Site icon The Bangladesh Chronicle

ভোট বর্জনে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক

বিএনপি

ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে এবার অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে বিএনপিসহ মিত্ররা। সরকার পদত্যাগের একদফা দাবিতে এবং অসহযোগের পক্ষে চার দিনের কর্মসূচিও দিয়েছে তারা। কর্মসূচির মধ্যে আছে-আজ থেকে তিন দিন গণসংযোগ এবং রোববার সকাল-সন্ধ্যা অবরোধ। গণসংযোগকালে লিফলেট বিতরণ করা হবে। আন্দোলন সফলে জনগণের সহযোগিতা চেয়েছে দলগুলো। বুধবার ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে নতুন কর্মসূচিসহ অসহযোগ আন্দোলন শুরুর কথা জানান বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। বিকালে একযোগে একই কর্মসূচি ঘোষণা করে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, এলডিপিসহ সমমনা দল ও জামায়াতে ইসলামী।

সরকারকে আর কোনো ধরনের সহযোগিতা না করার জন্য প্রশাসনের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং গণতন্ত্রকামী দেশপ্রেমিক জনগণের প্রতি আহ্বান জানান রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচন বর্জন করুন। নির্বাচনের নামে বানর খেলার আসরে অংশ নেবেন না। কেউ ভোটকেন্দ্রে যাবেন না। এটি আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার। নির্বাচন কমিশন কাকে সংসদ-সদস্য ঘোষণা করবে, গণভবনে সেই তালিকা তৈরি হয়ে গেছে। সুতরাং ৭ জানুয়ারির ভোটগ্রহণে নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দায়িত্ব পালনে বিরত থাকুন। সরকারকে সব ধরনের ট্যাক্স, খাজনা, ইউটিলিটি বিল এবং অন্যান্য প্রদেয় স্থগিত রাখুন। ব্যাংকগুলো এ অবৈধ সরকারের লুটপাটের অন্যতম মাধ্যম। সুতরাং ব্যাংকে টাকা জমা রাখা নিরাপদ কি না, সেটি ভাবুন। মিথ্যা ও গায়েবি মামলায় অভিযুক্ত লাখ লাখ রাজনৈতিক নেতাকর্মী আদালতে মামলায় হাজিরা দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেন, অবৈধ সরকারকে অসহযোগিতা করতে গিয়ে প্রশাসন কিংবা দেশপ্রেমিক জনগণ যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকার অবশ্যই তাদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেবে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আপনাদের ত্যাগের প্রতি সুবিচার করবে। একই সঙ্গে আরও বলতে চাই-গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং লুণ্ঠিত ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার চলমান আন্দোলনে বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষে যারাই হতাহত হয়েছেন, ভবিষ্যৎ সরকার তাদের অবদানও দলীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে মূল্যায়ন করবে।

অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি, প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা তুলে ধরে বিএনপির এই নেতা বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের কবলে। সাম্য-মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার-মুক্তিযুদ্ধের এসব মূলমন্ত্র হারিয়ে দেশে এখন সর্বত্রই পাহাড়সম বৈষম্য-অমানবিকতা আর অবিচার-অনাচার চলছে। একজন মাত্র ব্যক্তির অবৈধ ক্ষমতার লালসা মেটাতে দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি ধ্বংসপ্রায়। সামাজিক মূল্যবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয় ঘটেছে। দেশের প্রতিটি সাংবিধানিক, বিধিবদ্ধ ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চরিত্র নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এবার সর্বশেষ পরিকল্পিতভাবে বিনষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। সবকিছু ধ্বংস করে দিয়ে বিনা ভোটে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে দুর্নীতিগ্রস্ত বণিক, আমলা, পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসীদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে একটি মাফিয়াচক্র। এ মাফিয়াচক্র দেশে এখন দুর্নীতি আর লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছে। দুর্নীতিবাজ লুটেরা চক্রকে প্রতিহত করে জনগণের রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠার এখনই চূড়ান্ত সময়।

জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেন, ২০১৪ কিংবা ২০১৮ সালের নির্বাচন সরাসরি সংবিধানের ৬৫-এর ২, ১১, ৭-এর ক এবং ১৪৮ অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সুতরাং ফ্যাসিস্ট হাসিনার বর্তমান সরকার সম্পূর্ণভাবে অবৈধ, অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক। এ অবৈধ সরকারের কোনো আদেশই প্রশাসন মানতে বাধ্য নয়। একইভাবে জনগণও ফ্যাসিস্ট হাসিনার অবৈধ সরকারকে সহযোগিতা করতে বাধ্য নয়। এমনকি অবৈধ এই গণবিরোধী সরকারকে জনগণ ট্যাক্স দিতেও বাধ্য নয়।

রিজভী বলেন, দেশের কারাগারগুলোয় এখন উপচে পড়া ভিড়। সুতরাং কাউকে আর কারাগারের ভয় দেখিয়ে কিংবা কেউ কারাগারকে ভয় পেয়েও লাভ নেই। ফ্যাসিস্ট হাসিনার লেলিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসীরা যদি গণতন্ত্রের পক্ষের একজন রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থককেও হয়রানি করে, দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। ঐক্যবদ্ধভাবে এ অবৈধ সরকারকে অসহযোগিতা অব্যাহত রাখলে এরা আর কাউকে গ্রেফতার, নির্যাতন, হয়রানি করার সাহস পাবে না। দেশে আজ জনগণের অধিকার নেই বলেই জনগণের লুণ্ঠিত অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু হলো। ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত চলমান এ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। গণ-আন্দোলনের মাধ্যমেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে গণমানুষের অধিকার। এ আন্দোলনে বিজয় লাভ করেই ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে রেখে দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

বিকালে রাজধানীর মগবাজারে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এলডিপির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদও একই কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, দুর্নীতি, অন্যায় ও অবিচারের হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করতে হবে। বর্তমান পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে জনগণ ভোটের অধিকার হারিয়ে ফেলবে। এতে দেশ ও জনগণ উপকৃত হবে না। বরং এই হঠকারী ভাগাভাগির নির্বাচনের কারণে দেশ ও জনগণ এক গভীর সংকটে পড়বে। ক্ষমতালোভীদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে। এ নির্বাচন কখনো গণতন্ত্র নিশ্চিত করবে না।

তিনি বলেন, সুতরাং আসুন ঐক্যবদ্ধ হই। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করি। কোনো অবস্থাতেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। চিরতরের জন্য দুর্নীতিবাজ, অর্থ পাচারকারী, নির্যাতন ও নিপীড়নকারীদের বর্জন করতে হবে। হতাশ হলে চলবে না। নতুন উদ্যমে সাহসের সঙ্গে বর্তমান সরকারকে না বলতে হবে। সমাজে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার কাজে যুবসমাজকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সত্যের জয় প্রতিষ্ঠা হবে। ভাগাভাগির একদলীয় নির্বাচন বর্জন করুন। দেশ বাঁচান।

বিকালে কেন্দ্রীয় পরিচালনা কমিটির এক সভা শেষে প্রায় একই কর্মসূচি ঘোষণা করে গণতন্ত্র মঞ্চ। এতে নেতারা ৭ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান ও বর্জনের ভেতর দিয়ে সরকারের বিদায় নিশ্চিত কিরতে সরকারকে অসহযোগিতা করার জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানান। এ লক্ষ্যে আজ ও আগামীকাল দেশব্যাপী গণসংযোগ এবং শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে গণমিছিল করা হবে। গণমিছিল থেকে রোববার অবরোধ কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, মিছিল-মিটিংয়ের অধিকার হরণ করে প্রহসনের নির্বাচনের বৈতরণি পার হওয়া যাবে না। অবিলম্বে তামাশার তফশিল স্থগিত, পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি জানান তিনি।

জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ জানান, তারাও আজ থেকে তিন দিন গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করবেন। একই কর্মসূচি পালন করবে ১২ দলীয় জোট, নুরুল হক নুর নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদ, ড. রেজা কিবরিয়া নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদ, গণফোরাম (মন্টু) ও পিপলস পার্টি, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টিসহ সমমনারা। অন্যদিকে যুগপৎ আন্দোলনে না থাকলেও একই দিনে স্বতন্ত্র কর্মসূচি পালন করবে আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি)। জামায়াতে ইসলামীও একই কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়ে একতরফা নির্বাচন ও নতুন শিক্ষা কারিকুলাম বাতিলের দাবিতে শুক্রবার ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল করবে ইসলামী আন্দোলন।

গণসংযোগে লিফলেটে যা থাকছে : আজ থেকে টানা তিন দিনের গণসংযোগে ‘ডামি নির্বাচন বর্জন ও অসহযোগ আন্দোলনের ডাক’ শিরোনামে এক পৃষ্ঠায় লিফলেট বিতরণ করবে বিএনপি। শান্তিপূর্ণভাবে এ গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করতে সারা দেশের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। লিফলেটে ১৫ বছর ধরে সরকারের দুর্নীতি, টাকা পাচার, অনাচার, নির্যাতন ও অপশাসনের সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। নির্বাচনকে ‘আসন ভাগাভাগির তামাশাপূর্ণ ডামি নির্বাচন’ আখ্যা দিয়ে তা বর্জনের আহ্বান জানানো হয়। এর পাশাপাশি ভোটগ্রহণে নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে বিরত থাকার অনুরোধসহ পাঁচ দফা তুলে ধরা হয়েছে।

যুগান্তর

Exit mobile version