দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘প্রতিহত’ করার বদলে শান্তিপূর্ণভাবে ‘ভোট বর্জনের’ কর্মসূচিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি। অবশ্য নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিও দেবে তারা। দেশি-বিদেশিদের সামনে নির্বাচনকে ‘একতরফা’ ও ‘ভোটারবিহীন’ প্রমাণ করতে চায় বিরোধী দলটি। এ লক্ষ্যে জনগণকে ভোট দানে নিরুৎসাহিত করতে সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে তারা। একই সঙ্গে সমমনা অন্যান্য দল ও জোটের উদ্যোগেও চলছে ভোট বর্জনের ডাক। ভোটারদের কাছে এ নির্বাচনকে ‘তামাশা’র নির্বাচন হিসেবে তুলে ধরতে চাচ্ছে তারা। এতে একদিকে যেমন চলছে লিফলেট বিতরণের মতো গণসংযোগ কর্মসূচি, তেমনি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে প্রচারণা। আগামী দিনে এ কর্মসূচিকে আরও বেগবান করার পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের। একই সঙ্গে এক দফার আন্দোলনকেও কঠোর করার সিদ্ধান্ত রয়েছে। যেখানে দলের প্রত্যেক নেতাকর্মীকে নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে ভোটারদের ভোটদানে বিরত রাখার পাশাপাশি রাজপথের আন্দোলনকে বেগবান করার সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সমকালকে বলেন, ভোটারদের ন্যূনতম আগ্রহ না থাকলেও গণতান্ত্রিক বিশ্বকে তথাকথিত ভোটের উৎসব দেখানোর জন্য জনগণের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন শুরু হয়েছে। ভোট না দিলে সাধারণ মানুষকে এলাকাছাড়া করার ভয় দেখানো হচ্ছে। ভোটের উৎসবের বদলে আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা চলছে। পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে নামানো হয়েছে ‘আমি আর ডামি’র ভোটরঙ্গে। তবে এসব করে কোনো লাভ হবে না। দেশপ্রেমিক কোনো ভোটার ওই পাতানো নির্বাচনকে জায়েজ করতে ওই দিন ভোটকেন্দ্রে যাবেন না।
দলীয় সূত্র জানায়, লিফলেট ছাড়াও দু-একদিনের মধ্যে ভোটবিরোধী স্টিকার তৈরি করবে বিএনপি। ওইসব স্টিকার যানবাহন, বিভিন্ন স্থাপনা এবং হাটবাজারে লাগানো হবে। হাজার হাজার স্টিকার লাগানো হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভোটের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে শুরু হয়েছে ব্যাপক প্রচার। বিভিন্ন গান তৈরি করে, নিমো তৈরি করে দলের নেতাকর্মী এ প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন।
বিএনপির বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা জানান, নির্বাচনের আগেই স্পষ্ট হয়েছে– আওয়ামী লীগই আবার ক্ষমতায় আসছে। তারাই সরকার গঠন করছে। তাতে ভোটারদের ভোটদানে তেমন গুরুত্ব বহন করে না বলে আওয়ামী লীগেরও অনেক সমর্থক ভোটদানে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে জনগণ ভোটের উৎসব যেমনটা পালন করে, সে রকমটা না হওয়ায় নির্বাচন নিয়ে কারও কোনো আগ্রহ নেই। এর পুরো প্রভাব পড়বে নির্বাচনের দিন।
বিএনপি ছাড়াও গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, এলডিপি, গণফোরাম, সমমনা জাতীয়তাবাদী জোট, বাম গণতান্ত্রিক জোট, গণঅধিকার পরিষদ দুই অংশ ছাড়াও যুগপৎ আন্দোলনের বাইরে থাকা জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টিসহ অন্তত ৬৩টি রাজনৈতিক দল একই কর্মসূচি পালন করছে।
এরই মধ্যে দুই দফায় পাঁচ দিন চলমান অসহযোগ আন্দোলন সমর্থন জানাতে আর ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে লিফলেট কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। আজ শুক্রবার থেকে আরও দু’দিন এ কার্যক্রম চলবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে নির্বাচনকে ‘ভাগাভাগির নির্বাচন’, ‘আমরা আর মামুরা নির্বাচন’, ‘ডামি নির্বাচন’, ‘আমি-ডামি নির্বাচন’ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।
জানা গেছে, ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে প্রায় এক বছর ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি। এর মধ্যে তারুণ্যের সমাবেশে ভোটবঞ্চিত তরুণ, যুবক ও ছাত্রসমাজকে এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসতে সারাদেশে ১০টি সমাবেশ করেছে দলটি। সেসব সমাবেশ থেকে বার্তা দেওয়া হয়েছে। সমাবেশের উদ্যোক্তারা তারুণ্যের সমাবেশ সফল করতে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে গেছেন। তরুণদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের কথা শুনেছেন। তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার করতে কাজ করেছেন। ভোটাধিকারের পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করেছেন। এখন এর সুফল পেতে চাইছে দলটি।
যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু সমকালকে বলেন, বিগত দুটি নির্বাচনে ভোটাধিকারবঞ্চিতরা নির্দলীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের পক্ষে। তবে সেটি না থাকায় নতুন প্রজন্মের তরুণরা প্রথম ভোটদানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। আগের নির্বাচনগুলোয় তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। বিনা ভোটে তাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ায় ভোটদানের প্রক্রিয়া থেকে এমনিতেই জনগণ দূর সরে গেছে। এবার সেখানে ভোটাধিকারবঞ্চিত প্রায় ছয় কোটি ভোটার ‘একতরফা’ ও ‘ডামি নির্বাচন’কে ভালোভাবে নেয়নি। তারা এই পাতানো নির্বাচন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে বলেই দেশে নির্বাচনের কোনো আমেজ তৈরি করতে পারেনি অবৈধ সরকার।
বিএনপির লিফলেটে বলা হয়েছে, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত গণতন্ত্রকে ছলে বলে কৌশলে গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ বিনা ভোটে সীমাহীন দুর্নীতি, অনাচার, নির্যাতন, অপশাসন চালিয়ে দেশকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে। বিরোধী মতকে দমন করতে গুম, খুন ও গায়েবি মামলাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে নিকৃষ্টতম স্বৈরশাসন কায়েম করেছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তাদের জনগণের ভোট লাগে না বলে এই সরকারের কাছে জনগণের আশা, আকাঙ্ক্ষা, প্রয়োজন কিংবা অসন্তুষ্টির কোনো মূল্য নেই। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে সমাজের কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত ধনী, আমলা, পুলিশ এবং দলীয় নেতাকর্মী দিয়ে জনগণের ন্যায়সংগত আন্দোলন দমন করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’
লিফলেটে সরকারের বিগত দিনে দুর্নীতি, বৈদেশিক ঋণ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, লুটপাটসহ আরও অনেক বিষয় তুলে ধরে বলা হয়েছে, এ নির্বাচনে সরকারবিরোধী কোনো রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে না। আসন ভাগাভাগির তামাশাপূর্ণ ডামি নির্বাচন বর্জন করতে দেশপ্রেমিক জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। সেখানে অসহযোগ আন্দোলনের পাঁচ দফাও উল্লেখ করা হয়েছে।
জানা গেছে, নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই ভোট না দেওয়ার গণসংযোগ জোরালো করা হচ্ছে। এ জন্য নেতাকর্মীকে নিজ এলাকায় যেতে বলা হয়েছে। এই ভোটবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির সহযোগী সংগঠনগুলোও তৎপর রয়েছে। তারা সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে যাচ্ছে। শহর, গ্রাম– সব জায়গায়ই তারা কাজ করছে। হাটবাজারে, যেখানে লোকজন থাকে সেখানে যাচ্ছেন বিএনপিসহ অন্যান্য দলের নেতাকর্মীরা। তারা জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, এটা কোনো ভোট নয়। ভোট দিয়ে এই অবৈধ সরকারের ক্ষমতা নবায়নে সহযোগিতা করবেন না।
বিএনপি নেতারা জানান, সারাদেশে জনগণকে ভোটদানে বিরত রাখতে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি এক দফার আন্দোলনকে জোরদার করে রাজপথে শক্ত অবস্থান তৈরির কৌশলও রয়েছে। দেশের রাজনীতিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হলে স্বভাবতই সাধারণ মানুষ ভোটদানে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। নির্বাচন ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতি এখন সেই দিকেই যাচ্ছে, নির্বিঘ্নে ভোটদানের পরিবেশ ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে বলে মনে করছেন দলটির নেতাকর্মীরা। এখনই যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যেভাবে পুলিশ নামানো হয়েছে, তাতে এমনিতেই ভোটকেন্দ্রে মানুষ যাবে না। আরেকটি ভোটারবিহীন নির্বাচন হবে।
দলটির নেতাকর্মীরা জানান, গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর সারাদেশে চলমান সাঁড়াশি অভিযানে গণগ্রেপ্তার হয়েছেন প্রায় ২৭ হাজার। অনেকে আত্মগোপনে। কেউ কেউ রাজপথে আন্দোলন করছেন। তাদের পরিবার-পরিজনও রয়েছে আতঙ্কে। একই সঙ্গে গত দেড় মাসে পুরোনো মামলায় সাজা হয়েছে ১ হাজার ৩৫০ জনের। দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এমন দুর্বিষহ জীবন পার করছে। তারা কিছুতেই ভোটকেন্দ্রে যাবে না। তাদের আত্মীয়-স্বজনদেরও ভোটদানে বিরত রাখার কৌশল নেওয়া হয়েছে।
সামাজিক সুরক্ষার উপকারভোগী কার্ডধারীদের বাধ্যতামূলক ভোট দেওয়ার ঘোষণা এবং বিভিন্ন স্থানে তাদের কার্ড জমা নেওয়ার ঘটনাতে বিএনপি নেতারা তেমন উদ্বিগ্ন নন। তারা মনে করছেন, বয়স্ক ভাতা, বিধবা বা স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য ভাতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা, শহীদ পরিবার ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও সম্মানী ভাতা, ভিডব্লিউবি, ভিজিএফ, ভিজিডি, জিআর, টিআর, ওএমএস, টিসিবির কার্ডধারীদের বেশির ভাগ আওয়ামী লীগ সমর্থিত। নির্বাচনের আগে তাদের কার্ড জব্দ করার ঘটনায় উল্টো বিরূপ প্রভাব পড়ছে ওইসব সাধারণ মানুষের মধ্যে।
বিএনপির মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী আরও বলেন, আসন ভাগবাটোয়ারার ‘আমি-ডামির’ ভোট প্রহসন জমছে না দেখে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর ডামি নির্বাচন কমিশনসহ পুরো আওয়ামী চক্র-দলদাস রাষ্ট্রযন্ত্র। এখন তারা ভোটারদের হুমকি-ধমকি দিতে শুরু করেছেন। এমনকি বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, ওএমএস, কৃষকের মাঝে সার এবং বীজ বিতরণ বন্ধের হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। গোটা দেশকে তারা অভাবনীয় নরকপুরীতে পরিণত করেছে।
সমকাল