অলিউল্লাহ নোমান :  নিজের অধীনে একতরফা জাতীয় নির্বাচন করার জন্য শেখ হাসিনাকে পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন এ বি এম খায়রুল হক, মোজাম্মেল হোসেন, এস কে সিনহা ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। এই চারজনই সুপ্রিমকোর্টের আওয়ামী বিচারক হিসাবে খ্যাতি রয়েছে। এই চারজনের রায়েই বাতিল করা হয় সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী। এই সংশোধনীর মাধ্যমেই ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এই সংশোধনীর আলোকে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর দু’টি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
২০০৮ সালে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবে ত্রয়োদশ সংশোধনীর আলোকে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল না ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময়। বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত দুই জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কারো কোন রকমের প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। মানুষ নির্বিঘ্নে উৎসাহ আনন্দে ভোট দিয়ে নিজের মতামত প্রকাশের সুযোগ পেয়েছিল। গড়ে উঠেছিল নির্বিঘ্নে ভোট দিয়ে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সরকার গঠনের একটি সংস্কৃতি। কিন্তু মানুষের নির্বিঘ্নে ভোট প্রয়োগের এই সংস্কৃতিকে কেড়ে নিয়েছে চার বিচারপতির রায়ে। মূলত তারাই গড়ে দিয়েছেন শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের পাটাতন।
অথচ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট আবেদনে হাইকোর্ট বিভাগে শুনানী হয়েছিল ৩ জন সিনিয়র বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত বৃহত্তর বেঞ্চে। ওই বেঞ্চের বিচারকরা একমত হয়ে রায় দিয়ে বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য অলঙ্কার।
দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অলঙ্কার হিসাবে কাজ করছে। এছাড়া আপিলের শুনানীর পরও আরো ৩ বিচারক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষেই রায় দেন। মূলত হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিলটি নিষ্পত্তি হয়েছিল বিভক্ত রায়ের মাধ্যমে। ৭ জন বিচারপতি একসঙ্গে শুনানী করে ৪ জন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেশে গণতন্ত্রকে ধ্বংসের পক্ষে এবং ৩জন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ বলে রায় দিয়েছিলেন। এই ৩ জন একমত পোষণ করেছিলেন হাইকোর্ট বিভাগের দেওয়া রায়ের সাথে।
যে ৩ বিচারপতি হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন তাদের কাউকেই শেখ হাসিনা পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ দেননি। যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে রায় দিয়েছিলেন, সেই চার বিচারককে ক্রমান্বয়ে প্রধান বিচারপতির পদে বসিয়ে পুরস্কৃত করেছেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের কারণেই দেশে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণে একতরফা নির্বাচনের নামে সংসদ গঠিত হয়েছিল। তখন মানুষের ভোটেরও প্রয়োজন হয়নি। ২৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছিল শেখ হাসিনার মনোনীত প্রার্থীদের। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ নিলেও শেখ হাসিনার সাজানো চকে ফলাফল ঘোষিত হয়।
২০২৪ সালের জানুয়ারী তৃতীয়বারের মত শেখ হাসিনার অধীনে আরো একটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে।
যে চার বিচারক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে রায় দিয়েছিল তারা সকলেই আওয়ামী লীগের ক্যাডার হিসাবে পরিচিত ছিলেন সুপ্রিমকোর্টে। এই চারজনই ছিলেন আইন পেশায় নিয়োজিত। আইন পেশায় থাকাকালীন অবস্থা থেকেই তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন এবং আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তাদের হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক হিসাবে নিয়োগ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় বসেই তাদেরকে আপিল বিভাগে নিয়োগ দেন। দলীয় ক্যাডারদের আপিল বিভাগে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে কব্জায় নেন বিচারক বিভাগ। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মূলত বিচার বিভাগ শেখ হাসিনার কব্জায় চলে যায়। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হউক এমন কোন আদেশ বিচার বিভাগ থেকে দেওয়া হয়নি। বরং ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করতেই পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন রায় দেওয়া হয়েছে। আজকের এই ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার মূল সহযোগিতায় এখন বিচার বিভাগ।
আমার দেশ