মঙ্গলবার, দেশের মজুরি বোর্ড গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য মাসে ১১৩ ডলার বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে, যা ১লা ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে। যদিও এই ঘোষণা শ্রমিক ও শ্রম গোষ্ঠীগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে। কারণ তাদের দাবি এই মজুরি গত পাঁচ বছর ধরে মূল্যস্ফীতির সাথে তাল মিলিয়ে চলছে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো অনুসারে, ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে ৯% হয়েছে, ১২ বছরের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ গড় হার।
বাংলাদেশের পোশাক কর্মীরা বর্তমানে H&M, Zara এবং Levi’s-এর মতো বড় ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরি করে মাসে ৯৫ ডলার আয় করে। শ্রমিকরা মাসে ২০৮ ডলার মজুরি দাবি করছে। তুলনা করা হলে দেখা যাবে এটি এখনও আমেরিকানদের সাপ্তাহিক মজুরি থেকে কম যেখানে আমেরিকানরা করের আগে প্রতি ঘণ্টা ন্যূনতম ৭.২৫ ডলার করে মজুরি পেয়ে থাকে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক শ্রমিক গোষ্ঠী এটিকে ‘দরিদ্র মজুরি’ বলে দাবি করে। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম ইউনিয়ন সোমিলিটো গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নারজা আক্তার বলেন, ”এটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা মনে করি যে বোর্ডের ন্যূনতম মজুরির ঘোষণা দিয়ে পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের উপহাস করা হয়েছে। এটা মোটেও যৌক্তিক নয়। যৌক্তিকভাবে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা না হলে চলমান শ্রম অসন্তোষের ঝুঁকি রয়েছে, যা শ্রমিক, নিয়োগকর্তা বা রাষ্ট্রের জন্য কাম্য নয়।”
বিক্ষোভের জেরে দেশের অনেক ব্যবসায়ী কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন, চীনের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক উৎপাদন কেন্দ্রকে এই বিক্ষোভ পঙ্গু করে দিয়েছে।কয়েক ডজন বিক্ষোভকারী হাসপাতালে ভর্তি। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর অনুসারে, এক বিক্ষোভকারী কারখানায় আগুন ধরিয়ে দিলে ৩২ বছর বয়সী শ্রমিক ইমরান হোসেনের মৃত্যু হয় এবং পুলিশের সাথে তীব্র সংঘর্ষের ফলে ২৬ বছর বয়সী রাসেল হাওলাদারের মৃত্যু হয়।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন, ”শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়নের চলমান দমন-পীড়ন নিয়েও আমরা উদ্বিগ্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ত্রিপক্ষীয় প্রক্রিয়াটিকে ন্যূনতম মজুরি সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছে যাতে শ্রমিক এবং তাদের পরিবারগুলো ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক চাপ মোকাবেলা করতে পারে।”
এই শিল্পের সাথে দেশের সবচেয়ে দরিদ্র মানুষগুলো সম্পৃক্ত। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই কাজ করেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে গার্মেন্টস শিল্পে কাজের অবস্থা আগেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু বিধ্বংসী রানা প্লাজা ধসের পর থেকে প্রায় ১০ বছরে বাংলাদেশে এই মাত্রার সহিংস প্রতিবাদ দেখা যায়নি। রানা প্লাজার নয়তলা বিল্ডিংটিতে একাধিক পোশাক কারখানা ছিল এবং ১১০০ জন যাদের বেশিরভাগই নারী এই বিপর্যয়ে সেদিন মারা যান। যদিও এখন অবস্থার উন্নতি হয়েছে এবং শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে। পোশাক শিল্পের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব তাদের ওপরেও পড়েছে।
কনসালটেন্সি গ্রুপ ম্যাককিন্সির মতে, বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানি ২০১১ সালের ১৪.৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০১৯ সালে ৩৩.১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবার দিকে এগোচ্ছে। ইউএস কমার্স ডিপার্টমেন্টের মতে, তৈরি পোশাকের উৎপাদন দেশের শিল্প খাতে আধিপত্য বিস্তার করে, যা বাংলাদেশের বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদনের ৩৫.১%।
ব্র্যান্ডগুলো কী বলছে?
H&M, Levi’s, Gap, Puma, এবং Abercrombie & Fitch সহ ১৮টি ব্র্যান্ড গত মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে শান্তিপূর্ণ আলোচনার আহ্বান জানিয়ে এবং শ্রমিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য নতুন ন্যূনতম মজুরির আহ্বান জানিয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশন বা এএএফপি যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্র্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করে তারা সময়মতো ন্যূনতম মজুরি পর্যালোচনার পরামর্শ দিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ন্যূনতম মজুরি পর্যালোচনা করা হয়। এএএফপি-তে নীতি বিষয়ক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নেট হারম্যান সিএনএন-কে দেয়া এক বিবৃতিতে বলেছেন, ”নামী ব্র্যান্ডগুলো মনে করে আদর্শগতভাবে এই মজুরি স্তর প্রতি ৫ বছরে নয়, বার্ষিক পর্যালোচনা করা উচিত। সময়োপযোগী পর্যালোচনা নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজন অনুসারে এই মজুরি স্তরগুলোতে বৃদ্ধি আরো ভালো ব্যবসার সুযোগ করে দেবে। ”
H&M-এর মতো ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশে কোনো কারখানার মালিক নয় বরং তারা সেখানে কারখানার মালিকদের সাথে চুক্তি করে সমস্ত অগ্রিম খরচ প্রদান করে যেমন – সরবরাহ, সুযোগ -সুবিধা এবং শ্রম। এই সুইডিশ জায়ান্ট কোম্পানি সিএনএনকে বলেছে যে, ”বাংলাদেশে দায়িত্বশীল ক্রয় পদ্ধতির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের মজুরি প্রদানের সুবিধার্থে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করি”। H&M যোগ করেছে যে, তারা এই মুহূর্তে বিক্ষোভের কারণে সামগ্রিক উৎপাদন বা সরবরাহ শৃঙ্খলে কোনও বড় প্রভাব দেখতে পাচ্ছে না, যদিও কোম্পানির সাথে সম্পৃক্ত কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সিএনএন H&M-কে মজুরি প্রদানের সুবিধার্থে কোম্পানির ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলো, কিন্তু তারা এই প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। প্যাটাগোনিয়া বলেছেন, তারা প্রতি মাসে ২০৮ ডলার ন্যূনতম মজুরি সমর্থন করে- ঠিক যা শ্রমিকরা চাইছেন। কোম্পানিটি গত মাসে বলেছিল, ”আমরা বাংলাদেশের কারখানাগুলোর একজন দীর্ঘকালীন অংশীদার হয়ে কিছু প্রযুক্তিগত পণ্য তৈরি করি। আমাদের সরবরাহকারী মজুরির দিকে কিছু অগ্রগতি করলেও আমাদের বিশ্বাস আমরা একসাথে আরও অনেক কিছু করতে পারি। ”
লেভি স্ট্রস অ্যান্ড কোং একটি বিবৃতিতে বলেছে, এটি “নিয়মিত ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের জন্য ন্যায্য, বিশ্বাসযোগ্য এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করতে বাংলাদেশ সরকারকে উৎসাহিত করেছে। ব্র্যান্ডের বাংলাদেশে মজুরি নির্ধারণের ক্ষমতা নেই, তবে মূল্য নির্ধারণের জন্য চাপ দেবার ক্ষমতা তাদের রয়েছে। সিএনএন কারখানার মালিকদের প্রতিনিধিত্বকারী বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাথে যোগাযোগ করলেও তারা কোনও মন্তব্য করতে চায়নি। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ফ্যাশন পলিসির লেকচারার এলিজাবেথ ক্লাইন বলেছেন, “কারখানার উপর অনেক চাপ। এটি ব্র্যান্ড এবং খুচরা বিক্রেতাদের সাথে শুরু হয় এবং আমি মনে করি শুধু কথোপকথন চালালেই হবে না। আমরা যদি মজুরি ঠিক করতে চাই, তাহলে আমাদের সত্যিকার অর্থেই মূল্যের সমস্যা সমাধান করতে হবে। ”
ভোক্তার দায়িত্ব
বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের প্রায় সব গ্রাহকই দেশের বাইরে। ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪% ছিল পোশাক রপ্তানি। ভোক্তারা তাদের পণ্যগুলি সস্তা এবং দ্রুত চায়- বিশেষ করে যেহেতু ভোক্তাদের খরচ করার অভ্যাস মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে আরও সাশ্রয়ী পণ্যের দিকে ঝুঁকছে। কর্নেল ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল লেবার ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর জেসন জুড বলেছেন, ‘যখন তরুণ প্রজন্মের ভোক্তারা তাদের পোশাক কোথা থেকে আসে এবং কীভাবে এটি তৈরি হয় তা নিয়ে ভাবছেন, তখন শিল্প মজুরি গ্রাহকদের উপর নির্ভর করতে পারে না। একটি ব্র্যান্ডকে পরিবর্তন করতে হলে গ্রাহকদের থেকে একটি বিশাল ধাক্কা প্রয়োজন।”
ওয়ার্কার্স রাইটস কনসোর্টিয়াম অনুসারে, মহামারী চলাকালীন ব্র্যান্ডগুলো বিশ্বজুড়ে কারখানাগুলোতে ৪০ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল করেছিল, কারখানার মালিক এবং সরবরাহকারীরা বিল এবং শ্রমিকদের মজুরি ছাড়াই রেখেছিল। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় তৃণমূলস্তরে শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে, “পে আপ” প্রচারণা ব্র্যান্ডগুলোকে ৪০ বিলিয়ন পাওনা থেকে ২২ বিলিয়ন ফেরত দিতে বাধ্য করেছে। জুড বলেন, প্রকৃত পরিবর্তন আসে দেশের ভেতর থেকেই । বেশ কয়েকজন শ্রমিক কর্মী সিএনএন- কে জানান, বাংলাদেশের রাস্তায় যা ঘটছে তা ২০১৪ সালে কম্বোডিয়ায় যা ঘটেছিল তা স্মরণ করিয়ে দেয়, সেইসময়ে একইভাবে কম্বোডিয়া সরকার একটি নতুন ন্যূনতম মজুরি আরোপ করার পরে সেখানে গার্মেন্টস শ্রমিকরা উচ্চ মজুরির দাবি জানিয়েছিলো । সরকার নিরাপত্তা বাহিনী পাঠিয়ে বিক্ষোভ দমানোর চেষ্টা করে- শ্রমিকদের উপর গুলি চালানোর জেরে অন্তত তিনজন নিহত হয়। কম্বোডিয়া এখন বছরে একবার পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়াতে রাজি হয়েছে। জুডের মতে,“ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের আরও যুক্তিযুক্ত, কম সহিংস এবং আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়া দরকার।”
সূত্র : সিএনএন/ মানব জমিন