Site icon The Bangladesh Chronicle

ভোলার সহিংসতা: আমাদের সতর্ক থাকার শিক্ষা দিল

ভোলার সহিংসতা: আমাদের সতর্ক থাকার শিক্ষা দিল

মিজানুর রহমান খান  ২৩ অক্টোবর ২০১৯

পুলিশকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে তাদের পক্ষে গুলি চালানো ছাড়া আর কোনো পথ ছিল নাভোলায় ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক ও ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে’ আঘাতের ঘটনায় রক্তপাতের দুঃখজনক অংশটি ছাড়া পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত সামলানো গেছে বলে প্রতীয়মান হয়। প্রশাসনের ভূমিকাকে এখানে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এক বা কতিপয় ব্যক্তি কর্মকর্তার ব্যর্থতা বা অপারগতাকে ‘প্রশাসন’ হিসেবে দেখা ভুল।

ভোলার এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক শক্তিশালী ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর ভূমিকার বিষয়টি ভালোভাবে মূল্যায়নের সুযোগ তৈরি হয়েছে। সুজনের সভাপতি মোবাশ্বির উল্লাহ চৌধুরী আমাদের বলেছেন, ভোলায় কোন প্রেক্ষাপটে এ রকম ঘটনা ঘটতে পারল, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। তাঁর কথায়, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার দুটি ঘটনা আমি নিজেই প্রশাসনকে জানিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো প্রতিকার মেলেনি। এ ধরনের নির্লিপ্ততার দায় সামগ্রিকভাবে প্রশাসনকে নিতে হবে।

আবার ফেসবুক বা ডিজিটাল মাধ্যমে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে’ আঘাতের ঘটনাকে ‘ভাইরাল’ করা বা এই মাধ্যম যে একটি সংবেদনশীল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, তা প্রশাসনের না জানার কিছু নেই, কিন্তু আমরা সেই অনুযায়ী উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে দেখছি না।

২০১২ সালে রামুতে, ২০১৩ সালে পাবনার সাঁথিয়ায়, ২০১৪ সালে কুমিল্লায়, ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ও ২০১৭ সালে রংপুরে ফেসবুককেন্দ্রিক ঘটনার এক বছরের বিরতিতে ভোলার ঘটনাটি ঘটল। এই মাধ্যমকে ব্যবহার করে দুর্বৃত্ত বা চক্রান্তকারীরা আবারও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে, সে ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকা জরুরি। কোন সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী আমাদের সাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চায়, তা খুঁজে বের করা যেমন জরুরি, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রশাসনের সজাগ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা। সম্পূর্ণ স্থানীয়ভাবে শুধু অজ্ঞতাপ্রসূত বা স্থানীয় ব্যর্থতার কারণে অনেক বড় ধরনের ঘটনা ঘটে যেতে পারে। ভোলার ঘটনা থেকে আমাদের সেই শিক্ষাটাই নিতে হবে।

বোরহানউদ্দিনের ঘটনা ঘটেছিল শুক্রবার। কিন্তু পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে রোববারে। তার মানে এটা বলা কঠিন যে তাৎক্ষণিকভাবে উচ্ছৃঙ্খল জনগোষ্ঠী বা তেমন পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে পুলিশ আত্মরক্ষামূলকভাবে গুলি করতে বাধ্য হয়েছিল। চারজনের মৃত্যুর ঘটনাটির একটি তদন্ত হওয়া জরুরি। পুলিশের পক্ষে এই তদন্ত করা কঠিন। নিরপেক্ষ মহল দ্বারা এর তদন্ত করতে হবে। পুলিশকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে তাদের পক্ষে গুলি চালানো ছাড়া আর কোনো পথ বা বিকল্প ছিল না। হাঁটুর নিচে গুলি করার প্রশিক্ষণ কি তারা পায়নি? নাকি তার প্রয়োগ সেখানে অসম্ভব ছিল, সেটাও দেখতে হবে।

এটা বিরাট আক্ষেপের বিষয় যে ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনার নানা উদ্যোগের প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পরে রক্ত ঝরল। পুলিশের কাছে গিয়ে সংখ্যালঘু তরুণটি নিজেই জানিয়েছিলেন যে তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি হ্যাক হয়েছে। এবং এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে পুলিশ দুই মুসলিম যুবককে গ্রেপ্তারও করেছিল। এখানেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। কারণ, পুলিশ প্রশংসনীয়ভাবে তাঁদের দ্রুত আটক করতে সক্ষম হয়েছিল।

সুতরাং যে সংগঠিত গোষ্ঠী এসপি ও এডিশনাল ডিআইজির ওপরে হামলা করেছে, তাদের উদ্দেশ্যকে আলাদাভাবে দেখতে হবে। কারণ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো অপরাধ সংঘটনের পরে পুলিশ কিন্তু বসে থাকেনি। যারা হামলার সঙ্গে জড়িত, তাদের এসব পুলিশি ব্যবস্থার বিষয়গুলো জানার কথা। তাদের জানা ছিল, দুজন যুবককে আটক করা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে আপত্তিকর বিষয়বস্তু কারা কীভাবে ভাইরাল করল, সেটা দু-এক দিনেই জানা যাবে। এখন যদি প্রমাণিত হয় যে সংখ্যালঘু যুবকটির ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক হওয়ার পরে ওই স্ট্যাটাস ছাড়া হয়েছে এবং আটক যুবকেরা এর সঙ্গে জড়িত, তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়াবে?

পুরো ঘটনাটি আদালতে প্রমাণ হওয়ার আগেই কারও ফাঁসির দাবি মেনে নেওয়ার সুযোগ আছে কি? প্রশাসনের তরফে এমন দাবি মেনে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নাগরিক বা প্রশাসন কারও তরফেই এমন উদাহরণ তৈরি করা উচিত নয়, যা যুক্তিগ্রাহ্য নয়।

ভোলার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিনগুলোতে কিছু বাড়তি সতর্কতা জরুরি। বাবরি মসজিদের রায় আসার কথা মধ্য নভেম্বরে। এমন পরিস্থিতিতে স্বার্থান্বেষী মহল সুযোগ নেওয়ার অপেক্ষায় থাকে। অতীতে তেমন অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। শুধু প্রশাসন নয়, নাগরিক সমাজ, মুসল্লি, শ্রদ্ধাভাজন ধর্মীয় নেতাদের নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। ফেসবুকের সহযোগিতা নিয়ে খুঁজে বের করতে হবে কারা স্ক্রিনশট ছড়িয়েছে, ফেসবুকে পোস্ট করেছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের এটা বোঝাতে হবে যে যা ক্ষতিকর, যা অপরাধ, সেটা ছড়িয়ে দেওয়া ও নিজের অ্যাকাউন্টে যুক্ত করাও অপরাধ।

ডিজিটাল মাধ্যমে নাশকতা, অপব্যবহার বা অপরাধ সংঘটনের ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি রোধে তাকে অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে দ্রুত শাস্তি দেওয়ার নজির তৈরি করতে পেরেছে সরকার। ফেসবুকে মতপ্রকাশের কারণে অনেকে শাস্তি পেয়েছেন। এটা খুবই লজ্জার বিষয় যে কিছু ক্ষেত্রে সরকার ডিজিটাল অপরাধের দ্রুত বিচার করছে আর কিছু ক্ষেত্রে নির্লিপ্ত থাকছে।

দুর্ভাগ্যজনক হলো, ফেসবুক নিয়ে যত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তার প্রতিটির ক্ষেত্রে আমরা দায়িত্বশীলদের তরফে এই আশ্বাস পেয়েছিলাম যে দ্রুত বিচার হবে। রামুসহ কোনো ঘটনার বিচার হয়নি। কারও শাস্তি হয়নি। আমরা জেনেছি, ফেসবুক ইত্যাদি ধরনের মাধ্যম অপব্যবহারের ঘটনায় এ পর্যন্ত প্রায় ৪০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। বিচারাধীন বলাটা ভুল হবে, এর অধিকাংশের ঘটনায় পুলিশ অভিযোগপত্র দেয়নি। বেশির ভাগই তদন্তাধীন।

ফেসবুক অপব্যবহারকারীদের শনাক্ত করা বা যারা বিপজ্জনক খবর ভাইরাল করে, তাদেরও অপব্যবহারকারী হিসেবে শাস্তি নিশ্চিত করে উদাহরণ তৈরি করা দরকার। আমরা বিচারহীনতা ও দায়মুক্তির সংস্কৃতির বিপদ সম্পর্কে সচেতন। তিন বছর আগে জার্মানিতে এক মিডিয়া কনফারেন্সে গিয়ে জেনেছিলাম, ফেক নিউজ হবে ভবিষ্যতের সাংবাদিকতা এবং শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের প্রতি বিরাট হুমকি। সারা বিশ্বের সরকার ও সংবাদমাধ্যম সে জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদেরও এ ব্যাপারে প্রস্তুত থাকতে হবে। কারণ, এ থেকে এমন বিপদ হতে পারে, যা হয়তো আমরা কল্পনাও করতে পারছি না। ফেক নিউজের বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার বিপদ বা উসকানি শুধু দেশের ভেতর থেকে নয়, বাইরে থেকেও হতে পারে। যা থাকতে পারে একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। হয়তো উৎস বা বিষয়বস্তু দ্রুত শনাক্ত হবে। কিন্তু সেটা হওয়ার আগেই ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে যেতে পারে। আর আমাদের শত্রুরা নিরাপদ অবস্থানে থেকে তা উপভোগ করবে।

অজ্ঞতা দূর হোক। প্রশাসনের ঘুম ভাঙুক। ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অস্ত্রের অপব্যবহার ভবিষ্যতে আরও ঘটতে পারে। এর অপব্যবহার যাতে কেউ করতে না পারে, সে জন্য বরেণ্য ধর্মীয় নেতাদের সক্রিয় নেতৃত্ব ও নির্দেশনা দেওয়া আজ সময়ের দাবি। সে জন্য ফেসবুক ও ডিজিটাল উপকরণের ব্যবহার ও অপব্যবহার নিয়ে জনগণকে সচেতন ও সজাগ করতে হবে।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
mrkhanbd@gmail.com

Exit mobile version