Site icon The Bangladesh Chronicle

ভোটের আগে মুঠোফোন নজরদারির নতুন ব্যবস্থা

নির্বাচনের আগে মুঠোফোনে নজরদারির নতুন ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে সরকার। এ ব্যবস্থায় কোন মুঠোফোন ব্যবহারকারী কোথায় অবস্থান করছেন, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাবে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা। এটি স্থাপন করতে মোবাইল অপারেটরদের ব্যয় হবে প্রায় ২০০ কোটি টাকা।

মুঠোফোন ব্যবহারকারীদের ওপর নজরদারির ব্যবস্থা এখনো আছে। এ ব্যবস্থায় একটি মুঠোফোন নম্বর ব্যবহারকারী কোন এলাকায় রয়েছেন, তা জানা যায়। তবে সুনির্দিষ্ট অবস্থান জানা যায় না। নতুন ব্যবস্থা হবে আরও সুনির্দিষ্ট।

ধরা যাক, একজন মুঠোফোন ব্যবহারকারী এখন ফার্মগেট মোড়ে রয়েছেন। এখনকার ব্যবস্থায় সেখানকার মোবাইল নেটওয়ার্কের বেজ ট্রান্সসিভার স্টেশনের (বিটিএস, যা টাওয়ার নামে পরিচিত) আওতার তিনটি কেন্দ্রের (সেল) কোনটিতে গ্রাহক অবস্থান করছেন, তা জানা যায়। যেহেতু বিটিএসের আওতা মোটামুটি বড় থাকে, ফলে গ্রাহকের সুনির্দিষ্ট অবস্থান জানা যায় না।

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও টেলিযোগাযোগ খাত সূত্র বলছে, নতুন ব্যবস্থায় ওই ব্যক্তি ফার্মগেট মোড়ের ঠিক কোন জায়গায় আছেন, সেটিও সুনির্দিষ্টভাবে জানা যাবে। ফলে ব্যক্তি কোন ভবনে রয়েছেন, তা শনাক্ত করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ব্যবহার করে জানা যাবে বিপুলসংখ্যক মানুষের গতিবিধি।

নতুন ব্যবস্থায় মুঠোফোন ব্যবহারকারীর ছয় মাসের ‘জিও লোকেশন’ উপাত্ত সংরক্ষণ করা হবে। সেখান থেকে তাঁর গতিবিধির এলাকা শনাক্ত করা সম্ভব। জিও লোকেশন হলো মুঠোফোন গ্রাহকের অবস্থানের তথ্য। একজন গ্রাহক মুঠোফোন নিয়ে যদি কোথাও যান, মুঠোফোন যদি সচল রাখেন, তাহলে তাঁর অবস্থানের তথ্য জানা যায় জিও লোকেশনের মাধ্যমে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তিবিশেষজ্ঞ প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান ব্যবস্থায় বেশিসংখ্যক মানুষের তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন। কারণ, প্রত্যেকের তথ্য আলাদা আলাদাভাবে সংগ্রহ করতে হয়। নতুন ব্যবস্থা কাজ করবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে। এতে হাজার হাজার মানুষের জিও লোকেশন বিশ্লেষণ করা সহজ হয়ে যাবে।

সরকারি সংশ্লিষ্ট একটি সংস্থার নথি অনুযায়ী, নজরদারির নতুন ব্যবস্থায় সব ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান (আইএসপি), ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) প্রতিষ্ঠান, ন্যাশনাল ইন্টারনেট এক্সচেঞ্জ (এনআইএক্স) সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ও মোবাইল অপারেটরের ব্যবস্থা একটি সরকারি সংস্থার ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। এর মাধ্যমে মোবাইল অপারেটরদের কাছ থেকে গ্রাহকদের জিও লোকেশন তথ্য পাবে সব আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থা।

নজরদারির নতুন ব্যবস্থাটির নাম ‘ইন্টিগ্রেটেড লফুল ইন্টারসেপশন সিস্টেম’ (আইএলআইএস বা সমন্বিত আইনসম্মত আড়ি পাতার ব্যবস্থা)। নথিপত্র ও সংশ্লিষ্ট সরকারি সূত্রে জানা গেছে, এটি চালুর জন্য ২০১৮ সালের মার্চে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল।

অনুলিপি দেওয়া হয়েছিল সরকারের কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে। তবে সরকারের প্রস্তুতির ঘাটতি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘গড়িমসিতে’ তা চালু হয়নি। তবে সম্প্রতি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডেকে আগামী মাস নভেম্বরের শুরু থেকে ব্যবস্থাটি চালু করতে বলে দেওয়া হয়েছে।

আগামী জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। তার আগে মাঠের বিরোধী দলগুলো নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলন জোরদারের কথা বলছে।

বিনিয়োগ অপারেটরদের

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত ১২ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে এই ব্যবস্থা চালুর কথা বলেছিলেন। তখন তিনি বলেন, রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম বন্ধে ‘আইনসম্মতভাবে’ আড়ি পাতার ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর একটি হলো আইএলআইএস।

এর আগে ২০২২ সালের ১ জুন সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ‘পার্ট প্রকিউরমেন্ট অব ইন্টিগ্রেটেড লফুল ইন্টারসেপশন (এলআই) সিস্টেম-জিও লোকেশন সিস্টেম অ্যান্ড রিলেটেড সার্ভিসেস’ কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দেয়। তখন বলা হয়, এটি ফ্রান্সের ইন্টারসেক এসএর কাছ থেকে সরাসরি ক্রয় করা হবে। ব্যয় হবে ১৭২ কোটি টাকার কিছু বেশি।

সরকার বলছে, ব্যবস্থাটি চালু করা হবে অপরাধ দমনে। এ বিষয়ে ২০১৮ সালের মার্চে দেওয়া এক চিঠিতে বলা হয়, এই ব্যবস্থা ব্যবহার করে জনসাধারণের নিরাপত্তার জন্য অপরাধ ও অপরাধী শনাক্তকরণে প্রয়োজনীয় উপাত্ত সংগ্রহের জন্য পর্যবেক্ষণ কাজ পরিচালনা করা হবে। সব আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থা তাদের চাহিদা অনুযায়ী জিও লোকেশনসহ অন্যান্য সুবিধা পাবে।

বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ও মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটব সূত্র জানিয়েছে, যে জিও লোকেশন-ব্যবস্থা চালুর জন্য বলা হয়েছে, সেটি বাস্তবায়ন করতে অপারেটরদের নতুন সফটওয়্যার ও সরঞ্জাম প্রয়োজন। তা কিনতে বড় অঙ্কের অর্থ দরকার। অ্যামটব এই অর্থ চেয়েছিল বিটিআরসির সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল (এসওএফ) থেকে। তারা যে প্রকল্প দাখিল করেছিল, সেটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২১০ কোটি টাকার সমান।

বিটিআরসি সূত্রে জানা যায়, গত ৮ আগস্ট ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সভাকক্ষে মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের সভাপতিত্বে সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের ব্যবস্থাপনা কমিটির ২০তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অ্যামটবের প্রস্তাব নাকচ করা হয় এই বলে যে টেলিযোগাযোগ আইন অনুযায়ী আবেদনটি বিবেচনার সুযোগ নেই। অর্থাৎ অপারেটরগুলোকে নিজস্ব অর্থে নতুন ব্যবস্থাটি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেশে চারটি মোবাইল অপারেটর রয়েছে গ্রামীণফোন, রবি-আজিয়াটা, বাংলালিংক ও টেলিটক।

অ্যামটবের কাছে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল, নজরদারির কাজে ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা আছে, এমন ক্ষেত্রে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো, যারা মানবাধিকার ও গ্রাহকের গোপনীয়তার অধিকারের ক্ষেত্রে দায়বদ্ধ, তারা কি এ ধরনের উপাত্ত ভাগাভাগি করতে পারে? জবাবে অ্যামটবের মহাসচিব লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ জুলফিকার লিখিত বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ আইন ও এর আওতায় প্রদত্ত লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী মোবাইল অপারেটররা সেবা পরিচালনা করে আসছে। ওই আইনের নির্দেশনা অনুযায়ী অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও অপারেটররা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করে থাকে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইনের ৯৭(ক) ধারায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে’ যেকোনো টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যবহারকারীর পাঠানো বার্তা ও কথোপকথন প্রতিহত, রেকর্ড ধারণ বা তত্সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের জন্য সরকার সরকারি সংস্থার কোনো কর্মকর্তাকে ক্ষমতা দিতে পারবে। টেলিযোগাযোগ সেবাদানকারী নির্দেশ পালনে বাধ্য থাকবে।

তবে আইনজীবী ও অধিকারকর্মীদের কারও কারও মত, বার্তা ও কথোপকথনের কথা বলা হলেও ব্যক্তির অবস্থানের তথ্য দেওয়ার বিষয়টি আইনে নেই। এটা মানুষের গোপনীয়তার অধিকারের লঙ্ঘন। আর জনশৃঙ্খলা একটি বিস্তৃত বিষয়। এর সুযোগ নিয়ে সরকার সাধারণত সবার ওপর নজরদারি করে।

মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়ার আইন ও উদীয়মান প্রযুক্তি বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক মুহাম্মদ এরশাদুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, সভ্য গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে নির্দিষ্ট ব্যক্তির ওপর আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে নজরদারির সুযোগ রাখা হয়, গণভাবে নয়। বাংলাদেশে ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলা’র কথা বলে গণনজরদারি করা হয়। বিরোধীদের দমাতে এটা যে ব্যবহার করা হয়, তা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

‘সেই নিশ্চয়তা নেই’

সেবাদানকারীরা বলছেন, উন্নত বিশ্বে মুঠোফোন ব্যবহারকারী ব্যক্তি সুনির্দিষ্টভাবে কোথায় অবস্থান করছেন, তার উপাত্ত ব্যবহার করা হয় জরুরি সেবাদানের ক্ষেত্রে। ব্যক্তির নাম ও পরিচয় ব্যবহারকারীরা জানতে পারেন না।

ধরা যাক, কোনো ব্যক্তি জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে ফোন করে বলছেন, তিনি বাসায় একা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁর চিকিৎসাসেবা দরকার। তখন তাঁর জিও লোকেশন ব্যবহার করে চিকিৎসাসেবাদাতারা পৌঁছে যান। বাংলাদেশে ৯৯৯-এ ফোন করার পর ঠিকানার খুঁটিনাটি বলতে হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশে জরুরি সেবাদান মূল উদ্দেশ্য নয়, বরং নজরদারির জন্য জিও লোকেশন উপাত্ত নেওয়ার নতুন ব্যবস্থা চালু হচ্ছে।

শুধু সমন্বিত আইনসম্মত আড়ি পাতার ব্যবস্থা নয়, সরকার এর আগেও মুঠোফোনে আড়ি পাতার কিছু প্রযুক্তি কিনেছে। গত ১০ জানুয়ারি ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যম হারেৎস এক প্রতিবেদনে জানায়, ইসরায়েলের সাবেক এক গোয়েন্দা কমান্ডার পরিচালিত প্যাসিটোরা নামের একটি কোম্পানির কাছ থেকে মুঠোফোনে নজরদারির অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কিনেছে বাংলাদেশ সরকার।

এই প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে নজরদারির সরঞ্জাম ও গতিবিধি শনাক্ত করতে সক্ষম সফটওয়্যার দিয়ে সজ্জিত একটি গাড়ি, যা আশপাশের প্রায় আধা কিলোমিটারের মধ্যে থাকা মুঠোফোনের ‘এনক্রিপ্টেড’ (সুরক্ষিত) হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা, মেসেঞ্জারে কথোপকথন, যোগাযোগের তালিকা, কল ও খুদে বার্তার (এসএমএস) তথ্য সংগ্রহ করতে পারে।

২০২২ সালের ১৭ মার্চ ফ্রান্সের সংবাদমাধ্যম ইন্টেলিজেন্স অনলাইন এক প্রতিবেদনে জানায়, বাংলাদেশ ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে আড়ি পাতার প্রযুক্তি কিনেছে। এর আগে ২০১৫ সালে মুঠোফোনে আড়ি পাতা ও নজরদারির জন্য বাংলাদেশের কেনা সরঞ্জাম মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আটকে দিয়েছিল সুইজারল্যান্ড।

আঞ্চলিক টেলিযোগাযোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্নএশিয়ার জ্যেষ্ঠ পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে আড়ি পাতা আইনত নিষিদ্ধ নয়। তবে সেই আইনের প্রয়োগ কতটা ও কীভাবে হয়, তা রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করে। আধুনিক প্রযুক্তি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা সুসভ্য রাষ্ট্রের পরিচয় বহন করে না।

তিনি বলেন, রাষ্ট্র পরিবর্তনযোগ্য নয়, সরকার পরিবর্তনযোগ্য। আজ যাঁরা সরকারে আছেন, তাঁরা কোনো দিন বিরোধী দলে গেলে তাঁদের বিরুদ্ধে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হবে না, সেই নিশ্চয়তা নেই।

আবু সাঈদ খান আরও বলেন, নতুন ব্যবস্থায় গ্রাহকের ওপর নজরদারির জন্য সরঞ্জাম ও সফটওয়্যার কেনার অর্থ গ্রাহকের কাছ থেকেই নেওয়া হবে। এটা মোবাইল অপারেটর বা সরকারি সংস্থা কোনোভাবেই পারে না। বাংলাদেশে মোবাইল অপারেটরগুলোকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে টেলিযোগাযোগ সেবা দিতে। মানুষের জিও লোকেশন উপাত্ত দিয়ে গোয়েন্দাগিরির সহযোগী হতে নয়।

Exit mobile version