Site icon The Bangladesh Chronicle

ভুয়া তথ্য দিয়ে ই-পাসপোর্টও পান আজিজের দুই ভাই

হারিছ আহমেদ ও তোফায়েল আহমেদ

অসত্য তথ্য দিয়ে তৈরি সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের দুই ভাইয়ের সেই জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও পাসপোর্ট বাতিল হয়নি। উল্টো ১০ বছর মেয়াদের ই-পাসপোর্ট দিয়েছে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর।

নির্বাচন কমিশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সাবেক সেনাপ্রধানের দুই ভাই হারিছ আহমেদ ও তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফের ভিন্ন নাম-ঠিকানা ও পরিচয়ে বানানো পাসপোর্ট দুটির মেয়াদ বহাল আছে ২০৩০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এটিই পাসপোর্ট অধিদপ্তর থেকে দেওয়া ১০ বছর মেয়াদের ই-পাসপোর্ট।

ভুয়া এনআইডি ও পাসপোর্টের বিষয় নিয়ে এর আগে সংবাদমাধ্যমে খবর হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাধর ব্যক্তির স্বজন হওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি আমলেই নেওয়া হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান। তাঁদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আজিজ আহমেদের দুই ভাই একই নাম ব্যবহার করে অ্যান্টিগুয়া ও বার্বুডার নাগরিক হিসেবেও পাসপোর্ট নিয়েছেন। তাঁদের এ দেশের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হবে চলতি বছরের মে ও সেপ্টেম্বর মাসে।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইলেকট্রনিক বা ই-পাসপোর্টে নিজেদের ছবি ব্যবহার করলেও মা-বাবার নাম বদল করেছেন বহুল আলোচিত দুই ভাই। ভিন্ন ঠিকানাও ব্যবহার করে তাঁরা জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট করার সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সশরীর হাজির থেকে ছবি তুলতে হয়।

অসত্য তথ্য দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র নেওয়ার বিষয়টি জানাজানির পরও কেন তা বাতিল করা হলো না, জানতে চাইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ঠিক বিষয়টি জানি না। তবে কেউ যদি এ বিষয়ে অভিযোগ বা আবেদন করেন, তাহলে অবশ্যই কমিশন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। যে কেউ মিথ্যা তথ্য দিয়ে পাসপোর্ট নিলে তা তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

যেসব ভুয়া তথ্য দেন দুই ভাই

আজিজ আহমেদের ভাই হারিছ আহমেদ জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট নিয়েছেন মোহাম্মদ হাসান নামে। পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ৮ আগস্ট আবেদন করে দুই সপ্তাহেরও কম সময়ে ২০ আগস্ট ই-পাসপোর্ট হাতে পান তিনি। কিন্তু সে সময় তাঁর এমআরপি পাসপোর্ট ছিল। ২০১৭ সালে পাওয়া এমআরপি পাসপোর্টের মেয়াদ ছিল ২০২২ সাল পর্যন্ত। এমআরপি পাসপোর্টের মেয়াদ দুই বছর বাকি থাকতেই হারিছ আহমেদ অন্য নামে ১০ বছর মেয়াদের ই-পাসপোর্ট পান। ট্রাস্ট ব্যাংকের মাধ্যমে ফি পরিশোধ করে আগারগাঁও থেকে এই পাসপোর্ট নেন তিনি। হারিছ আহমেদের জাতীয় পরিচয়পত্রে ও পাসপোর্টে বাবার নাম ‘সুলেমান সরকার’ এবং মায়ের নাম ‘রাহেলা বেগম’ উল্লেখ করা হয়েছে। জরুরি যোগাযোগের জন্য ব্যক্তির নাম ও যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে, তা হলো, ফাতেমা বেগম, আর-২৮ নূরজাহান রোড, মোহাম্মদপুর।

পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, হারিছ আহমেদ ২০১৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদ হাসান নামে ঢাকার আগারগাঁও অফিস থেকে প্রথম পাসপোর্ট করান। তাতে জরুরি যোগাযোগের জন্য ‘ফাতেমা বেগম’-এর নাম ব্যবহার করা হয়েছিল। আর ঠিকানা দেওয়া হয়েছিল, ২৮ নূরজাহান রোড, মোহাম্মদপুর। ২০১৯ সালে তিনি পাসপোর্টে নিজের ছবি বদল করেন।

আরও পড়ুন

আরেক ভাই তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ই-পাসপোর্ট নিয়েছেন তানভীর আহমেদ তানজীল নামে। তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্রে ও পাসপোর্টে বাবার নাম সোলায়মান সরকার এবং মায়ের নাম ফাতেমা বেগম লেখা আছে। ২০২০ সালের ১০ মার্চ আবেদন করে ২০ মার্চ পাসপোর্ট হাতে পান তিনি। জোসেফেরও ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মেয়াদের এমআরপি পাসপোর্ট থাকলেও তিন বছর আগেই তিনি ১০ বছর মেয়াদে ই-পাসপোর্ট পান। তিনিও ট্রাস্ট ব্যাংকের মাধ্যমে ফি পরিশোধ করেন। তবে পাসপোর্ট হাতে পান ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট পাসপোর্ট অফিস থেকে।

পাসপোর্ট অধিদপ্তরের একই সূত্র জানায়, জোসেফ প্রথম পাসপোর্ট নেন ২০১৮ সালের ১৩ মে, তানভীর আহমেদ তানজীল নামে। তাতে স্থায়ী ঠিকানা ছিল ১২৩/এ তেজকুনীপাড়া, তেজগাঁও, ঢাকা। আর বর্তমান ঠিকানা ছিল ৪০ খানপুর, নারায়ণগঞ্জ। বৈবাহিক অবস্থা—অবিবাহিত। ওই বছরেরই ৪ জুন স্ত্রীর নাম যুক্ত করে তিনি পাসপোর্ট সংশোধন করান। ২০১৯ সালে পাসপোর্টে স্থায়ী ঠিকানা বদল করেন। এ সময় নিজের ছবি, স্থায়ী ঠিকানা ও জরুরি যোগাযোগের ঠিকানা পরিবর্তন করেন।

দেশের একাধিক থানা ও আদালতের নথিপত্র, সাজা মওকুফ চেয়ে (জোসেফের জন্য) মায়ের করা আবেদন এবং এমনকি সাজা মওকুফের সরকারি প্রজ্ঞাপনে, হারিছ ও জোসেফের বাবার নাম আবদুল ওয়াদুদ ও মায়ের নাম রেনুজা বেগম লেখা আছে। দুই ভাইয়ের স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানাও ভিন্ন ভিন্ন দেখানো হয়েছে।

আদালতের নথি ও সরকারি প্রজ্ঞাপনে হারিছ, আনিস ও জোসেফ—এই তিন ভাইয়ের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে, ডি/৯ নূরজাহান রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা ১২০৭। কিন্তু মোহাম্মদ হাসান নামে হারিছের করা জাতীয় পরিচয়পত্রে স্থায়ী ঠিকানা বলা হয়েছে, মতলব উত্তর উপজেলা, চাঁদপুর। আর বর্তমান ঠিকানা লেখা আছে বাসা নং ২৮, ডি-১ ব্লক, নূরজাহান রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা। তানভীর আহমেদ তানজীল নামে জোসেফের করা জাতীয় পরিচয়পত্রে বর্তমান ঠিকানা দেখানো হয়েছে, মিরপুর ডিওএইচএসের একটি বাসা। আর স্থায়ী ঠিকানা দেওয়া হয়েছে, ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট বাজার এলাকার একটি বাসা।

নানা রকম ভুয়া তথ্য দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে কথা বলে জানাতে পারব।’

হারিছ ও জোসেফ হত্যাকাণ্ডের দুটি মামলায় যাবজ্জীবন ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন। তাঁদের আরেক ভাই আনিস আহমেদ একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ছিলেন। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ হারিছ ও আনিসের সাজা মওকুফ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর আগে মা রেনুজা বেগমের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জোসেফের সাজা মওকুফ করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। জোসেফ তখন কারাগারে ছিলেন।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরায় ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রচারিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ তথ্যচিত্রে হারিছ ও আনিসকে পলাতক আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তবে সে সময় প্রথম আলোর অনুসন্ধানে তাঁদের সাজা মওকুফের বিষয়টি বেরিয়ে আসে এবং প্রথম আলোয় তা প্রধান প্রতিবেদন হিসেবে প্রকাশিত হয়।

ভুয়া তথ্য দেওয়া অপরাধ

জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন অনুযায়ী, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা জ্ঞাতসারে কোনো মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য দেওয়া অথবা তথ্য গোপন করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ অপরাধের শাস্তি অনূর্ধ্ব এক বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড। এই আইনের ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি জাতীয় পরিচয়পত্র জাল করলে বা জ্ঞাতসারে ওই জাতীয় পরিচয়পত্র বহন করলে তিনি সাত বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

আর পাসপোর্ট অধ্যাদেশের ১১ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বা সঠিক তথ্য লুকিয়ে অন্য নামে পাসপোর্ট নিলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ছয় মাসের কারাদণ্ড বা দুই হাজার টাকা জরিমানা।

জাতীয় পরিচয়পত্র করার জন্য জন্ম ও নাগরিকত্ব সনদ জমা দিতে হয়। তাতে ব্যক্তির নাম ও মা-বাবার নাম দিতে হয়। তার ভিত্তিতেই জাতীয় পরিচয়পত্রে ব্যক্তিগত তথ্য যুক্ত হয়। ফলে যাঁরা বেনামে ও ভুয়া নামে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে থাকেন, তাঁরা এই জন্ম ও নাগরিকত্ব সনদেও অসত্য তথ্য ব্যবহার করে থাকেন।

জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন অনুযায়ী, জন্ম বা মৃত্যুনিবন্ধনের ক্ষেত্রে মিথ্যা তথ্য দিলে অনধিক পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা অনধিক এক বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান আছে।

আজিজ আহমেদ ২০১৮ সালের ২৫ জুন থেকে ২০২১ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গত সোমবার এই সাবেক সেনাপ্রধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে অযোগ্য হয়েছেন।

সেনাপ্রধান থাকার সময়েই আজিজ আহমেদের ভাইদের ভুয়া তথ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট করানোর ক্ষেত্রে তাঁর প্রভাব খাটানোর বিষয়ে প্রথম আলোসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে। জোসেফের সাজা মওকুফের আবেদন থেকে শুরু করে দেশত্যাগ পর্যন্ত কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রথম আলো। ‘অসত্য তথ্য দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট’ শিরোনামে সংবাদটি ছাপা হয়েছিল ২০২১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি।

prothom alo

Exit mobile version