাজারে মতিউর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা মোট ১৬টি বিও হিসাব জব্দ করা হয়েছে। বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, মতিউর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির বিষয়ে দুদক যে তদন্ত করছে, তার অংশ হিসেবে তাঁদের বিও হিসাব জব্দের অনুরোধ জানানো হয়। দুদকের ওই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসি এসব বিও হিসাব জব্দের ব্যবস্থা নেয়।
আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তা-ও নেওয়া হয়েছে দুদকের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে। বিএফআইইউ গতকাল মঙ্গলবার একটি চিঠি দিয়ে ব্যাংক ও এমএফএসগুলোকে তাদের এ নির্দেশনা জানিয়ে দিয়েছে। তবে ব্যাংক কিংবা এমএফএস হিসাবে মতিউর রহমান কিংবা তাঁর পরিবারের সদস্যদের কী পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত রয়েছে, তা জানা যায়নি।
দুদক ও বিএসইসি সূত্রে জানা যায়, মতিউর রহমানের দুই স্ত্রী ও পাঁচ সন্তান রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের ঘরে এক ছেলে ও এক মেয়ে। তাঁরা হলেন আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও ফারজানা রহমান ঈপ্সিতা। আর দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতারের ঘরে এক মেয়ে ও দুই ছেলে। তাঁরা হলেন ইফতিমা রহমান মাধুবী, মুশফিকুর রহমান ইফাত ও ইরফানুর রহমান ইরফান।
মতিউর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে এখন পর্যন্ত ১৬টি বিও হিসাবের সন্ধান পাওয়া গেছে। বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, এর মধ্যে মতিউর রহমানের নামে চারটি, তাঁর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে দুটি, প্রথম পক্ষের ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের নামে দুটি, প্রথম পক্ষের মেয়ে ফারজানা রহমান ঈপ্সিতার নামে তিনটি ও দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবলীর নামে পাঁচটি বিও হিসাব রয়েছে। তবে তাঁর তিন সন্তানের নামে এখন পর্যন্ত কোনো বিও হিসাবের হদিস মেলেনি।
শেয়ারবাজারে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে বিও হিসাব ও শেয়ার ধারণসংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ করে সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল)। দুদকের চিঠি পাওয়ার পর বিএসইসি এই প্রতিষ্ঠানকে মতিউর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা বিও হিসাব জব্দের নির্দেশ দেয়। এর ফলে এসব বিও হিসাব ব্যবহার করে এখন আর কোনো লেনদেন করা যাবে না।
জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, বিএসইসি নিজ উদ্যোগে মতিউর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিও হিসাব জব্দের উদ্যোগ নিয়েছিল। এর মধ্যে দুদকের পক্ষ থেকেও তাদের বিও হিসাব জব্দের আবেদন করা হয়। তাই গতকালও এসব হিসাব জব্দে সিডিবিএলকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মতিউর রহমান এনবিআরের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাঁকে এনবিআর থেকে সরিয়ে এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি তিনি সোনালী ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। সেখান থেকেও তাঁকে অপসারণ করা হয়েছে।
এদিকে মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত বিভাগীয় কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেয়নি এনবিআর। তবে দুদক গত সোমবার তাঁর বেতন-ভাতা, গৃহসম্পত্তি, ব্যবসার তথ্য চেয়ে এনবিআরের কাছে চিঠি দিয়েছে বলে জানা গেছে। এনবিআরের কর বিভাগ এসব তথ্য সংগ্রহ করে দুদকে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) একটি দল মতিউর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের কর নথিতে কী ধরনের সম্পদ দেখা হয়েছে এবং কোনো সম্পদ লুকানো আছে কি না, তা অনুসন্ধানে কাজ করছে।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে মতিউর রহমানের মুঠোফোনে গতকাল একাধিকবার কল করে বন্ধ পাওয়া গেছে।
রাজধানীর একটি খামার থেকে মতিউর রহমানের ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত ১২ লাখ টাকায় একটি ছাগল কেনার বায়না করেন। এ খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর ইফাতের পরিচয় খোঁজা শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই তাঁর বাবা মতিউর রহমানের পরিচয় প্রকাশ হয়। এরপর মতিউর রহমানকে নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা শুরু হয়। এই সরকারি কর্মকর্তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ ওরফে লাকী নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির তিনি ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক।